Do to others what you would have them do to you, for this sums up the Law and the Prophets. (Gospel according to Matthew 7:12)
Stand out firmly with justice as witnesses for God, even if it be against yourselves or parents and relatives, be he rich or poor. (Koran 4:135)

শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৩

স্বব্যাখ্যাত জগত ও জীবনের প্রশ্ন

একটি চমৎকার প্রোগ্রামের বৈশিষ্ট্য কী হতে পারে? এমন প্রোগ্রাম কি লেখা সম্ভব যা স্বব্যাখ্যাত হতে পারে? যদি হয় তবে কি বলা যায় যে, এটি সবচেয়ে কুশলী প্রোগ্রাম এবং এর রাইটার একজন নিখুঁত প্রোগ্রামার? প্রোগ্রামটিকে যদি স্বব্যাখ্যাত হতে হয় তবে প্রোগ্রামের মধ্যে তার অংশ হিসেবে এমন এজেন্ট থাকতে হবে যে প্রোগ্রামের অভ্যন্তরে প্রোগ্রামারের প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম। তাছাড়া, এই প্রোগ্রামটির গঠন এমন হতে হবে যে, প্রোগ্রামটির নিয়মগুলো এবং এমনকি উৎপত্তির ব্যাখ্যাটিও প্রোগ্রামের মধ্যে থাকবে যা এজেন্টের পক্ষে আবিষ্কার করা সম্ভব হবে। অর্থাৎ বাইরের কোন প্রোগ্রামারের অস্তিত্ব কল্পনা করা ছাড়াই প্রোগ্রামটি নিজেকে ব্যাখ্যা করতে পারবে। এথেকে এজেন্ট প্রোগ্রামের পুনরাবৃত্তি ঘটাতেও সক্ষম হবে। এমন একটি প্রোগ্রামকে আমরা স্বব্যাখ্যাত প্রোগ্রাম বলতে পারি। আমাদের জগত কি এরকম একটি নিখুঁত প্রোগ্রামারের কুশলী প্রোগ্রাম?

জগত যে কেবল আছে তা-ই নয়। জগত মানুষের মত সত্তা তৈরি করেছে যে কিনা জগতের বিকাশ ও উৎপত্তির ব্যাখ্যা খুঁজছে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষ যে অগ্রগতি অর্জন করেছে তাতে সে এখন সাহসী আশাবাদী হয়ে উঠেছে যে, সে ‘সবকিছুর তত্ত্ব’ (থিওরি অব এভরিথিং) আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানের ভিত্তি কী? বিজ্ঞানের কথার বৈধতা কোথায়? বিজ্ঞানের ভিত্তি মানুষের অভিজ্ঞতা ও মানুষের যৌক্তিক চিন্তা। অভিজ্ঞতা ও চিন্তা ইন্দ্রিয়সমূহ ও বুদ্ধির প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। অভিজ্ঞতাকে জ্ঞানে পরিণত করার জন্য ও সূত্রবদ্ধ করার জন্য চিন্তার প্রয়োজন। অন্যদিকে, স্মৃতি ছাড়া অভিজ্ঞতা ও চিন্তা সম্ভব নয়।

গণিতের মাধ্যমে মানুষ এই সূত্রবদ্ধ করার কাজটি করে থাকে। প্রতিটি গাণিতিক সিস্টেম কতগুলো প্রাথমিক এক্সিওম এর উপর প্রতিষ্ঠিত। একটি গাণিতিক সিস্টেম প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম হলে এক্সিওমের সেট পরিবর্তন করে নতুন সিস্টেম তৈরি করতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা, গণিত মানুষের বুদ্ধির সৃষ্টি; এবং তার ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশ আমাদের কালে চূড়ান্ত হয়ে গেছে এবং নতুন আর কোন সিস্টেমের সম্ভাবনা ও প্রয়োজন নেই একথা বলার অধিকার আমাদের আছে কি?

বিজ্ঞানের প্রধান অবলম্বন হলো আরোহের নীতি। এই নীতি দৈনন্দিন জীবনে আমরা সবাই ব্যবহার করে থাকি। আমরা দেখেছি, শুনেছি যে অন্যেরা দেখেছে—আগুনে যে হাত দিয়েছে তার হাত পুড়েছে। তাই আরোহের নীতি অনুযায়ী আমরা বলি, আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যায়। এই নীতির পেছনে কাজ করে আমাদের এই বিশ্বাস যে, জগত সুশৃঙ্খল। জগত সুশৃঙ্খল—এটি বিজ্ঞানেরও ভিত্তি। আরোহের নীতি বাদ দিয়ে বিজ্ঞান হয় না। কিন্তু এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল, কয়বার দেখলে তা থেকে সাধারণ সূত্র তৈরি করা যায়?

কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, বিজ্ঞান মানুষের অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি, স্মৃতি, গণিত, যুক্তি ও আরোহের নীতির বৈধতার উপর প্রতিষ্ঠিত। এগুলোর পরম বৈধতা কাণ্ডজ্ঞানের কাছে প্রশ্নাতীত। বিজ্ঞানের ভিত্তির মধ্যে যে এনথ্রপোমরফিক এলিমেন্টগুলো রয়েছে তা থেকে বিজ্ঞানকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। সেরূপ চেষ্টাকে চোখ ব্যতিরেকে দেখার এবং বুদ্ধি ব্যতিরেকে চিন্তা করার প্রয়াসের মত হবে। তাহলে বিজ্ঞানের আবিষ্কার ও সূত্রাবলীর কি তবে কোন মূল্য নেই? বিজ্ঞানই তো আমাদের জীবনকে বাস্তবে পাল্টে দিয়েছে। বিজ্ঞানের প্রয়োগকে যথেষ্ট কার্যকর দেখতে পাচ্ছি আমরা আমাদের সমকালীন জীবনে। তাহলে কী এটি ধরে নিতে হবে যে, যা কিছু কার্যকর, যা কিছু সুফলপ্রসূ তা-ই সত্য? কাণ্ডজ্ঞান এখানেও সন্তুষ্টচিত্তে হ্যাঁ-বাচক উত্তর দেবে।

সঠিক এক্সপেরিমেন্ট থেকে ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া, আবার ত্রুটিপূর্ণ এক্সপেরিমেন্ট থেকে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার নজীর ও সম্ভাবনা দুটোই বিজ্ঞানে রয়েছে। গতকাল যা সঠিক বলে মনে করার পর্যাপ্ত যুক্তি ছিল বলে মনে করা হয়েছিল আজ তা পরিহার করতে হচ্ছে। আজ যা সঠিক বলছি তা কাল পরিত্যাজ্য হবে না তা কে জোর দিয়ে বলতে পারে? যারা সব কিছুকেই বিচার করে দেখতে চান তারা বিজ্ঞানের কথাকে আপেক্ষিক, টেনটেটিভ, প্রায়োগিক মূল্য যুক্ত এবং জোরালো প্রত্যাশা হিসেবেই কেবল দেখবেন। বিজ্ঞান ‘রিফাইন্ড কমন সেন্‌স’-এর বেশী কিছু নয়। বিজ্ঞানকে পরম সত্য আবিষ্কারের টুল হিসেবে দেখতে হলে মানুষের জ্ঞানবৃত্তিকে পরম হিসেবে দেখতে হবে, জগত যেভাবে মানুষের নিকট ধরা দিয়েছে জগত আদতে সেটাই—এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমাদের গাণিতিক সিস্টেমগুলোকে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আমাদের সামর্থ্যকে চূড়ান্তভাবে নির্ভুল সক্ষমতা হিসেবে ধরে নিতে হবে।

এই জগতের সমস্ত প্রপঞ্চের ব্যাখ্যা দেয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব হবে—এটি আশা করা যেতে পারে। জগতের উৎপত্তির ব্যাখ্যাও মানুষ দিতে পারবে; এমনকি একটি সরলতম সূত্রের মাধ্যমে আমাদের সমগ্র জগতের শুরু থেকে শেষতক পুরো ইতিহাসটিকে লিখে দিতে পারবে। এটি করা গেলেই জগত স্বগতভাবে বাস্তব এবং জগত স্বসৃষ্ট একথা বলার অধিকার জন্মায় কি? একটি ভার্চুয়াল জগত বা সুনিপুণ ও দীর্ঘস্থায়ী স্বপ্নের জগতেও এটি সম্ভব।

জগতকে কাজে লাগানোর জন্য জগতকে জানা প্রয়োজন। এই প্রয়োজন জগতকে জানার যথেষ্ট যুক্তি। কিন্তু জগত আমা দ্বারা জ্ঞাত হবে—এইটিই কি সর্বোচ্চ মূল্যবান কিছু? এটি সাধিত হলেই মানুষের জীবন ও জগত প্রক্রিয়া সার্থক হলো বলা যায় কি? আমরা কি তাহলে জগতের জ্ঞাত হওয়ার বাহন মাত্র? বিজ্ঞানী ও দার্শনিকেরা কি তবে এক শ্রেণীর এলিট যাদেরকে সৃষ্টি করাই প্রকৃতির উদ্দেশ্য ও অন্যেরা নিছক তাদের আবির্ভাবের ক্ষেত্র তৈরির সেবাদাস? আমরা বেশীর ভাগ মানুষ কি তবে বেগার খাটার জন্য? আর এতে যে সুখটুকু পাচ্ছি তাতেই কি জীবনের সার্থকতা? বিজ্ঞান যতই অগ্রসর ও সফল হোক না কেন, শেক্সপিয়ারের হ্যামলেটের প্রশ্ন ‘টু বি অর নট টু বি’ বা এনিগ্‌মা’র কার্লই’র প্রশ্ন ‘হোয়াই’ এর উত্তর অজানাই থেকে যাবে।(১)

তাছাড়া, এই ব্যাখ্যায় সাফল্য মানুষকে কী এনে দিতে পারে, যদি মানুষের জীবনের মূল্য, উদ্দেশ্য ও তাৎপর্যকে বড় করে দেখা হয়? জগতের ব্যাখ্যা খুঁজে পেলেও এবং ঈশ্বরের প্রয়োজন ছাড়াই জগতের উৎপত্তি ও বিকাশ ব্যাখ্যা করা গেলেও ব্যক্তির জীবনের প্রয়োজন তা পূরণ করতে পারে না। আমাদের পক্ষে তখন কী বলা সম্ভব?—জীবন একটি সুযোগ, জগত একটি নিখরচা রেস্তোরা, যে কদিন বাঁচি উপভোগ করি; অথবা, জীবন একটি দুর্ভাগ্য, জগত একটি কষ্টের কারাগার, যাদের বিনাশেই দুঃখের অবসান। কিন্তু ঈশ্বরের সাথে যুক্ত ব্যক্তি সহজেই একথা বলতে পারেন: ঈশ্বরের অস্তিত্ব আমার জন্য একটি সৌভাগ্য, নয়তো আমার এ জীবন নিয়ে আমি করতামটা কী?

জগতের কারণের সাথে নয়, ব্যক্তির জীবনের উদ্দেশ্য, মূল্য ও তাৎপর্যের সাথেই তাই ঈশ্বরের সম্পর্ক মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ।

… ... ...

(১) শেক্সপিয়ারের প্রশ্নটি এসেছে হ্যামলেটের মুখ থেকে। “বেঁচে থাকব, নাকি আত্মহত্যা করব, সেটাই যে প্রশ্ন।” এটিই সেই মূলগত অস্তিত্ববাদী প্রশ্ন। এনিগ্‌মা একটি সংগীত প্রতিষ্ঠান, মাইকেল ক্রেটু—যাকে অনেকে কার্লই বলে ডাকেন—প্রতিষ্ঠানটির একাধারে মূল সংগঠক, গায়ক ও একোস্টিক প্রকৌশলী। এনিগ্‌মা’র গানে এই ‘হোয়াই’ বা ‘কেন’ একটি সোচ্চারে উচ্চারিত প্রশ্ন। শেক্সপিয়ারের বড় আকারের প্রশ্নটির পরিসরের চেয়ে এক শব্দের ‘কেন’র পরিসর অনেক বড়। বাঁচতে চাইলে প্রশ্ন হতে পারে, কেন বাঁচব; মরতে গেলেও প্রশ্ন থেকে যায়, কেন মরবো? জগত থাকলে প্রশ্ন করা যায়, জগত কেন? কোন কিছু না থাকলেও প্রশ্ন করা যায়, কোন কিছু নেই কেন?(২) ঈশ্বরের বেলাতেও এ প্রশ্ন প্রযোজ্য, ঈশ্বর কেন? থাকেনই যদি তো একাই থাকতেন, জগত সৃষ্টি করে একটি ‘ভেজাল’ বাঁধাতে গেলেন কেন?(৩)

(২) কিছুই যদি না থাকতো তবে প্রশ্নটিও থাকতো না—একথা তো মানতেই হয়। তবুও আমরা যেহেতু আছি তাই সম্ভাব্য বিকল্প চিন্তা করে এই জগতেই প্রশ্নটা করতে পারি।

(৩) কোরানের ২:৩০ আয়াতে খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে মানুষ সৃষ্টির কথা আছে। সেখানে ফেরেশতারা এই সৃষ্টির বিরুদ্ধে ‘কেন’ প্রশ্নটি আল্লাহকে করেছিল। কোরানে প্রশ্নটি থাকলেও, ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, উত্তরটি নেই। আল্লাহ কেবল বলেছেন, “আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না।”

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন