Do to others what you would have them do to you, for this sums up the Law and the Prophets. (Gospel according to Matthew 7:12)
Stand out firmly with justice as witnesses for God, even if it be against yourselves or parents and relatives, be he rich or poor. (Koran 4:135)

শুক্রবার, ২ মে, ২০১৪

নারীর কোরান – ১ (ভূমিকা)

১.১। আল্লাহ কি কোরানের মাধ্যমে পুরুষদের উপর একটি পুরুষতান্ত্রিক বা পুরুষশাসিত সমাজ প্রতিষ্ঠা করার ও তা রক্ষা করে চলার দায়িত্ব ও কর্তব্য আরোপ করেছেন? আমরা যারা কোরান অথবা কোরানের কোন অনুবাদ/ভাষ্য পড়েছি তাদের নিকট প্রশ্নটি উত্থাপন করা গেলে যে উত্তর পাওয়া যাবে বলে আমি আশা করছি তার ভিত্তিতে আমরা সম্ভবত প্রধানত চারটি ভাগে বিভক্ত হবো— এদের তিনটি দল হ্যাঁ-বাচক উত্তর দেবেন ও একটি দল না-বাচক।

১.২। একদল অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে হ্যাঁ বলবেন এবং আমাদের কালের নারীদের স্বাধীনতা, আত্ম-নির্ধারণ, উন্নয়ন ও সাম্যের দিকে অগ্রগতির পথে কোরানকে বাধা বলে সাব্যস্ত করবেন। আরেক দল হ্যাঁ বলবেন এবং এটিকে নারীদের প্রকৃত নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য আবশ্যক বলে দাবী করবেন। তৃতীয় অংশ বেশ খানিকটা অস্বস্তির সাথে হ্যাঁ বলবেন এবং বিষয়টি ব্যাখ্যা-সাপেক্ষ বলে আবেদন করবেন। চতুর্থ দলটি স্পষ্টভাবে না উচ্চারণ করলেও তাদের বিরোধীদের নিকট তাদের অবস্থানের পক্ষে পাল্টা ভাল যুক্তি উপস্থাপন করতে অসমর্থ হয়ে উঠবেন।

১.৩। প্রশ্নটি উত্থাপনের প্রয়োজন কী?—কেউ কেউ হয়তো উত্তর না দিয়ে প্রশ্নকর্তাকে পাল্টা এই প্রশ্নটি করে বসতে পারেন। এই পাল্টা প্রশ্ন একটি বিষয়কে পরিষ্কার করে দেয় যে, আমাদের কালে প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রশ্নের উত্তর হয় সুবিধাজনক নয়, নয়তো বিষয়টি অস্বস্তিকর, নয়তো তা অত সহজ নয়। কালের প্রসঙ্গ না হয় বাদ দেয়া গেল—নীতিগতভাবে, আমাদের কি জানবার অথবা জানতে চাওয়ার অথবা জানার চেষ্টা করার অধিকার নেই যে, আল্লাহ কোরানে প্রকৃতই কী বলতে চেয়েছেন? এর উত্তরে কেউ ‘না’ বলবেন এটা আমি আশা করছি না।

১.৪। বলা যেতে পারে, দেশের সংবিধান ও আইন নারীর অধিকারের পক্ষে ও পুরুষের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে এবং আমাদেরও কর্তব্য তাকে সমর্থন করা। কাজেই কোরানে কি লেখা আছে অথবা কোরানের কোন অনুবাদে বা কোন তফসিরের কে কী লিখল তা নিয়ে কথা তোলার দরকার কী? দরকার নেই বলতে পারতাম যদি দেখতাম দেশে কেউ স্ত্রীকে মেরে অন্ধ করে দিচ্ছে না, গ্রামে সালিশের নামে নারীর উপর নির্যাতন হচ্ছে না এবং এর দায়-দায়িত্ব কোরানের উপর, ইসলাম ধর্মের উপর আরোপ করা হচ্ছে না।

১.৫। কোরানের উপর এই দায় যারা আরোপ করেন তারা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কোরানের অপব্যাখ্যা করছেন—শুধু এটুকু বললেই আমরা রেহাই পেয়ে যাব না। আমাদের অনুবাদক ও ভাষ্যকারেরাও এই দায় আরোপের ভিত্তি যোগান দেয়ার মত কথা লিখছেন ও বলছেন। কাজেই কোরানের ইন্টারপ্রিটেশন বা অনুবাদ পুনঃ পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজন থেকেই যাচ্ছে। এদিক থেকেও আমাদের জানবার অথবা জানতে চাওয়ার অথবা জানার চেষ্টা করার অধিকার রয়েছে যে, আল্লাহ কোরানে প্রকৃতই কী বলতে চেয়েছেন।

১.৬। প্রচলিত ও প্রভাবশালী ধারণা

আমাদের সমাজে যারা কোরানের আদর্শটি উপস্থাপন করেন তাদেরকে দুটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায়। এদের মধ্যে একভাগ রীতিমতো নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্ব পন্থী। অন্যভাগ কিঞ্চিৎ কম কঠোর। এই উভয় পক্ষই ধর্ম ব্যাখ্যার অঙ্গনে অত্যন্ত প্রভাবশালী। কঠোর হোক বা নম্রই হোক, শেষ বিচারে তারা নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য পন্থী। এরূপ ব্যাখ্যাকারদের নিকট থেকে যে তিনটি নীতি পাওয়া যায় সেগুলো নীচে দেয়া হলো:
(ক) সার্বিকভাবে পুরুষরা সার্বিকভাবে নারীদের এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি স্বামী তার স্ত্রীর কর্তা (authority) ও পরিচালক (director) [কঠোর ভাষ্য], অথবা, ব্যবস্থাপক (manager) ও রক্ষক (protector) [নম্র ভাষ্য]।
(খ) স্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের আশঙ্কা এবং স্ত্রী কর্তৃক আচরণে নৈতিক আদর্শ ভঙ্গ হওয়ার ক্ষেত্রে তার উপর যন্ত্রণা আরোপ [কঠোর ভাষ্য], অথবা, শিষ্টাচার সম্মতভাবে তাকে শাসন [নম্র ভাষ্য] করতে পারবে স্বামী। উভয় ক্ষেত্রেই স্বামীর নিজের বিচার ও মূল্যায়নের ভিত্তিতেই সে স্ত্রীর উপর তার ইচ্ছা আরোপ করতে পারছে।
(গ) এরূপ ক্ষেত্রে যে উদ্দেশ্যে স্বামী একাজ করতে পারবে সেগুলো হচ্ছে: পরিশোধিত মোহরানার অর্থ ফেরত পাওয়া ও স্ত্রীকে অনুগত করা [কঠোর ভাষ্য] অথবা স্ত্রীকে তার অবস্থান থেকে সরিয়ে আনা [নম্র ভাষ্য]।

১.৭। অনুসৃতব্য নীতিগুলো

আমি প্রধানত সুরা বাকারা, নিসা ও তালাক এর কতিপয় আয়াত নিয়েই আলোচনা করবো, যা নিয়ে কেবল আমাদের দেশেই নয়, পশ্চিমেও মুসলিমদেরকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আল্লাহ কোরানে এমন কথা কি সত্যি বলেছেন যার ভিত্তিতে আমরা ১.৬ অনুচ্ছেদে বর্ণীত তিনটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি? এ প্রশ্নের উত্তর খতিয়ে দেখার জন্য যে নীতিগুলো আমি অনুসরণ করবো সেগুলো নীচে লিখলাম:
(ক) কোরানের বিভিন্ন অনুবাদ ও তফসিরের—যেগুলোকে প্রামাণ্য হিসেবেই গ্রহণ করা হয়ে থাকে—মধ্যেই সীমিত থাকা;
(খ) কোরানের একটি শব্দকে একই স্থানে বিভিন্ন অনুবাদক কিভাবে অনুবাদ করেছেন;
(গ) কোরানের কোনো আয়াতে ব্যবহৃত শব্দটি কোরানের অন্যত্র কী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে? সে অর্থ বিবেচ্য স্থানে ব্যবহার করা সম্ভব কিনা;
(ঘ) আয়াতের অনুবাদ-বচনটির মধ্যেকার সকল অংশের মধ্যে যৌক্তিক অসঙ্গতি আছে কিনা;
(ঙ) এক আয়াতের গৃহীত অর্থের সাথে অন্য স্পষ্ট আয়াতের বিরোধ আছে কিনা;
(চ) কোন বাক্যের কোন শব্দের ব্যাপক অর্থ কন্টেক্সটের দোহাই দিয়ে সীমিত না করা, যদি ব্যাপক অর্থটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সুসঙ্গত হয়;
(ছ) কোন সর্বনাম কোন বিষয়কে বুঝচ্ছে বা নির্দেশ করছে তা কন্টেক্সট অনুসারে সঙ্গতভাবে নির্ধারণ করা;
(জ) সুসঙ্গত অর্থ/অনুবাদ কি হতে পারে তার প্রস্তাবনা।

১.৮। কোরানে শব্দ ব্যবহারে প্রিসিশন

কোরানে নীতি নির্ধারণে ও আইন প্রণয়নে শব্দের নির্বাচনে একটি প্রিসিশন আছে। কোরানে নারী-পুরুষ সংক্রান্তে যা বলা হয়েছে তাতে যাকারিন (লিঙ্গগত সার্বিক ধারণা হিসেবে পুরুষ, ইংরেজিতে মেইল), উনসা (লিঙ্গগত সার্বিক ধারণা হিসেবে নারী, ইংরেজিতে ফিমেইল), রিজাল (মূর্ত অস্তিত্বশীল ব্যক্তি পুরুষ, ইংরেজিতে ম্যান), নিসা (মূর্ত অস্তিত্বশীল ব্যক্তি নারী, ইংরেজিতে ওম্যান) ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে—যেখানে শব্দ নির্বাচনে বা ব্যবহারে সচেতন প্রিসিশন খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এই দুই অর্থে নারী ও পুরুষ এর ফারাক লুপ্ত করে ফেললে এবং নারী-পুরুষের সাথে স্ত্রী-স্বামীর ডোমেইন-গত বা সেট-গত সম্পর্ককে গুলিয়ে ফেললে আয়াতের তাৎপর্যের একটি সাবস্টেনশিয়াল অংশ হারিয়ে যেতে পারে।

১.৯। ক্যাটাগরি মিসটেক

পরিবার একজন পুরুষ ও একজন নারীর স্বাধীনভাবে কৃত চুক্তির ভিত্তিতে গঠিত হয়, যার ফলশ্রুতিতে পুরুষ আবার হয়ে উঠে স্বামী এবং নারী আবার হয়ে উঠে স্ত্রী। এই চুক্তিকে আমরা মুসলিমরা বিবাহ বলে অভিহিত করে থাকি। এখানে খেয়াল করার বিষয় হচ্ছে, স্বামী পুরুষের, এবং স্ত্রী নারীর সাবসেট মাত্র; স্বামী-স্ত্রী পরিবার নামক স্বাধীন চুক্তি জাত সংগঠনের সাথে সম্পর্কিত, কিন্তু নারী-পুরুষ এমন দুই বৃহত্তর ক্যাটাগরি যাদের মধ্যে এরূপ কোন আবশ্যিক অথবা স্বাধীন চুক্তি নেই। এখন নারী-পুরুষ সংক্রান্ত কথায় নারী-পুরুষকে স্ত্রী-স্বামীতে সীমিত করে ফেললে অসঙ্গতি ও অন্যায্য কথার উৎপত্তি হতে পারে। একইভাবে স্বামী-স্ত্রী শব্দযুগলও পিতা-মাতার সাথে সর্বদা ও নির্বিচারে প্রতিস্থাপনযোগ্য নয়। পরিবারে স্বামী-স্ত্রী চুক্তির সমমর্যাদার অধিকারী দুই স্বাধীন পার্টনার, যাদের পারস্পরিক দায়বদ্ধতা কৃত চুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, কিন্তু পরিবার পরিচালনায় তারা প্রধানত পিতা ও মাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়। কোরান নিয়ে ভুল বুঝাবুঝির জন্য ক্যাটাগরি-বিভ্রান্তি বা ডোমেইন-বিভ্রান্তি বা সেট-বিভ্রান্তি প্রধান কারণ।

১.১০। আমি এখন পরিবারের সম্ভাব্য কাঠামো কতভাবে হতে পারে তা খতিয়ে দেখতে চেষ্টা করবো। তারপর আলোচনা করতে চেষ্টা করবো নারী-পুরুষ ও স্বামী-স্ত্রী বিষয়ে কোরানের প্রাথমিক ধারণাবলী নিয়ে। এবং তারপর শুরু করতে চাই মূল আলোচনাটি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন