Do to others what you would have them do to you, for this sums up the Law and the Prophets. (Gospel according to Matthew 7:12)
Stand out firmly with justice as witnesses for God, even if it be against yourselves or parents and relatives, be he rich or poor. (Koran 4:135)

মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩

আমাদের ইনোসেন্স

আমাদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি বলে একটি কথার বেশ চল আছে। একজন মুসলিম কারও জীবন, সম্পদ ও সম্মানে যেমন আঘাত করতে পারে না, তেমনই পারে না কারও ধর্মীয় অনুভূতিতেও আঘাত করতে। কিন্তু কথা হচ্ছে একজন মুসলিমের কি ধর্মীয় অনুভূতি বলে কিছু থাকতে পারে?—যে ধর্মীয় অনুভূতিতে অন্যে এত সহজেই আঘাত করতে পারে? এমন অনুভূতি যতদিন আমাদের মধ্যে কাজ করবে ততদিন বুঝতে হবে যে, আমরা নবীদের মানসিক দৃঢ়তা ও তাদের চিন্তার বলিষ্ঠতা আয়ত্ত করতে পারিনি।

এক ব্যক্তি নবীর বাড়ীতে এক বোতল মদ নিয়ে গিয়ে তা নবীকে উপহার দিতে চাইল। এতে নবী তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কি জান না যে আল্লাহ এটি আমাদের জন্য নিষিদ্ধ করেছেন? এই প্রশ্নটি এমন যার উত্তর দুটির একটি হতে বাধ্য—না অথবা হ্যাঁ। উভয় উত্তরই ব্যক্তিটির জন্য বিব্রতকর। সে যদি বলে “হ্যাঁ”, তবে তো সে নিজেই নিজের নিকট ধৃত অবস্থায় দেখতে পাবে। আর যদি হয় “না”—তবে, যদি সে ভদ্রলোক হয়ে থাকে তবে অজ্ঞতাবশত এ কাজ করার জন্য তাকে দুঃখিত হতেই হবে। আর যদি সে জেনেশুনেই তা করে তবে ‘না’ বলে যতই দুঃখ প্রকাশ করুক, সে যে মিথ্যাচারী তা তার নিজের কাছে আর অজানা থাকে না।

নবীর আমলে মসজিদে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা উদাহরণ হিসেবে আমরা উল্লেখ করতে পারি। জনৈক ব্যক্তি বিশ্বাসীদেরকে অপমান করার জন্য মসজিদে প্রবেশ করে স্বয়ং নবীর উপস্থিতিতে প্রস্রাব করে দিয়েছিল। এ দেখে কেউ কেউ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলে ও তাকে মসজিদ থেকে বের করে দিতে চাইলে নবী বলেছিলেন, তাকে শান্তিমত কাজটি শেষ করতে দাও। আগন্তুক তার কাজ শেষ করলে নবী তাঁর অনুসারীদেরকে বলেছিলেন মেঝেতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ঢেলে দিতে। প্রস্রাবকারীকে পরে তিনি শুধু বলেছিলেন, তুমি কি জান না এটি প্রস্রাব করার স্থান নয়?

নবীকে উপহাস করার কাজটি নতুন কিছু নয়। সকল নবীকেই স্ব স্ব সম্প্রদায়ের কাছ থেকে উপহাস পেতে হয়েছে। নবীর অনুসারীদেরকেও নিজেদের চোখ কান দিয়ে তা দেখতে শুনতে হয়েছে। কিন্তু তারা তা অবলীলায় উপেক্ষা করেছেন। নবীরা তাদেরকে তা উপেক্ষা করতেই শিক্ষা দিয়েছিলেন। নবীদের ও তাদের অনুসারীদের আত্মমর্যাদাবোধ এতো ঠুনকো ছিল না যে এতো সহজেই বা কেবল উপহাসেই তা ভেঙ্গে পড়তে পারে। উপহাসকারী নিজেকে এমন বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত করে যে সে বিশ্বাসীর মনোযোগ লাভের উপযুক্ততা হারায়।

নবীকে নিয়ে যারা উপহাস করে সিনেমা তৈরি করল তাদের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান যার ফলে তারা এবিষয়ে বিশ্বাসীদের মনোযোগ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে। এমন উপহাস বইয়ের মাধ্যমে বহু করা হয়েছে, করা হচ্ছে ইন্টারনেট ভিত্তিক ওয়েবে, এখন সিনেমার মাধ্যমে করলেই বা কি? যে ব্যক্তি এমন স্থূল চিত্রায়ন দেখে বিভ্রান্ত হয় সে আমাদের দলে না আসলেও আমাদের তেমন ক্ষতি নেই। আর যে হয় না সে আমাদের প্রতি বিরূপ হবে না। মানুষকে ধরে ধরে জান্নাতে নেয়ার কোন দায় তো আমাদেরকে কেউ দেয়নি। তার উপর আমরা কার কাছে প্রতিবাদ করছি? কার কাছে প্রত্যাশা করছি? আমাদের দেশের সরকারের এখানে করার কিছু নেই—ওরা আমাদের আইনের আওতায় নেই। আমেরিকা তোমার আমার বাসনামত বিচার করবে না—তার কাছে বিচার প্রত্যাশা করাটাও এরূপ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য করণীয় নয়।

আমরা আরও দেখলাম রাষ্ট্রদূতসহ কয়েকজন নিহত হলেন। যাদের নিরাপত্তা দেয়া আমাদের কর্তব্য ছিল, আমাদের অঙ্গীকারের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তারা জীবন হারালেন। নানা দেশে নিজেদের মানুষ নিহত হল, সম্পদ বিনষ্ট হলো। নবীর প্রতি যে ভক্তি, যে প্রীতি হেন পরিণাম এনে দেয় তা নবীদের শিক্ষার একেবারে ১৮০ ডিগ্রী বিপরীত দিকে চলার ফল। এটি একটি বিরাট অত্যাচার এবং নিজেদের দিক থেকে বৌদ্ধিক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক হীনমন্যতাবোধের চরম প্রকাশ। এহেন লজ্জাজনক দুষ্কর্মের পর বিশ্বের সামনে এখন আমাদের “পরের ভিক্ষা চাই না, নিজের দুর্বৃত্ত সামলাও” দশা হয়েছে। আমরাই আমাদের নিজেদের এবং নিজেদের ধর্মের প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছি। যারা এপথে মানুষকে ডাকে তাদেরকে উপেক্ষা করা, তাদের এরূপ ডাকে সাড়া না দেয়া এবং তাদের সম্পর্কে সতর্ক হওয়াও আমাদের আরেক কর্তব্য হয়ে উঠেছে।

গতবার যখন নবীকে নিয়ে ডেনিশরা কার্টুন আঁকল তখন আমি কানাডার কুইবেক সিটিতে। আমাদের প্রশিক্ষক ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল ও আন্তরিক মানুষ। হোটেলে কানাডীয় চ্যানেলের খবরে প্রথম শুনলাম কার্টুনটির কথা। এ নিয়ে আমাদের প্রশিক্ষকেরও আগ্রহ ছিল আমাদের সাথে ভাব বিনিময় করার। তিনি তাঁর নিজের গাড়ীটিতে করেই হোটেল থেকে আমাদেরকে তুলে নিয়ে যেতেন ফ্যাক্টরিতে। নিজেই ড্রাইভ করতেন। আমি বসতাম তাঁর পাশের সিটটিতে। একদিন তিনি আমাকে জানালেন, কানাডীয় মুসলিমরা একটি ডেমনস্ট্রেশনের আয়োজন করেছে। কিন্তু এতে আমার তেমন আগ্রহ না দেখে তিনি সরাসরিই প্রশ্ন করলেন: আচ্ছা তোমরা এতো হৈচৈ কর কেন? অন্যদেরও তো মত প্রকাশের অধিকার আছে। উত্তরে আমি বললাম, দেখ, তোমরা কোথায় কি কার্টুন এঁকেছ তা আমরা জানতাম না। সে পত্রিকায় প্রতিদিন কার্টুন আঁকা হয়। কোন কার্টুনের খবর টিভিতে আসে না। ওটার খবর তোমরা টিভিতে প্রচার করলে কেন? আমরা যে দেখিনি সেটা তোমাদের মনপুত হয়নি—তাই তোমরা আমাদেরকে একরকম জোর করেই দেখিয়েছ। কেন? তিনি বললেন, আমি ওভাবে আগে চিন্তা করে দেখিনি। মনে হয় তোমার পয়েন্টটা আমি ধরতে পেরেছি।

এরপর আমি তাকে অনেক কথা বললাম। তিনি গাড়ী চালাতে চালাতে মন দিয়ে শুনলেন। বললাম: দেখ, এখন তোমরা এগিয়ে আছ, মানবসমাজকে নেতৃত্ব দেয়ার সামর্থ্য তোমাদেরকে আল্লাহ দিয়েছেন। কাজেই তোমাদের দায়িত্ব বেশী—এটা তো তোমরা অস্বীকার করতে পার না। আমরা এই যে কষ্ট পাই, হৈচৈ করি তাও তো তোমরা জান। তবে আমাদেরকে কষ্ট দিতে চাও কেন? আজ থেকে ৫০০ বছর পর আমরাও হৈচৈ করব না। আমাদেরকে এগিয়ে আনার ক্ষেত্রে তোমরা কাজ করবে, আমাদেরকে সহায়তা করবে এটা কি কেউ আশা করতে পারে না? মধ্যযুগে তোমরা জঙ্গলে বাস করতে। জেরুসালেমে তোমাদের একটি গির্জা এক পাগল ফাতেমী শাসক ভেঙ্গে দিয়েছিল। কিন্তু সেজন্য তার উত্তরসুরী শাসক দুঃখিতও হয়েছিলেন। বাইজেন্টাইনদের তত্ত্বাবধানে ও কারিগরি সহায়তা নিয়ে গির্জাটি তিনি নতুন করে তৈরি করেও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই পাগল ও ব্যতিক্রমী শাসকের কাজটিকে অবলম্বন করে ক্রুসেডের নামে সভ্য জেরুসালেমে তোমরা মুসলিমদের মাংস রান্না করে খেয়েছ। তারপরও সেকালে এগিয়ে থাকা মুসলিমরা কি তোমাদের সাথে দায়িত্বহীন কাজ করেছে? সালাদিনকে তো তোমরা ভাল করেই চেন।

আমাদের প্রশিক্ষক বললেন, আমি তোমাদেরকে ভাল বুঝি। কারণ আমি শিক্ষক এবং আমার ছাত্রদের অনেকেই মুসলিম বিশ্বের নানা দেশ থেকে আসা। তবে তোমরাও ফাঁদে পা না দিতে শেখ। ওতেই তোমাদের কল্যাণ।

কেউ যদি আমার কোরান, আমার বাইবেল বা আমার গীতার কপিটি নিয়ে পুড়িয়ে দেয় তবে আমি কী করতে পারি? সেটি সংগ্রহ করতে আমার যে অর্থ খরচ হয়েছে তা আমি তার কাছে দাবী করতে পারি। আমার কপি পোড়ানোর অধিকার তাকে তো আমি দেই নি। কিন্তু যদি সে তার নিজের পকেটের টাকা খরচ করে পোড়ায় তাতে আমার কি আসে যায়? সে যত ইচ্ছা কিনুক আর পোড়াক—তার টাকা বা তার বাপের টাকা সে আগুনে দিল কি জলে ফেলল তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। কেউ যদি তার ঈশ্বরের সামনে, তার সমাজের প্রাজ্ঞজনদের সামনে নিজেকে বোকা বানায় তবে আমাদের তো কোন ক্ষতি হয় না।

সংস্কৃতির সূচক

একটি সমাজ সভ্যতা-সংস্কৃতির বিচারে কতটুকু উৎকর্ষতা অর্জন করেছে জেলখানা তার প্রকৃত সূচক হিসেবে কাজ করতে পারে। কোন সমাজের কারাগারের অবস্থা কিরকম, সেখানে অভিযুক্তদের সাথে, সাজাপ্রাপ্তদের সাথে কিরূপ আচরণ করা হয়, তা-ই সে সমাজের সাংস্কৃতিক উন্নতির মান নির্ধারণের মোক্ষম উপায়। একই কথা প্রযোজ্য ধৃত বিদেশী গুপ্তচর ও যুদ্ধবন্দীদের বেলাতেও। দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, বিজ্ঞান, ক্রীড়া এসব ক্ষেত্রে অর্জন সব বাদ দিয়ে জেলখানায় যাওয়া যেতে পারে একটি সমাজকে চেনবার জন্য।

কোরানে আমরা দেখতে পাই, আল্লাহ একদিকে মুসলিমদেরকে ভর্ৎসনা করছেন যুদ্ধে কৌশলগত ভ্রান্তির জন্য, আবার একই সাথে তাদের প্রশংসা করছেন নিজেরা না খেয়ে, নিজেদের খাবারের উত্তম অংশ যুদ্ধবন্দীদেরকে দেয়ার জন্য। আরেকটি উদাহরণ এখানে দেয়া যায়। নবীপত্নী আয়েশা আবু বকরের কন্যা। নিজ কন্যা, এবং নিজ জীবনের চেয়েও প্রিয়তর নবীর পত্নীর বিরুদ্ধে অপবাদ রটনায় অংশ নেয়ার কারণে যে মুসলিম কবি সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন তাঁকে প্রতিমাসে ব্যক্তিগতভাবে ভাতা হিসেবে অর্থ দিয়ে আসছিলেন আবুবকর। এ রটনার ঘটনা আয়েশাকে, নবীকে, আবুবকরকে এবং সমগ্র মুসলিম সমাজকে কতদূর বিব্রতকর অবস্থায়, মানসিক যাতনায় ফেলেছিল তা অনুমান করতে পারেন কি? এরূপ ঘটনার পর একজন পিতার মানসিক অবস্থা অনুমান করতে পারেন কি? এটা কতখানি কষ্টকর তা কন্যার পিতারা ভালই বুঝতে পারেন। কাজেই আবুবকর সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি তাকে এই ভাতা আর প্রদান করবেন না। কিন্তু আল্লাহ কোরানে এই সিদ্ধান্তকে অনুমোদন করেননি, বরং ভাতা প্রদান অব্যাহত রাখার আদেশ করেন। এই আদেশ সকল মুসলিমের জন্য প্রযোজ্য হয়ে আছে।

কোন সমাজটি উন্নত? যেখানে মানুষেরা শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনায় ব্যস্ত থেকেও সম্পদ, শিল্পকলায় উন্নত; নাকি যেটি শিল্পকলা, দর্শন, প্রযুক্তি ইত্যাদিতে পশ্চাৎপদতা সত্ত্বেও অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা, মমতা এবং তাদের মধ্যকার অপরাধীদের প্রতি মানবিক আচরণে শ্রেষ্ঠ?

মার্মাডিউক পিকথলের লেখা একটি প্রবন্ধে পড়েছিলাম ইংল্যান্ডের একটি জরিপের কথা। সেখানে একটি হাইপথেটিক্যাল সিচুয়েশন দিয়ে একটি সিদ্ধান্তের জন্য আবেদন করা হয়েছিল। অবস্থাটি ছিল এরূপ। মনে করুন একটি ঘরে আগুন লাগল যে ঘরটিতে একটি শিশু অবস্থান করছে ও একটি প্রাচীন গ্রীক ভাস্কর্য রয়েছে। ভাস্কর্যটি অনন্য ও নিপুণ যা পুড়ে গেলে আর কোনদিন তা বা তার মত আরেকটি পাওয়া যাবে না। কিন্তু আপনি এদের যে কোন একটিকেই কেবল রক্ষা করতে পারবেন। অবস্থা এমন যে, দুটিকে কোনভাবেই একসাথে রক্ষা করতে পারবেন না; একটিকে রক্ষা করতে এগোলে ততক্ষণে অন্যটি পুড়ে যাবে।

এই অবস্থায় আপনি কী সিদ্ধান্ত নেবেন? পশ্চিমা বিদ্বজ্জন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিকদের কাছে এর উত্তর চাওয়া হয়েছিল। তাদের বেশীর ভাগেরই সিদ্ধান্ত ছিল ভাস্কর্যটি রক্ষা করতে হবে। মানব শিশু প্রতিদিন গণ্ডায় গণ্ডায় জন্মায় এবং প্রতিটি মানুষ স্বল্পকাল মাত্র বেঁচে একদিন না একদিন মারা যায়। কিন্তু ভাস্কর্যটি, যেটির কোন বিকল্প নেই, মানবজাতির অমূল্য সাংস্কৃতিক অর্জন যা টিকে থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম, মানবজাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে। আজ আমি বা আপনি হয়তো চট করে বলে দেব, না! আমরা শিশুটিকেই রক্ষা করব, চুলায় যাক ভাস্কর্য। কিন্তু সমগ্র বিশ্বের সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড কি ভিন্ন কথা বলে না?

এবার আমি মুসলিমদের জন্য একটি হাইপথেটিক্যাল সিচুয়েশন দেই। মনে করুন একদল ইসলাম-বিদ্বেষী কাবা ঘর ধ্বংস করতে একত্রিত হয়ে অগ্রসর হচ্ছে। অন্যদিকে, একদল মুসলিম কিছু খৃস্টান বা ইহুদির একটি কাফেলাকে হত্যা করে তাদের সম্পদ ছিনতাই করতে এগোচ্ছে। আপনার হাতে কেবল এতটুকু শক্তি ও সুযোগ রয়েছে যা দিয়ে যে কোন একটি অপরাধী দলকে বিরত করতে সক্ষম হবেন। এখন আপনি কী করবেন? কাবা রক্ষা করতে যাবেন? নাকি খৃস্টান বা ইহুদি রক্ষা করতে যাবেন? হয়তো এখানেও আমরা দ্বিতীয় বিকল্পটির পক্ষেই কথা বলব। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। ভারতের হিন্দুরা মসজিদ ভেঙ্গে দিলে বাংলাদেশের হিন্দুরা শঙ্কিত হয়ে উঠে, এমনকি আক্রান্তও হয়।

কোরানে ‘মুহম্মদ’ নামটি এসেছে চারবার, তাঁর আরেক নাম ‘আহমদ’ এসেছে একবার। কোরানে নবীর সমসাময়িক আর কোন মুসলিমের নাম আছে কি? কোরানে আবুবকর বা আলীর নাম আপনি খুঁজে পাবেন না। কেবল মাত্র একজনের নামই পাবেন। তিনি যায়েদ। কিন্তু যে প্রসঙ্গে যায়েদের নাম এসেছে, প্রাসঙ্গিকতা থাকা সত্ত্বেও ‘অভিজাত’ জয়নবের নামটি কিন্তু সেখানে আসেনি। এই যায়েদ নবীর মুক্ত ক্রীতদাস যাকে তিনি পরে পালক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। যায়েদ বলেন যে, গৃহস্থালি কোন কাজে নবী তাকে কখনও বলেননি, তুমি এটা কেন করলে বা ওটা কেন করলে না। নবী ‘উহ’ শব্দটিও কখনও করেননি। কেন নবী এমনটি করেননি? বা করতেন না? আমার ঘরের কাজের মেয়েটি একটি বাসন ভেঙ্গে ফেলল আর অমনি তাকে আমি কথায় অপমান করে বসলাম, বা আরও এগিয়ে নির্যাতন করলাম। এতে প্রমাণ হলো যে, আমি মনে করি আমার মর্যাদা কাজের মানুষটির মর্যাদার চেয়ে বেশী; এবং কেবল তা-ই নয়, আমার কাছে বাসনটির মূল্য মানুষটির বা তার মর্যাদার চেয়েও বেশী।

এক “আগের কালের চিন্তা অনুসারে অভিজাত” আরব গোত্রপতি আবু যর এবং এক কালের ক্রীতদাস আবিসিনিয় কৃষ্ণাঙ্গ বেলালকে নিয়ে ঘটনা। কোন বিষয়ে তাদের আলোচনা বিতর্কের রূপ নেয়। এতে এক পর্যায়ে আবু যর বলে বসলেন, “কৃষ্ণাঙ্গ নারীর পুত্র, এটা বুঝা তোমার সাধ্যে নেই।” নবী একথা শুনে আবু যরকে বলেছিলেন, “তোমার চিন্তা এখনও ঝুলে আছে অজ্ঞতার কালের গর্ভে।” পরে আবু যর বেলালের বাড়ী গিয়ে মাথাটি মাটিতে রেখে বেলালকে বলেছিলেন, “বেলালের পবিত্র পা যতক্ষণ না এই বোকা, উদ্ধত আবু যরের মাথাকে দলিত না করছে ততক্ষণ এ মাথা মাটি থেকে উঠবে না।” বেলাল এতে রাজী হচ্ছিলেন না। কিন্তু জেদের তীব্রতা দেখে বেলাল এক সময় বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য আলতো ভাবে তার পা আবু যরের মাথায় স্পর্শ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ঘটনা সত্যই হোক আর মিথ্যাই হোক, এতে যে মানুষের প্রকৃত ধর্মের মর্মকথাটি উঠে এসেছে তাতে সন্দেহ নেই।

কারও পঞ্চাশ লক্ষ টাকার গাড়ীতে রিকশাচালক আঁচড় কেটে দিল বা বডিতে বড়সড় একটা ট্যাপ খাইয়ে দিল। আর অমনি তাকে বকা ও গালে চড় লাগিয়ে দেয়া হল। এতে প্রমাণিত হল, গাড়ীর মূল্য রিকশাচালকের সম্মানের চেয়ে বেশী বলে গাড়ীর মালিক মনে করেন। গাড়ীর মালিক ক্ষতিপূরণ চাইতে পারেন। পুলিশের কাছে গিয়ে নালিশ করতে পারেন। কিন্তু রিকশাচালকের সাথে এমন আচরণ করতে পারেন না যা এটি প্রকাশ করে যে, গাড়ীর মালিকের চিন্তায় রিকশাচালক তার থেকে মর্যাদায় ছোট বা রিকশাচালকের মর্যাদা গাড়ীর মূল্যের চেয়ে কম। এমন মন নিয়ে গাড়ীতে বসে আমি যতই কোরান তেলাওয়াত শুনি না কেন অথবা রবীন্দ্রসঙ্গীতই শুনি না কেন, তাতে আমি ধার্মিক হলাম, সভ্য হলাম, সংস্কৃতিমনা হলাম ভাবলে নিজের সাথে নিজে কেবল প্রতারণাই করলাম।

চিন্তকদের কর্তব্য

মাছের পচন ধরে মাথা থেকে। সমাজের পচন ধরে চিন্তকদের বিচারে ভ্রান্তি, পক্ষপাত ও দ্বৈতনীতির কারণে। চিন্তক বলতে আমি তাঁদেরকে বুঝচ্ছি আমাদের সমাজে সাধারণত যাঁদেরকে বুদ্ধিজীবী বা চিন্তাবিদ বলা হয়ে থাকে। এই চিন্তকদের মধ্যে পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, দার্শনিক, কবি, সাহিত্যিক, সংবাদপত্রের সম্পাদক, শিল্পী ও তাঁদের মত ব্যক্তিবর্গকে। একটি সমাজের মানুষেরা ভুল করতে পারে, রাজনীতিবিদেরা ভুল করতে পারে। কিন্তু চিন্তাবিদেরা সমাজের জাগ্রত অভিভাবকের মত তাদের ভুলগুলিকে ধরিয়ে দেবেন, কেন সেগুলো ভুল তা ব্যাখ্যা করবেন এবং মানুষকে সঠিক পথের দিশা দিয়ে ফিরে আসতে উদ্বুদ্ধ করবেন। এই গুরুদায়িত্ব তাঁদের দ্বারা পরিত্যক্ত হলে সমাজ হারায় পথের দিশা, হারায় কাণ্ডারি।

আমাদের সমাজের অবস্থাটি কী? এখানে সংকীর্ণ রাজনৈতিক বলয়ে বিভক্ত হয়েছে কেবল সাধারণ মানুষেরাই নয়, সমাজের অভিভাবকরাও। কিন্তু চিন্তকের চিন্তা ও কথার মধ্যে নিজ রাজনৈতিক মতের, সেই মত অবলম্বনকারী রাজনৈতিক দলের প্রতি নির্বিচার পক্ষপাত থাকা সমাজের জন্য মঙ্গলজনক হয় না। সমাজে যদি একটি অত্যাচারের, নিষ্ঠুরতার, অমানবিকতার ঘটনা সংঘটিত হয় তবে দলমত নির্বিশেষে মিলিতভাবে নিন্দা করাই তাঁদের কর্তব্য। কিন্তু দেখা যায়, নিন্দা যাদের জন্য সুবিধা প্রদায়ী হয় তারাই কেবল নিন্দার ঝড় তোলেন। নিজের অনুসারীর গায়ে আঁচড়টিও আমরা সহ্য করি না, কিন্তু প্রতিপক্ষের কাউকে নির্মমভাবে আঘাত করার দৃশ্য দেখেও নীরব হয়ে থাকি। এনীতিকে অনেকে আক্ষেপ করে অভিহিত করে থাকেন রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি হিসেবে।

এ অবস্থানের পিছনের চিন্তাটি কী? আমরা নানা মতে বিভক্ত হয়েছি। কিন্তু এটি তো স্বাভাবিক। এতে অসুবিধার কিছু তো ছিল না। অসুবিধা হয়ে দাঁড়ায় যখন আমরা এই সিদ্ধান্ত নেই যে, মতের সাথে মতের এই বৈপরীত্য নিছক মতের বৈপরীত্য মাত্র নয়, এটি রীতিমত যুদ্ধাবস্থা; যদি প্রতিপক্ষকে সমূলে উৎখাত করা যায়, বিনাশ করা সম্ভব হয় তবেই কেবল সমাজের, জাতির অগ্রগতি সম্ভব। এজন্য সকল পন্থা অবলম্বন করাকে বৈধ মনে করা হয়। গণতন্ত্র, মূল্যবোধ, মানবতা, প্রগতি—এসব মহান ধারণা ও আদর্শ রাজনৈতিক সংগ্রামের হাতিয়ারে পরিণত হয়।

এই রকম অবস্থা যে মনোভাবের উন্মেষ ঘটায় তা অত্যন্ত ভয়াবহ—এ মনোভাব থেকেই তৈরি হয় উগ্রপন্থা; অনুমোদন পায় উগ্রপন্থা। সমাজের সার্বজনীন ও সর্বকালীন মূল্যবোধগুলো সম্পূর্ণ ধ্বসে পড়ে। এপথে কেয়ামত তক দৌড়ালেও উন্নতি হবে না। এই মনোভাব নিয়ে প্রাথমিক সফলতা হিসেবে যদি আজকের প্রতিপক্ষকে সম্পূর্ণ বিনাশ করাও সম্ভব হয় তবুও না। একসময়ের একমতাবলম্বীরা তখন এমিবার মত বিভাজিত হবে এবং বিনাশের যুদ্ধের প্রয়োজন আবার দেখা দেবে। এ যুদ্ধের অবসান কখনই হবে না।

সে মানুষটিও অনেক ভাল যে অন্যায় করেও সেটিকে অন্যায় মনে করে; জিজ্ঞেস করলে কাজটিকে সে অন্যায় বলেই স্বীকার করে। কিন্তু চিন্তকরা যখন নিজের মতের অনুসারীদেরকে যুদ্ধংদেহী করে তোলেন ও তাদের অন্যায়-অবিচার-অত্যাচারকে সবাক হয়ে বা মৌন থেকে অনুমোদন দেন তখন সমাজ কেবল বিশৃঙ্খলই হয়ে উঠে না, মূল্যবোধেরও পতন ঘটে। তখন অন্যায় করেও একজন নিজেকে ন্যায়ের আপোষহীন যোদ্ধা মনে করে বসে।

চিন্তাবিদদের প্রধান কর্তব্যই হচ্ছে নিজ মতের অনুসারীদের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখা ও তাদেরকে সঠিক পথের নির্দেশনা দেয়া, নিজের কোন অনুসারীকে অন্যায় করতে দেখলে তার প্রতি বিরক্তি ও কঠোরতা প্রদর্শন করা, তাকে সর্তক করা। কোন আদর্শের অভিভাবকবৃন্দ যখন তাদের অনুসারীদেরকে প্রতিপক্ষের দুর্গের দিকে চালিত করতেই কেবল সক্ষম হন, কিন্তু নৈতিকভাবে গড়ে উঠার জন্য আবেদন করে কোনরূপ সাড়া পেতে কেবলই ব্যর্থ হন, তখন অভিভাবকদের কর্তব্য হয় নিজেদের দিকে ফিরে তাকানো।

যোদ্ধা তৈরি করা সেনাপতিদের কাজ। চিন্তাবিদদের কাজ মূল্যমান ও মানবতা সংরক্ষণে নিরপেক্ষভাবে ও জোরালোভাবে কাজ করে যাওয়া।

কথাহীনতার বর্ণালী চাদর

হতাশার কালে জ্বরের কবলে পড়ার ফল ভাল হয় না। মনটা যখন নানা দুর্ভাবনায় আক্রান্ত হয়ে হয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হতে থাকে, ঠিক তখনই যদি সমান্তরালভাবে শরীরটাও আক্রান্ত হয় ভাইরাসে তখন মনোবিকলনের বুঝি ষোলকলা পূর্ণ হয়। আশার সোনালী আলোরা যখন একে একে নিভতে থাকে, দুরাশার হলুদ ফুলঝুরিতে যখন আকাশ আসন্ন অন্ধকারের সংকেত হয়ে উঠতে থাকে, ঠিক তখনই যদি বিস্বাদের বশে অনাহারে থাকতে হয়, তবে বস্তুর জগত আর ভাবের জগতের ইন্টারফেসটি বুঝি গোলমেলে হয়ে যায়।

কয়েক কাল অনেক কাল। সেদিনও নদী ছিল জলে ভরা, মাছে ভরা। সেদিন যারা সাঁতার কেটেছে মনের আনন্দে, মাছ ধরার উৎসব করেছিল উজানের পরিষ্কার জলে, আজ তারা কোন পারে বসে আছে মুদ্রিত নেত্রে নীরবে কে জানে। নদীতে পানিরা থাকতে চায় না আর, মাছেরা মুখ ভার করে খোঁজে ভাটার টান। যখন ভরা নদীর জল উবে হাওয়া হয়, তখন কি নদীর পারে বসে খরার গতি দেখে কপোলে হাত অসহায় মাঝিদের দল? কোন পাড়ে বসে থাকে তারা? যে গাঙ্গে জল নেই তার এপার কী আর ওপারইবা কী—ভাবে অনিকেত দৃষ্টির মাঝিরা।

নদীরা বুঝি একা থাকে না। জোড়ায় জোড়ায় জন্মায়, ছুটে যুগলভাবে সমান্তরালে। একটি যদি জলের অভাবে মরে, অন্যটি তবে জলের ভারে আতঙ্কিত করে তোলে তটবাসীকে। একে একে ইলিশেরা উঠে আসে দূরের সাগর থেকে। তাদের পেট বোঝাই স্বপ্নের রেণু। যারা ক’দিন আগেও উচ্ছ্বাসে ছিল আপনহারা, আজ তারাই দেখে ভিন নদীতে রেণু প্রসবের মহোৎসব। যারা গেল মৌসুমে জলের দেখা পায়নি আজ তারাই পিঠে সোনালি রোদের ঝিকিমিকি ছড়িয়ে মোহনীয় সাঁতারে মেতে উঠে ডলফিনদের মত।

মন ক্রমেই ভারি হয়ে উঠে, বাইরের বাতাসটাও ভারি। যে কীটদের আমি লালন করি আজ রাবণকে বধিবার তরে, সে কীটের বশেই কাল নিহত হয় রাম আমারই হাতে, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে। যে পিরামিড আমি গড়ি মানুষের কংকালের সুরকিতে, তা-ই একদিন সাড়ম্বরে ভেঙ্গে পরে আমার কঙ্কালের পরে। তুমি কি দেখেছো কোন দিব্যকান্ত অন্ধকারকে দীর্ণ করেছে কৃষ্ণগহ্বর দিয়ে? ভয়ংকর হুতাশনে কণিকারা সব পতঙ্গেরর মত আছড়ে পড়ে যে গহ্বরে, তা থেকে কোন তথ্য আলোর কণা হয়ে এসে পড়ে না তৃষিত মানুষের চোখে।

আমি অসুর হয়ে মুখে বাঁশি নিয়ে বৃথাই রুপালী জোছনার প্রতীক্ষায় কাল কাটাই। আমি নির্ভীকের মত তাই উচ্চারণ করতে চাই, “আমি উচ্চারণ করতে ভয় পাই।” আমি নির্লজ্জের মত তাই উচ্চারণ করতে চাই, “আমি উচ্চারণ করতে লজ্জা পাই।” আমি সাহস চাই না, আমি লজ্জা পাই না। আমি সাহস পাই না, আমি লজ্জা চাই না। কথাহীনতার বর্ণালী চাদর! তুমি নেমে এসো ধরণীর পর।

নখ ছোট রাখার ফজিলত

নিয়মিত কেটে সবসময় নখ ছোট রাখার অনেক ফজিলত। তাই আমি সময়মত নখ কাটি। ডাক্তাররা নখ ছোট রাখতে বলেন এতে পরিষ্কার থাকা যায় বলে। নখ ছোট থাকলে খাবারের সাথে ময়লা পেটে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে, সুস্থ থাকার সম্ভাবনা বাড়ে। তাছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিজে থেকে এমনিতেই মূল্যবান। পরিচ্ছন্নতার সাথে নান্দনিকতার সম্পর্ক আছে। অর্থাৎ নখ ছোট রাখলে থাকার মধ্যে সুন্দরের একটি উপাদান যুক্ত হয়। খাবারের জন্য চিল-শকুনের মত মানুষের বড় নখের প্রয়োজন পড়ে না। তাই নখের অনাবশ্যক অংশ ছেঁটেছুটে পরিপাটি হয়ে অতি সহজেই আমি নিজেকে চিল-শকুন থেকে আলাদা করে ফেলতে পারি।

নবীও তার অনুসারীদেরকে নখ ছোট রাখার উপদেশ দিতেন। মুসলিমদের অনেকেই শুক্রবার জুম্মার নামাজে যাওয়ার আগে নখ কেটে পরিপাটি হন। তারা একেবারে যাকে বলে ধুলোয় লুণ্ঠিত হয়ে নিজেদেরকে ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করে থাকে। অর্থাৎ তারা নামাজ পড়ে। এই নামাজের জন্য প্রস্তুত হতে অজু করতে হয়। নখ বড় থাকলে অজু কিছুটা দুষ্ট হয়ে পড়ে যদি নখের ভেতর ময়লা থেকে যায়। ঈশ্বরের কাছে যাবো বড় বড় নখ নিয়ে! তাই কি হয়? তাছাড়া লাভ কী বলুন। নখের জোরে তো আর ঈশ্বরকে পাবো না। ঈশ্বর সুন্দর, তাই তাঁর সামনে সুন্দর হয়েই যেতে হয়, সুন্দর হয়েই থাকতে হয়। শয়তানের মত সেজেগুঁজে তো আর যা-ই হোক ঈশ্বরের উপাসনা করতে পারি না!

নখ ছোট রাখার একটি গোপন ফজিলতও আছে। জ্ঞানীরা মুখ ফুটে বলেন না বলেই এটি গোপন হয়ে আছে। আমার তো আর মুখে কুলুপ এঁটে থাকার জন্য দরকারি পরিমাণ জ্ঞান নেই। কাজেই বলতে দোষ কী? আমি সবসময় ক্রোধকে সম্বরণ করতে পারি না। ফলে যাকে শত্রু বলে মনে হয় তাকে খামচি দিয়ে বসি। পড়শিরাও এ থেকে রক্ষা পায় না। নখটা ছোট থাকলে এখানেও উপকার পাওয়া যায়। আক্রান্তের চোটটা কম লাগে। এতে আরও যে ফলটা পাওয়া যায় তা হলো, পরে জ্ঞান ফিরে আসলে, যখন ক্ষমা চাইতে যাই তখন লজ্জাটা খানিকটা কম পেলেও সেজন্য আমাকে ক্ষতির মধ্যে পড়তে হয় না।

যারা বন্ধুর মঙ্গলের জন্য ভেবে ভেবে হয়রান তাদের অনেকেই মনে করে থাকতে পারেন, আমার এই নখ ছোট রাখার তত্ত্বটা আখেরে শত্রুর কাজেই লাগে। শত্রুর ভাল নিয়ে অত ভাববার মুরদ আমার কই! আমার এ তত্ত্বের পেছনে আছে আমার বন্ধুর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার ফিকির। আজ না হয় শত্রুর মুখ গেল, পড়শির মুখ গেল। কিন্তু অভ্যস্ত নখের স্বভাবটা যে নর-মাংসের স্বাদ পাওয়া বাঘের স্বভাবের মত। একবার অভ্যাস হয়ে গেলে বাঘ শুধু মানুষ খুঁজে আর নখ খুঁজে মুখ। কাল শত্রুর অভাবে, পড়শির অভাবে মুখ পাওয়া না গেলে আমার আজকের বন্ধুর মুখের গতি কী হবে?

নখ ছোট রাখার মধ্যে এতো ফজিলত থাকায় আমি নখ ছোট রাখি। যদিও ছোট রেখেও তার ফজিলত হাসিল করার ভাগ্য আমার কমই হয়। এটা আমার নির্বুদ্ধিতার ফল। এতে আপনার বিচলিত হওয়ার কোন কারণ নেই। আপনি তো আর আমার মতো নন।

কাজেই নখ ছোট রাখুন, নিজে সুস্থ থাকুন এবং বন্ধুর ভবিষ্যতকে নিরাপদ করুন।

[যারা নখ ছোট রাখেন তাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটানোর জন্য দুঃখিত। তবে পড়তে পড়তে এতদূর এসে পড়ার বোকামিটা যখন করেই ফেলেছেন তখন, সবিনয় আরজ, আমার আন্তরিক ধন্যবাদটুকু আপনার সাথেই থাকুক।]

এমনটি হলে কেমনটি হতো!

আকসার নভেল-কবিতা পড়ুয়াদের মধ্য থেকে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ না-পড়া অভাগাদের বাদ দিলে যারা বাকী থাকে তাদের হয়তো মনে আছে, গল্পগুচ্ছের কোন এক গল্পের কোন এক চরিত্রের বাস ছিল ‘হইলে হইতে পারিত’র দেশে। আমরা কেউ কেউ বাস করি টোকামাত্রই ভেঙ্গে পড়ে এমন সহস্র ললিত-তনু স্বপ্ন নিয়ে। আবার কেউ কেউ আছি যারা আকাশের দিকে পাখা মেলার চেষ্টা করা দূরে থাক, প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি মুহূর্তের জন্যও পা’টিকে মাটির উপরে তুলে রাখতে অনিচ্ছুক। এই দুইয়ের জগতের মাঝের জগতটিই হলো আমাদের ‘হইলে হইতে পারিত’র জগত।

ইদানীং আমি এই ‘হইলে হইতে পারিত’ নামের ‘আলম-এ-বরজখ’ এর বাসিন্দা হয়ে উঠছি। এখানে যেন সবকিছুই শর্ত-সাপেক্ষ, যেভাবে কম্পিউটার প্রোগ্রামার’রা শর্তের পর শর্ত জুড়ে দিয়ে রুটিনগুলোকে নানামুখী করে তোলে। এমনটি হলে কেমনটি হতো—এই চিন্তা যেন আমাকে গিলে খেয়েছে, যেভাবে প্রেমে পড়া উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা নাওয়া-খাওয়া মাচায় তুলে এক চিন্তায় বিভোর থাকে। ‘এমনটি’ ও তার জন্য সম্ভাব্য ‘কেমনটি’ নিয়ে আমার এখন বিভোর দশা।

***

দেশটি ভাগ হয়ে গিয়েছে—মনের দিক থেকে, যদিও জমির দিক থেকে নয়। বিভাজন এতদূর গিয়ে ঠেকেছে যে আত্মপরিচয়ের সন্ধানে দিনের বেলাতেও নামতে হয় ডায়োজিনিসের মত লণ্ঠন হাতে। জাতীয়তার প্রশ্নে, পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে, সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নে আমরা আধাআধি বিভক্ত হয়ে পড়েছি। এতো বড় বিভাজন নিয়ে একটি জাতিসত্তা কিরূপে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিবর্তিত হতে পারে সে-পন্থা অন্বেষণে সফল হওয়া দুরূহ। উভয় পক্ষের দাবী অপর পক্ষের অস্তিত্ব অধ্যাস বা মরীচিকার উপর প্রতিষ্ঠিত। দুপক্ষই অপর পক্ষের বিনাশকে সময়ের ব্যাপার বলেই বিশ্বাস করেন এবং সময়ের গতিতে ত্বরণ আনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগগুলো অবলম্বন করেন। এই বিনাশকামী পাল্টাপাল্টি অবস্থান রীতিমত উগ্র বাক্য, পেশী, কৌশল ও অস্ত্রের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। প্রত্যেকের মুখেই ‘আমি কী করব, ওর জন্যই তো কিছু করা গেল না’ প্রাত্যক্ষণিক জপ হয়ে আছে।

কিন্তু এতো বড় খণ্ড কী করে ভিতবিবর্জিত ও মরীচিকাবৎ হয় তার বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা কোথায় পাওয়া যাবে? সমন্বয়ের কোন পথ আছে কিনা এবং সেটি খতিয়ে দেখা যেতে পারে কিনা—এসম্ভাবনাও পরিত্যাজ্য হবে কেন? সে যা-ই হোক, এরকম একটি ব্যর্থ ও শুষ্ক রম্য রচনায় ভারী কথা বিরসে বিঘ্ন ঘটায়। তাছাড়া দুপক্ষের মুখোমুখি অবস্থানের জেদ আশু অপসৃত হওয়ার কোন লক্ষণ দৃশ্যমান নয় বিধায় এবং বিরোধ বিলোপের আশা অনেকের কাছে আসল মরীচিকা বলে সাব্যস্ত হয়ে আছে বিধায়, বাস্তবতার আলোকে ‘এমন হলে কেমন হতো’ প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক।

মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, দেশটিকে পূর্ব-পশ্চিমে সমান দুভাগে ভাগ করে দেই। রাজমিস্ত্রিরা যেভাবে সুতো টেনে ইট গাঁথে সেভাবে ইয়া লম্বা এক সুতো উত্তর-দক্ষিণে টেনে সীমানাটা এঁকে দেই। তারপর একটা এক্সোডাসের তোলপাড় বাঁধিয়ে দিয়ে বলি, নিজ নিজ খায়েশ মতো এবার তোরা এদিক ওদিক যা। দুপক্ষকে দুটি দেশ দিয়ে দেখতে ইচ্ছে হয় কারা ক’বছরে কতটুকু উন্নতি করে। তবে এখানেও বিপত্তি থাকবে না কেন? এ যদি বলে আমি এভাগ নেব, তো সে বলবে আমারও যে ওটাই চাই। কিন্তু মীমাংসার পথ যে একটি নেই তা কিন্তু নয়।

দেশ দুটির একটির নাম হোক পশ্চিম বাংলাদেশ ও অন্যটির পূর্ব বাংলাদেশ। আমাদের বিবেচ্য এক পক্ষ অপর পক্ষকে অভিহিত করে থাকে ভারতের দালাল বলে; আর অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাকিস্তানের দালাল হওয়ার। এখানেও ডায়োজিনিসের লণ্ঠন হাতে দিনে-দুপুরে বাংলাদেশের দালাল বৃথাই খুঁজে বেড়ান বলে অনেককেই আক্ষেপ করতে শুনেছি। বিবদমান দু’পক্ষের স্বপক্ষের দাবীতে যখন মীমাংসা অসম্ভব হয়ে ওঠে তখন বিপক্ষের দেয়া ইলজামের ভিত্তিতে মীমাংসা সম্ভব হয়। যেহেতু এক ভাগের নামে পশ্চিম বঙ্গের ‘পশ্চিম’ ও অন্যভাগের নামে পূর্ব পাকিস্তানের ‘পূর্ব’ থাকছে এবং যেহেতু ‘নামে নামে যমে টানে’ বলে একটি কথা আছে, সেহেতু কোন পক্ষ পশ্চিমে যাবে আর কোন পক্ষ যাবে পূবে তা আপনি এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঠাহর করে ফেলেছেন।

আমরা কোন কোন দেশের নামে ‘নিউ’ শব্দটি শুনি; কোন কোন শহরের নামেও শব্দটি দেখতে পাই। নিউজিল্যাণ্ড, নিউগিনি ইত্যাদি দেশের নাম আর নিউইয়র্ক, নিউজার্সি বা নিউহ্যাম্পশায়ারের মত শহরের নাম আপনারা প্রায়শই শুনে থাকেন। আমার এই পূর্ব-পশ্চিম নাম ভাল না লাগলে তারা নিজ নিজ দেশে গিয়ে দেশের নাম ‘নিউইন্ডিয়া’ ও ‘নিউপাকিস্তান’ এবং রাজধানীর নাম ‘নিউনিউদিল্লী’ ও ‘নিউইসলামাবাদ’ রেখে দিতে পারেন। তোর দেশ তুই বুঝ—এই স্বাধীনতা তাদেরকে দিয়ে চলুন আমরা একটি গল্প দিয়ে পড়ার ইতি টানি।

***

তিন হাজার বছর আগের কথা। গঙ্গার তীরে কোন এক মহীরুহের শীতল ছায়ায় কোন এক ঋষি মুদ্রিত নেত্রে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। হঠাৎ পূর্ণিমার চাঁদের আলোর স্নিগ্ধতায় চারপাশ আপ্লুত হয়ে উঠলে ঋষি চোখ মেলে চাইলেন। দেখলেন এক জ্যোতির্ময় দেবতা তার দিকে চেয়ে যেন প্রতীক্ষা করছেন। আগমনের উদ্দেশ্য অবগত হয়ে ঋষি দেবতা সমভিব্যাহারে যাত্রা করলেন আকাশ-পাতাল ও স্বর্গ-নরক পরিভ্রমণে। যা কিছু অপস্রিয়মাণ ও ক্ষণস্থায়ী তা কিছুর প্রতি ঋষির আকর্ষণ স্বল্প হওয়ায় তিনি দ্রুততার সাথে আকাশ-পাতাল ভ্রমণ সাঙ্গ করে স্বর্গ-নরকের অভিমুখী হলেন। মানুষের সুখের দৃশ্য যতটা আনন্দদায়ক তার চেয়ে অনেক বেশী বেদনাদায়ক মানুষের দুঃখের দৃশ্য। কাজেই ঋষি স্বর্গ পরিদর্শনের সময়ও সংক্ষিপ্ত করলেন।

নরকে গিয়ে দেখা গেল সেখানে প্রজ্বলিত চুলার উপরে বিশাল বিশাল সব কড়াই। প্রতিটির গায়ে লেখা আছে কোন না কোন জাতির নাম। এই যেমন আমেরিকান, ইংলিশ, আরব, পার্শি ইত্যাদি। প্রতিটি কড়াইয়ের চারপাশে মুগুর-হস্ত দেবতারা প্রহরায় নিয়োজিত, যেন কোন দুরাচারী কড়াইয়ের ঢাকনা সরিয়ে বেরিয়ে আসতে না পারে। এমন যেকোনো প্রচেষ্টার সূচনাতেই প্রহরী দেবতাগণ তা নিষ্ফল করে দিচ্ছিলেন।

যথানিয়মে একটি কড়াইয়ের গায়ে লেবেল আঁটা ছিল ‘বাঙালী বা বাংলাদেশী, যার যার বিশ্বাসমত’। কিন্তু কড়াইয়ে না ছিল ঢাকনা, না ছিল তাকে ঘিরে প্রহরীর অবস্থিতি। এতে সবিস্ময়ে কিন্তু তুষ্টচিত্তে ঋষি গাইড-দেবতাকে বললেন, “আহ, কিঞ্চিত শান্তি পেলাম এই দেখে যে তাদের কাউকে এখানে আসতে হয়নি।” একথায় দেবতা দুঃখিত বদনে ঋষিকে কড়াইয়ের কাছে গিয়ে ভেতরের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার অনুরোধ করলেন। তিনি দেখলেন। সেখানে লোকের সংখ্যা কম নয়। তবে একজন যদি কড়াইয়ের বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কিছুটা সফলকাম হয়ে উঠে তখন তার নীচের অন্যরা তার পা ধরে টেনে হিরহিরিয়ে তাকে নিজেদের মধ্যে নামিয়ে আনে।

বিষণ্ণ মনে দেবতা বললেন, “হুজুর, এই হচ্ছে অবস্থা। অন্য জাতিগুলোর বৈশিষ্ট্য এরকম যে, কেউ বেরিয়ে আসতে চাইলে নীচেরগুলো তাকে ঠেলে উপরে উঠতে সাহায্য করে। তাই ঢাকনা ও সদাসতর্ক প্রহরী। কিন্তু ইনাদের বেলায় সেরকম কোন আয়োজন নিষ্প্রয়োজন বিবেচিত হয়েছে। ইনারা নিজেরা নিজেরাই জাহান্নামের আগুনে জ্বলে-পুড়ে মরছেন।”

ভারাক্রান্ত হৃদয়ে গঙ্গার তটে ফিরে সেই মহীরুহের নীচে বসে ঋষি পুনরায় নেত্র মুদ্রিত করলেন।

আত্মহন্তার আর্তনাদ

যদি লিও টলস্টয়ের এ্যানা কারেনিন পড়ে থাকেন তবে দেখেছেন আত্মহত্যার বর্ণাঢ্য চিত্র। এক ডাক্তার আত্মীয়ের কাছে শুনেছিলাম আত্মহত্যার শারীরবৃত্তীয় ব্যাখ্যা। কিন্তু যারা ঘরে বসে চিন্তার পাহাড় গড়েন, সে দার্শনিকেরাও বিষয়টিতে ভাগ না বসিয়ে অন্যের জন্য পুরোটা ছেড়ে দিতে রাজী হননি। আপনি আলবেয়ার কাম্যু বা ফ্রাঞ্জ কাফকা’র নাম শুনে থাকবেন বা তাদের বই পড়ে থাকবেন। এ দুই দার্শনিক একমত। জগতের উৎপত্তি বা প্রকৃতির স্বরূপের সমস্যা নয়, জ্ঞানের সমস্যা নয়, নৈতিকতার সমস্যা নয়, নান্দনিকতার সমস্যা নয়, দর্শনের প্রধান সমস্যা নাকি আত্মহত্যার সমস্যা। যে পণ্ডিত বেঁচে থাকার যুক্তি দিতে পারেন না তার পাণ্ডিত্য যেন আখেরে ষোল আনাই কেবল ঝুলন্ত উদ্যান। টলস্টয়ের এ্যানা কোন গ্রন্থির অতিরিক্ত রস নিঃসরণের কারণে বা কোন জীবন-জিজ্ঞাসার উত্তর না পেয়ে নিজেকে রেলগাড়ির নীচে ওভাবে ছুঁড়ে দিয়েছিল কে জানে!

মানুষ একা একা নিজেকে হত্যা করতে পারে। শুনেছি পাখিরা নাকি একবার কবে পুরো ঝাঁকে নিজেদেরকে মেরে ফেলেছিল। তবে মানুষ দু’য়ে দু’য়েও এভাবে মরতে পারে। একই নারীর প্রেমে পড়া দু’পুরুষের হাতে দুটি পিস্তল ও একটি করে গুলি দিয়ে কলহের মিমাংসা করার চল এই সেদিনও ছিল। উভয়কেই যদি বিদ্যেটা ভালভাবে রপ্ত করিয়ে দিতে পারেন তবে দুজনকেই মাটিতে ফেলে দিতে পারবেন। এ হলো, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। এ কাঁটা দিয়ে ও কাঁটা তোলা। ও কাঁটা দিয়ে এ কাঁটা তোলা। দু’কাঁটা দিয়ে দু’কাঁটা তোলা। আগের কালের রাজারা, জমিদাররা একে বলতেন কূটনীতি।

আমার মত বেরসিকও যখন হলিউডের টার্মিনেটর-২ ছবিটি গোটা দশেকবার দেখে ফেলেছে তখন আপনার মত রসিকজন একবারও দেখেননি ভাবাই কষ্টকর। সেখানে দেখেছেন, হিরো কিভাবে ভিলেনকে ফুটন্ত তরলে ফেলে নিঃশেষে নিশ্চিহ্ন করে এবং তারপর নিজেকেও সেখানে নামিয়ে দেয় শেষ চিপখানা শেষ করার জন্যে। এ-ও হলো, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। এ কাঁটা দিয়ে ও কাঁটা তোলা। এ কাঁটা দিয়ে তাকেই তোলা। এক কাঁটা দিয়ে দু’কাঁটা তোলা। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের দুনিয়ায় এ নয়া তরিকা খুবই সহজ। বসে থেকে নিবিষ্ট মনে কেবল কোড লিখ, তারপর কম্পাইল করে ইনস্টল কর। ব্যাস, কেল্লা ফতে। খরচের দিক থেকেও এর সুবিধা আছে। পিস্তলের সংখ্যা দুই থেকে এক’য়ে নামিয়ে আনতে পারেন আপনি। এই যেমন ধরুন, এক নারীরোবটকামি দুই পুরুষ রোবটের একটির হাতে এক পিস্তল ও দুই গুলি দিয়ে আপনি কাজ হাসিল করতে পারবেন।

বলতে চাইছিলাম জাতিগত আত্মহননের কথা। স্বভাবের দোষে বলে চলেছি ব্যক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধি, উপন্যাস আর ছায়াছবির কথা। আমরা বাঙালী জাতি নিজেদেরকে কিভাবে ধ্বংসের পথে চালিত করেছি তার কয়েকটি নমুনা দেখুন। আমাদের উঠতি বয়েসের ছেলেমেয়েরাই কেবল নয়, সংসারিরাও মেতে উঠেছেন। টেলিভিশনের পর্দায় দেখি চোখের জলে ভেসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে আত্মহন্তা। যে হিমখণ্ডের চূড়া এতোটুকু তার কতটুকু জলের ভেতর চোখের বাইরে থাকে তা-ও হয়তো আপনার জানা। আফিম-ইয়াবার কথা না-ই-বা বললাম। তারপর দেখুন, নিজ হাতে নিজের খাবারে বিষ মিশিয়ে কিভাবে আমরা নিজেরাই হারাকিরি করে চলেছি। বাকি কিছু থাকলে আপনি নিজেই খুঁজে বের করে নিন। এত কিছুর হদিস দেয়া আমার উদ্দেশ্য ছিল না।

অট্টহাসির অন্তরালে আমি কেবলই শুনে চলেছি আত্মহন্তার করুণ আর্তনাদ। হে মৃত্যুকামি! তুমি কি দর্শকের আর্তনাদ শুনতে পাও?

জোনাথন সুইফট

আমার ছয় বৎসরের কন্যা ম্যাক্সি’র কৌতূহল-উৎসারিত ও জিগীষা-প্রবুদ্ধ প্রশ্নবাণসম্ভারের আমিই একমাত্র সহজপ্রাপ্য ও সহজভেদ্য লক্ষ্য। আমার প্রতি তাহার আগ্রহ ও আমাকে সান্নিধ্যদানে তাহার অকৃপণতা আমার নিকট গোলাপের ন্যায় প্রীতিকর হইলেও প্রশ্নের সদুত্তরদানে আমার প্রায়শই প্রকাশিত অক্ষমতা বেশ খানিকটা কণ্টকের ন্যায় বিরাজ করে। পিতাকে ঈদৃশ কঠিন প্রশ্নবাণ নিক্ষেপের সামর্থ্যাধিকারবোধজনিত আনন্দে এবং পিতার মুখে ক্রমপরিস্ফুটমান ইতস্তত-বিহ্বলভাব সন্দর্শনে বাণের নিখুঁত লক্ষ্যভেদের নিশ্চয়তালাভজনিত বিজয়ানন্দের আতিশয্যে তাহার কচিমুখখানা যেন একেবারে প্লাবিত হইয়া উঠে। তাহার প্রশ্নের বিষয়াবলী আমার অনধিগত তো বটেই, এমনকি যুগ-যুগান্তর ব্যাপিয়া প্রকাণ্ড সব উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত দার্শনিকগণও ভাবিয়া চিন্তিয়া কূল-কিনারা করিতে পারেন নাই বলিয়াই জানি। এই কন্যা আজিকে অকস্মাৎ একটি ধর্মতাত্ত্বিক প্রশ্ন করিয়া বসিলঃ আচ্ছা বাবা, শয়তানের কাজ কি? এই রকম প্রশ্ন আমি, বলাই বাহুল্য, বরাবরই পাশ কাটাইয়া চলিতে চাহিয়াছি।

জীবনকে সহজভাবে দেখিবার এবং বয়োজ্যেষ্ঠ, সহপাঠী ও দরিদ্রজনদের সহিত আচরণের ক্ষেত্রে কতিপয় সহজ নীতি অনুসরণ করিয়া চলিবার উপদেশ আমি কন্যাকে অক্লেশে নিরন্তর প্রদান করিয়া আসিতেছিলাম। বলিয়াছিলাম: আপনাকে রাজাপেক্ষা ন্যূন ভাবিও না, ভিখারীকে আপনাপেক্ষা ঊন ভাবিও না, প্রজাসকল যাদৃশ রাজভক্তি করে তুমিও ভিখারিকে তাদৃশ সম্মান করিবে, সকল প্রাণের প্রতি এহসানি প্রকাশিত করিয়া চলিবে। কিন্তু আমার সকল প্রয়াসকে ব্যর্থ করিয়া দিয়া আজ সে এই প্রশ্ন করিল। উত্তরে বলিলাম: মিথ্যাকে সত্য, স্বল্পমূল্যকে মহামূল্য ও অসুন্দরকে সুন্দর প্রতিপন্ন করিয়া তোলাই তাহার কাজ। ইহাতে ঘৃতে যেন আহুতি দেওয়া হইল। তাহার পর আর যেসকল প্রশ্নে আমি জর্জরিত হইয়া উঠিলাম!—আগে জানিলে তাহার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়া বরং নিশ্চুপ থাকিতাম।

প্রসঙ্গত দিনান্তরের কথা স্মৃতিপটে ভাসিয়া উঠিল। কোন মস্ত মানুষের সহিত আমার সাক্ষাতের সম্ভাবনা অনুমান করিতে পারিয়া কন্যা আমাকে একটি অটোগ্রাফ সংগ্রহ করিয়া দিতে অনুরোধ করিয়াছিল। তৎবিপরীতে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, অটোগ্রাফ প্রদান না করিয়া গ্রহণ করিতে তুমি এই যে আগ্রহান্বিত হইয়া উঠিলে তাহার বিশেষ কোন হেতু আছে কি? অন্যের অনুকরণ করিবার ক্ষেত্রে তাহার মধ্যে একটি জড়তা পূর্বেও আমা দ্বারা লক্ষিত হইয়াছে। এইবারও সেপথ চাতুর্যের সহিত পরিহারের লক্ষণসূচক ভাব চেহারায় স্ফুট হইতে দেখিলাম। কন্যা নম্রকণ্ঠে কেবল কহিল, বাবা! আমি তো তাহাদের মত বড় হইতে সমর্থ হই নাই। আমি তাহাকে বরাবরের ন্যায় নিজেকে অন্যের সমান জ্ঞান করিবার পরামর্শ দিলাম। ইহাতে কী বুঝিল তাহা বুঝিবার কোন অবকাশ না দিয়াই সে অন্তর্হিত হইল।

কিয়ৎ দূরে দাঁড়াইয়া কন্যার মাতা অলক্ষ্যে পিতা-পুত্রীর বিবাদ পর্যবেক্ষণ করিতেছিলেন। কন্যার অন্তর্ধানের পরক্ষণেই হতাশা প্রকাশ করিয়া কহিলেন, তুচ্ছ বিষয়কে লইয়া একটা মস্ত তোলপাড় না বাধাইলে তোমার চলে না দেখিতেছি। সামান্য এক অটোগ্রাফ লইয়াও এইটুকু মেয়ের সহিত তোমার ভারী কথার কপচানি। বলিয়া তিনি কন্যাভিমুখী হইলেন। বিষন্নমনে আমি এই প্রার্থনা করিলাম, অটোগ্রাফ সামান্যই বটে, তবে কন্যা যেন একদিন ইহা উপলব্ধি করিত পারে যে, যে বোধ অটোগ্রাফের জন্য মনোমধ্যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে তাহা সামান্য নহে। উত্তরজীবনে অটোগ্রাফের বাসনা পুতুল খেলার ন্যায় পরিত্যক্ত হইলেও বোধটি নানারূপে ঘুরিয়া ঘুরিয়া কেবলই প্রত্যাবর্তন করিতে থাকে।
বাংলাদেশীদের মধ্যে যারা এসএসসি পাশ করেছেন তারা সুইফটের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। তিনি গালেবর জাহাজির সফরনামা লিখে খ্যাত হয়েছেন। এ সফরনামা চার খণ্ডে লেখা। ফ্যারওদের রাজ-কারিগরেরা অর্থাৎ সভ্যতার দিগ্দার্শনিকেরা তাঁকে সুনজরে দেখেছেন বলে মনে হয় না। সুইফট মানসিক বিকারগ্রস্ত ছিলেন বা অন্ততপক্ষে জীবনের শেষদিকে বিকারগ্রস্ত হয়েছিলেন তা সপ্রমাণে ব্যস্ত হওয়ার মতো মানুষের অভাব হয়নি। এতে বইয়ের অন্ততঃ ঘোড়াদের রাজ্যের কাহিনী নিয়ে লেখা চতুর্থ খণ্ডটিকে উড়িয়ে দিতে সুবিধা হয়। আপনি এরূপ বিশ্বাস করতেই পারেন যে, সুইফট ফরাসি বিপ্লব চলাকালে প্যারিস শহরে বাসরত থাকলে তাঁর মাথাটি গিলোটিনে দুবার কাটা পড়তো; বিপ্লবের এপক্ষ ওপক্ষ দুপক্ষই তাঁকে আপদ হিসেবে গণ্য না করে পারত না; এবং তাঁর মানসিক অসুস্থতা তাঁকে নিস্তার দেয়ার পক্ষে যথেষ্ট কারণ বলেও গণ্য হতো না।
পরিশেষে, কন্যা কর্তৃক উত্থাপিত প্রশ্নের পরিণতি প্রসঙ্গে ফিরিয়া আসা যাক। আমি জোনাথন সুইফট প্রণীত গ্রন্থখানা শেলফে আলাদা করিয়া রাখিয়া ও তাহা কন্যাকে দেখাইয়া দিয়া এবং একদিন সে তাহার প্রশ্নের উত্তর নিজেই অন্বেষণ করিয়া লইতে পারিবে এই প্রত্যাশা অন্তরে পোষণ করিয়া অসিয়ত করিলাম, সে যেন আর দশ বৎসরকাল অতিক্রান্ত হইলে এই গ্রন্থটি আদ্যোপান্ত পাঠ করিয়া লয়।

সিরাজুদ্দৌলা বনাম মীরজাফর

অতীতের সাথে আমাদের বুদ্ধিসম্মত, বাস্তবসম্মত ও কার্যকর সম্পর্কের রূপ কী হতে পারে? এটি যেমন একটি বিচার্য বিষয়, তেমনই আমরা প্রকৃত প্রস্তাবে অতীতের সাথে নিজেদেরকে কিভাবে বেঁধে রেখেছি তার প্রকৃতিও বুঝা প্রয়োজন। এ প্রয়োজন আমাদের নিজেদের জন্য, বর্তমানের জন্য এবং ভবিষ্যতের জন্য। অতীতে মহাপুরুষরা যেমন ছিলেন তেমনই ছিলেন হীনপুরুষেরা। আমরা আতীতের এই দুই ক্যাটাগরীর সাথে নিজেদেরকে সম্পর্কিত করি দুই ভিন্ন মনোভঙ্গি নিয়ে। এক শ্রেণীকে আমরা ভক্তি করি ও আরেক শ্রেণীকে আমরা করি ঘৃণা। একশ্রেণীর বন্দনায় আমরা ব্যস্ত ও অন্যটিকে সদাই দিয়ে চলেছি গালাগাল।

আমরা যারা বেঁচে আছি তারাই এখন বর্তমান, অস্তিত্বশীল। আমাদের জীবন আমাদের, আমাদের দায়ভার আমাদের, আমাদের কর্মের ফল আমাদের। আমাদের আগে আমাদের পূর্ব-পুরুষেরা ছিলেন। তারা এখন অতীত। তারা জীবনের মঞ্চ ছেড়ে চলে গেছেন কর্মের ফল নিজেদের গলায় ঝুলিয়ে। তারা কেউ আমাদেরকে সম্পন্ন করতে পারবে না, তারা কেউ আমাদেরকে বিপন্ন করতে পারবে না। আমাদের সম্পদ আমাদের বিপদ আমাদের হাতেই নিহিত। আমাদের কর্মের ফল আমাদের গলাতেই ঝুলবে।

দুই ক্যাটাগরিকে নিয়েই আমরা ভুল করে বসে আছি; কিন্তু কোথায় যে ভুলটা, তা চট করে বুঝতে পারি না। দুই ক্ষেত্রেই আমরা করে চলেছি অবিচার ও অন্যায়। আমাদের করার কথা ছিল মহাপুরুষদের পথটি অনুসরণ, তাঁরা যেখানে শেষ করেছেন সেখান থেকে আরও এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু সে পথ অনুসরণ করা যে বড় কঠিন কর্ম, বরং পথিক-ভক্তি এবং পথ-বন্দনার পথ যে বড় সহজ।

এখানে অত্যাচারটি হলো খোদ নিজের উপর, নিজেকে ছোট করে বড় হওয়ার পথটিকে বন্ধ করে দিলাম যে চিরতরে, অথবা নিজ ধারণামত একটি সীমা টেনে অনন্ত সম্ভাবনাটির টুঁটি চেপে ধরলাম। অন্যদিকে, জীবন তো থেমে থাকে না, কোন না কোন পথে তো চলতেই হয়। মহাপুরুষদের পথ পরিহার করলে যা অনিবার্য হয়ে ওঠে তা হলো অত্যাচারীদের পথ ধরা। ফলাফল: মহাপুরুষদের মাথায় নিয়ে অত্যাচারীদের পথে যাত্রা—এখানে দুদিকেই সুবিধা: বোঝার ওজনও কম, পথের কঠিনতাও কম।

আবার দেখুন, অতীতের অত্যাচারীরা আমাদের কী ক্ষতি করেছে যে তাদেরকে গালাগাল দিয়ে বেড়াবো আমরা? আমরা যে অবস্থায় জন্ম নিয়েছি তা-ই আমাদের যাত্রাস্থল। অতীতের অত্যাচারীরা অত্যাচার না করলে আমরা সুখে থাকতাম—এই আক্ষেপ আর আক্ষেপের জ্বালার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। এ হলো উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্য সম্ভাব্য ধনে সুখে থাকতে না পারা ও বাহাদুরী দেখাতে না পারার আক্ষেপ। বাজে ভাবে বললে, এ হলো পরের ধনে পোদ্দারী করার সুযোগ হারানোর আক্ষেপ।

যদি মনে করি যে, অতীতের দুর্জনেরা হালের দুর্জনদের বীজ বুনে গেছে, তাহলেও তো কথা একই হয়। যারা আমার চারপাশে বিদ্যমান আছে সমস্যাটি তাদের সাথে, মৃতদেরকে গাল দেয়ার ছুতা খুঁজে বের করা তো বাবুরাম সাপুড়ের ঝুলি খুঁজে বেড়ানোর মত।

আমরা যে কাজটি করি তা হলো অতীতের অত্যাচারীদের কষে গালাগাল করা, আর বাস্তবে অত্যাচারের পথে চলা ও বাস্তব অত্যাচারীদের পক্ষ নেয়া। এখানে উভয় ক্ষেত্রেই আমরা দুটো অন্যায় করি। অতীতের মৃত অত্যাচারীরা যারা বতর্মান আমাদের উপর কোন অত্যাচার করেনি তাদেরকে গালি দেয়া, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে অত্যাচারর পথ অবলম্বন করে বর্তমান মানুষের জীবন অতীষ্ঠ করে তোলা।

মীরজাফরকে গালি দিলেই তো আর মোহনলাল হওয়া যায় না। সিরাজুদ্দৌলাকে ভক্তি করলেই তো আর রবার্ট ক্লাইভ চলে যায় না, স্বাধীনতা ফিরে আসে না। ফ্যারওকে গালি দিয়ে লাভ কী? এতে তো আমি হারুন হয়ে যাব না। মুসাকে ভক্তি করেই বা লাভ কী, যদি আমি হামান, কারুন হই। আর যদি আমি হারুন হতে পারি বা হতে পারি মোহনলাল, বা তাঁদের ছাড়িয়ে যেতে পারি তবে ভক্তির অভাবে আমি হারাবোটা কী?

অতীতের একাংশকে সেজদা করা ও অপর অংশকে দোর্রা মারাই যেন আমাদের ধর্ম। আমরা অন্তত চতুর নাকি নিতান্তই নির্বোধ? সব ভুলে টাইম মেশিনে করে পিরামিডের দেশে বা পলাশীর প্রান্তরে গিয়ে পড়লে আমরা কে যে কোন পক্ষ নিতাম কে জানে!

কাক ও কোকিল

এটি কাকের রাজ্য—রাজ্যে কাকদের বসবাস। কাকরাই সংখ্যাগুরু আমজনতা—হাজারে হাজার, লাখে লাখ, বেশুমার। রাজ্যটিকে তুমি আবার কোকিলের রাজ্যও বলতে পার—কারণ এ রাজ্যের রাজা কোকিলেরা। এ রাজ্যে কোকিলেরা দেবতা, কাকেরা ভক্ত; কোকিলেরা গায়, কাকেরা শোনে; কোকিলেরা বসে ঝালর লাগানো সোনার সিংহাসনে, কাকেরা বসে মাটিতে। কাকেরা ঘুরে ঘুরে নাচে ও ভক্তি নিবেদন করে। কোকিলেরা সে ভক্তি গ্রহণ করে কাকদেরকে ধন্য করে।

কাকদের স্বভাব ছিল। এক কাক মরলে সব কাক উড়ে এসে জুড়ে বসতো। কাকে কাকে ছেয়ে যেত আকাশ। স্বভাব বদলেছে। রাজা কোকিলেরা কাকদের মনের ভেতরটাকে, মাথার ভেতরটাকে দেখতে পায়, বদলাতে পারে। কোকিলের এমনই নজর, এমনই সম্মোহনী শক্তি, এমনই যাদু। কাকরা টের পায় না। ভাবে—যা ভাবি সে তো আমারই ভাবনা, যা দেখি তা তো আমারই দেখা। কোকিলেরা খায়-দায় কাকেদের ক্ষেতে, ডিম পারে কাকেদের বাসায়। কোকিলদের ডিমে কাকেরা তা দেয়। শুধু কি তাই? কোকিলদের ভাবনামত ভাবেও বটে। আহা! ভাবুক কাকেরা!

বেশুমার কাকের রাজ্যে কাকের মরণে কী আসে যায়? ভাবনার দরকার কী? এ তো সহজ যুক্তির কথা। কাকেরা যুক্তিতে বাস্তববাদী। এ সোজা কথা বুঝতে কাকেদের এতদিন লেগে গেল! সেখানেই বুঝি তাদের দুঃখ। কাকেরা বুঝতে শিখেছে। তারা এখন নান্দনিকতার কদর বুঝে। কোকিলের কণ্ঠে কী সুরেলা গান! গানের কদর জেনেছে বলে কাকদের এখন গর্বের শেষ নেই। তাই কোকিল মরলে এখন আকাশের মেঘেরা ছেয়ে যায় কাকে। কাক মরলে আকাশে ভাসে শুধুই মেঘেরা।

মানুষের মধ্যে এমন অর্বাচীন আছে যে দুধ বেচে সুরা কিনে পান করে। কিন্তু কাকরা তেমন নয়। তারা নিজেদের ক্ষেতের শস্য কোকিলদের ভেট দেয় পূজার অর্ঘ হিসেবে, কেবল গান শোনার জন্য। তারা কাজ করে কোকিলের জন্য, বেঁচে থাকে কোকিলের গানের জন্য।

কাকেদের ভাষা আছে। ভাষার ব্যাকরণ আছে। ব্যাকরণের বই আছে। সে বইতে উপসর্গের তালিকা আছে। কোকিলদের জন্য তারা ‘মহা’ উপসর্গটি উৎসর্গ করেছে। নিজেদেরকে কাকেরা কাক বললে কী হবে, কোকিলদেরকে তারা সম্বোধন করে ‘মহামহিম মহাকোকিল’ বলে। আরও আছে প্রয়াণ বনাম মহাপ্রয়াণ, আগমন বনাম মহা-আগমন—আরও কতকী! কাকেরা এখন আর কাক নেই, তারা সুভাষী সভ্য হয়েছে।

বেপরোয়া মানুষেরা অতশত বুঝে না। না জানে কোকিলের মর্ম, না বুঝে কাকেদের দুঃখ। মরা তো মরাই—ভাবে মানুষ। তাই মরা কাক কি মরা কোকিল বাছ বিচার করে না তারা—ফেলে রাখে রাস্তার পাশে দুটোকেই একইভাবে। কিন্তু তা দেখে কাকদের কী দুঃখ—আহা, দেখ নিষ্ঠুর মানুষেরা কোকিলটিকে কাকদের মত করে ফেলে রেখেছে অবহেলায় রাস্তার পাশে। কাকেরা ভাবে, কবে যে বুঝবে ভোঁতা মনের মানুষেরা!

সানাই ও ডুগডুগি

পথ চলিতে গিয়া বাঁদরের নাচ দেখে নাই এমন বঙ্গদেশীয় সন্তান খুঁজিয়া পাওয়া ভার। তবে মানুষই যে কেবল বাঁদর নাচায় তাহা নহে, বাঁদরও মানুষদের নাচাইতে পারে। হালে বিজ্ঞাপনে দেখিয়াছি বলিউডের কোন নায়িকার গলায় দড়ি আর ডুগডুগি বাজাইতেছে বিশাল এক বানর। নাচ শেষে পিচ্চি নায়িকা সাইকেলের হাতলে বসিয়া আছে আর বানরটি সিটে বসিয়া প্যাডেল চালাইতেছে—নতুন স্থান ও নতুন মানুষের খোঁজে। ডুগডুগিতে মানুষ আঘাত করুক কি বাঁদরেই আঘাত করুক, মানুষদেরকে নাচিয়া উঠিতে দেখিতে পাওয়া যায় হরহামেশাই।

আমাদের বিবাহ অনুষ্ঠানে সানাই বাজে আকসার। কাহারও গান বাজনার প্রতি বিরাগ থাকিলেও অথবা কেহ কেহ শুনিবামাত্র ‘তৌবা তৌবা’ বলিয়া কানে আঙ্গুল দিলেও সানাই শুনেন নাই এমন মানুষ আমাদের দেশে আছে বলিয়া বিশ্বাস করা কঠিন। সানাইয়ের মাহাত্ম্য মিলনে। মানুষে মানুষে মিলন মেলার সুরের উৎস হইয়া আছে আমাদের সানাই।

ডুগডুগিতে ঘুরানি দিয়া গোটা কতক বাড়ি দিলেই এবং মুখে গোটা কতক খাঁকারি দিলেই যথেষ্ট হইলেও, সানাইতে কেবল ফুঁ দিলেই কাজ হয় না। সানাই বাজানো কঠিন, এইখানে তাল লয় কত কিছুর দিকে যে নজর রাখিতে হয়! ইহা একটি সমগ্র, একটি শিল্প, একটি জ্যামিতি। কত সুরেই যে আপনি সানাই বাজাইতে পারিবেন! শ্রোতার ক্লান্তি আসিবে না। বাজানোও শেষ হইবে না। কিন্তু ডুগডুগি! কতক্ষণইবা বাজাইতে পারা যাইবে! কতক্ষণইবা মানুষ আগ্রহ ভরিয়া শুনিবে?

তবুও বোকার দল ডুগডুগির বাড়িতেই মাতিয়া উঠে। কোথায় কোন ভিন দেশের কে ডুগডুগিতে বাড়ি দিল আর অমনি আমরা আমাদের দেশের নিজেদের সম্পদে আগুন লাগাইয়া দিলাম। নকল-নবিশি করিয়া কে একটু ডুগডুগি বাজাইল আর অমনি আমরা তাহার মোকাবেলায় যুদ্ধ বাঁধাইয়া দিলাম। ডুগডুগি বাজানো যে হারাম তাহা সপ্রমাণ করিতে আমাদের সমস্ত তফসির আর শাস্ত্র লইয়া হাজির হইলাম।

আরে বোকার দল! না নাচিলেই যে সুবিধা পাওয়া যায় তাহা বুঝিবি কবে? ডুগডুগি তো সানাই নয়। ডুগডুগির ভাণ্ডার তো সানাইয়ের ভাণ্ডারের মতো অসীম নয়। বাজিয়া বাজিয়া ডুগডুগি নিজেই ক্লান্ত হইয়া একসময় থামিয়া যাইবে, থামিয়া পথের উপর পড়িয়া থাকিবে। আর যদি বাজিতেই জিদ ধরে তবে একই কলের বাড়ি শুধু ঘুরিয়া ঘুরিয়া পড়িবে।

এই সানাই যেমন পুরাতন, তেমনই পুরাতন এই ডুগডুগি। তোমরা যাহাকে গুরু মানিয়াছ সেই গুরু যাবত সানাই বাজাইতেছেন তাবৎ ডুগডুগিও বাজিয়া চলিয়াছে। সানাই ওয়ালারা ডুগডুগিতে কান পাতিয়াছিল তাহা তো কখনও সেই কালে দেখা যায় নাই। গুরুর আগেও গুরু ছিল। সেই প্রথম গুরু হইতেই একই ইতিহাস চলিয়া আসিয়াছে। কেহই নতুন কিছু বাজাইতেছে না—না সানাই ওয়ালা না ডুগডুগি ওয়ালা।

নতুন নতুন সুর তুলিয়া সানাই ওয়ালারা বাজাইতে ব্যস্ত হইলে এবং সানাইয়ের সুরে নিজেদের মন বদলাইতে পারিলে তাহার রোশনাই সানাই ওয়ালার কদর বাড়াইবে। ডুগডুগির পিছনে পড়িলে তুমি সব হারাইবে। ডুগডুগিরও যাদু আছে, কিন্তু সেই যাদু সানাই ফেলিয়া নাচিতে ধরিলেই কাজ করে, সানাইয়ে মন দিলে করে না।

ডুগডুগির ইতিহাস না হয় অজানাই থাকিল—কিন্তু নিজের গুরুর ইতিহাস তো, তুই নচ্ছার, বুঝার চেষ্টা করবি!

এথিকস ও অ্যাক্রোবেটিকস

একজন দড়ির উপর দিয়ে হাঁটতে শিখলেন। এতে কি একথা বলা যায় যে, তিনি নৈতিকভাবে উন্নত হলেন? একথার উত্তরে সবাই ‘না’ বলবেন। যিনি দড়ির উপর দিয়ে হাঁটার নৈপুণ্যে সর্বকালের সকল মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে মানুষের কাছে স্বীকৃত হলেন ও সম্মাননা পেলেন, তিনি জীবনের সফলতার পথে কিছু এগিয়ে গেলেন—একথা কি বলা যায়? সম্ভবত এখানে বিতর্ক এড়ানো কঠিন। আমাদের সমস্যাটি ঠিক এখানটায়, আর পাঠক নিজে এর বিচার করে দেখবেন।

অ্যাক্রোবেটিক নৈপুণ্য আকার ও বস্তুর সাথে সংশ্লিষ্ট। তাই তা দেখা যায় ও সহজে পরিমাপ করা যায়। একারণে এগুলো নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে ও পুরস্কার দেয়ার জন্য বাছাই করা যায়। কিন্তু মানুষের নৈতিক অবস্থা নৈর্ব্যক্তিকভাবে (অবজেকটিভলি) পরিমাপ করা যায় না।

অ্যাক্রোবেটিকসের সাথে অধিকাংশ মানুষের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ নয় ও অনিবার্যও নয়। তারা নিজেরা এতে অংশ নেন না, কেবল দূর থেকে দেখেন মাত্র, তাও আবার সকলে নন। অর্থাৎ এর মধ্যে সার্বজনীনতাও নেই। অন্যদিকে নৈতিকতার প্রশ্নটি প্রতিটি মানুষের নিজের জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে এবং যার ধারণা বা সম্বিত দার্শনিক থেকে শিক্ষাবঞ্চিত জন অবধি সবার মধ্যেই বিদ্যমান। নৈতিকতার মূল্যটিও সকলে উপলব্ধি করেন—তা তিনি নৈতিক বা অনৈতিক যে জীবনই বাস্তবে যাপন করেন না কেন।

মানুষের কাজ বা সামর্থ্য মূল্যায়নের দুটি পরিমণ্ডল রয়েছে: নৈতিক ও নান্দনিক।

নৈতিকতার সম্পর্ক মানুষের অস্তিত্বের সংকটের সাথে, মানুষের জীবনের দুঃখের বা যন্ত্রণার সাথে। (স্বাচ্ছন্দ্য আমরা চাই কিন্তু ওটা আসলে দুঃখের অভাব বা যন্ত্রণার অবসান।) অস্তিত্বের সংকটজাত কর্মকাণ্ডের তিনটি মণ্ডল আছে: একটি হলো ‘উৎপাদন’, আর একটি ‘ব্যবস্থাপনা’ ও অন্যটি ‘শিক্ষা’। যে কৃষকটি নিষ্ঠার সাথে আবাদ করেন, যে শ্রমিকটি নিষ্ঠার সাথে কারখানায় কাজ করেন, যে ব্যবসায়ী নিষ্ঠার সাথে পণ্য ভোক্তার হাতে তুলে দেন, যে কর্মচারী নিষ্ঠার সাথে অফিসে কাজ করেন বা যে শিক্ষক নিষ্ঠার সাথে ছাত্রদের শিক্ষা দেন তারা সবাই নৈতিকভাবে উন্নত, যে কথা নিষ্ঠাবান দড়িওয়ালা অ্যাক্রোবেটের বেলায় খাটে না।

নান্দনিকতার অবস্থান কোথায়? এর মূল্য কী বা কতটুকু? নান্দনিকতা অবশ্যই সুপারফ্লুয়াস এবং এর বিস্তৃতি বিষয়ী গত। এর সম্পর্ক আনন্দের সাথে, অনুভবের সাথে। চেতনার বিকাশের ক্ষেত্রে বা শিক্ষার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা আছে বটে, কিন্তু এর বাহনগুলো অ্যাক্রোবেটিক নিপুণতা ছাড়া কিছু নয়। সংগীত, অভিনয়, কাব্য, চিত্রশিল্প বা ভাস্কর্য—এসকল বিষয়ে যে নিপুণতা প্রয়োজন তা একধরনের অ্যাক্রোবেটিক বা জিমনাস্টিক অর্জন। শিক্ষা বা নব চেতনার উন্মেষের ক্ষেত্রে এ বাহনটি প্রয়োগের বিষয়ে একথা সত্য যে, এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং নৈতিকতার বিকাশে খরচ/অর্জন বা সামাজিক বিস্তৃতির দিক থেকে কার্যকর নয়; এখানে অপচয় বা ‘সিস্টেম-লস’ বেশী। আমরা দেখতে পাই যে, শ্রেণী বৈষম্য, পুঁজি, বিলাস, উদ্বৃত্ত মূল্যের সাথেই এটি অনুষঙ্গী হয়ে আছে, নৈতিকতার সাথে নয়।

কিন্তু যদি ধরেও নেই এসবের সুফল আছে, তবুও মূল্যের পিরামিডে এর অবস্থান কী হতে পারে? মানুষের জীবনে কার অবদান বেশী? কৃষক, শ্রমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের? নাকি অভিনেতা, কবি বা ভাস্করের? কৃষককে আমরা কতটুকু সম্মান করি বা তার খবরইবা কতটুকু রাখি? আর কাদেরকে আমরা ‘আইকন’ বানিয়ে তাদের জন্য অস্থির হয়ে থাকি?

এসব প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই নিহিত আছে মানুষ সত্যিকার অর্থে কিসের উপাসনা করে।

গর্বের দোকানপাট

আমি গর্বের এক বাহারি হাটের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। কত বাহারি দোকান, কত বাহারি দোকানি আর কতই না বাহারি সওদাগরি! গর্বের দোকানপাটে হাট সরগরম। দোকানে দোকানে পিরামিড, তাজমহল আর ঝুলন্ত উদ্যানের সৌকর্য। গর্বের বেসাতি আর বেচাকেনায় চারদিক উৎসবমুখর। নিজের পসরা বাড়াতে দোকানিরা আবার মাঝে মধ্যে নিজেরা নিজেরা একটু কাজিয়া-ও সেরে নিচ্ছে।

সামন্তের দোকানে শোনা গেল তার হাঁক: আমি গর্বিত জমিদার।

পাশের পুঁজিওয়ালা বলে, ওরে ইতিহাস না পড়া মূর্খ! কি নিয়ে করিস গর্ব? পুঁজির ঠেলা খেয়ে কোথায় যাবি ভেসে! আমার সওদা কিনে হয়ে যা গর্বিত পুঁজিপতি।

পাশে আছে সমাজতন্ত্রীর দোকান। মাথায় লাল ফিতা, হাতে কাস্তে, মুখে দৃপ্ত উচ্চারণ: আমি গর্বিত সমাজতন্ত্রী। শোন তুই সামন্ত, শোন পুঁজিওয়ালা! সর্বহারার মশালে তোদের হবে পতঙ্গের দশা।

শুনে মানবতাবাদী বলে, চুপ চুপ! বিপ্লবীরা! এতো কিসের গর্ব তোদের! দুদিন পরে পচবি মাটির তলে, ছাই হয়ে ভাসবি নদীর জলে। আমার মন্ত্র নে, হয়ে যা গর্বিত মানবতাবাদী।

বাঙালির দোকানি এদিক সেদিক কোন দিকেই চায় না, মুখে কেবল ধন্য ধন্য রব: সফল জীবন আমার, ধন্য আমি মাগো, আমি যে গর্বিত বাঙালি।

ইসলামের দোকানি বলে, তাই যদি হবে তবে তোদের চোর-ডাকাতেরে তোরা জেলে পুড়িস কেনে? ওরাও তো ধন্যি, ওরাও যে বাংলায় কথা বলে। খোদার জমিনে তোরা কে হে রাজত্ব করতে চাস? মেনে নে খোদার শান, বনে যা গর্বিত মুসলমান।

আমি শুনে থ! এ তো দেখি সোনার পাথরবাটি।

আমি নতুনের বাহারি হাটে শুধুই খুঁজে বেড়াই পুরাণ গুরুর খেজুরপাতার ডেরা। খেজুর কাঁটার মুকুট পরে কবে আসবেন তিনি! আমাকে দেখে বলবেন, ওরে মৃতের অর্বাচীন সন্তান! এ তো বড় সোজা কথা। ফানুস দেবতাদের ছাড়, ধর আসল দেবতা। গতকাল যারে খুঁজে পাসনি, আগামীকাল যারে খুঁজে পাবি না, তার সুতো ধরে আর কতকাল চলবি? তার নাটাইয়ের ঘুড়ি হয়ে আর কতকাল উড়বি? যে জন জন্মায় না মরেও না, যারে তুই গড়তেও পারবি না ভাঙতেও পারবি না, নত হয়ে তার কাছে যা, আর থাক হয়ে বিনয়ী জগতবাসী।

সোমবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৩

ভক্তির ভারে লুণ্ঠিত মর্যাদা

ফুলের যেমন মধু, মৃগের যেমন কস্তূরী, মানুষের তেমন মর্যাদা। মধুর ভার যে ফুলের কাছে অসহনীয়, সে ফুলের করুণ আলেখ্য লেখার ভার তোমার মত বিজ্ঞানীর হাতেই থাকল। কস্তূরিকার ভার যে মৃগের কাছে অসহ্য, তার সর্বনাশের কাব্য রচনার ভার তোমার মত কবির হাতেই থাকল। আমি কেবল মানুষের মর্যাদার ভার নিয়ে দুটি কথা বলি। মানুষের কাছে মর্যাদার ভার যেন এক অসহনীয় ভার, অস্পৃশ্য ভার, বিপদজনক ভার।

যেখানেই যাই সেখানেই দেখি ভক্তির ভারে ভূলুণ্ঠিত ন্যুব্জ মানুষ। সামন্তের পায়ে, পুঁজিপতির পায়ে লুণ্ঠিত মানুষ। ব্রাহ্মণের পায়ে, ক্ষত্রিয়ের পায়ে লুণ্ঠিত মানুষ। ভয়ের দেবতা আর বাসনার দেবীর পায়ে লুণ্ঠিত মানুষ। পচে-গলে খসে যাওয়া মাংসের ভেতর থেকে বের হয়ে পড়ে থাকা কঙ্কালের পায়ে লুণ্ঠিত মানুষ। সংস্কার আর কুসংস্কারের প্রেতদের পায়ে লুণ্ঠিত মানুষ। অত্যাচার আর স্বেচ্ছাচারের দেবতাদের পায়ে লুণ্ঠিত মানুষ। পিরামিড আর তাজমহলের পাষাণে লুণ্ঠিত মানুষ। ধুলোয় ধূসরিত মানুষের কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলি, ব্যাটা ওঠ্, মাথা উঁচু করে দাঁড়া, তোর চেয়ে বড় কেউ নেই এক ভগবান ছাড়া। অবিশ্বাসের চাহনি তারও চোখে মুখে। বলে, বাবু! আমিও বড়! এও কি সত্যি কথা!

তুমি মানুষকে কাড়ি কাড়ি টাকা দাও। নিয়ে বলবে, আরও দাও। এক পাহাড় দিয়ে দেখ। নিয়ে বলবে, কাঁধ যে আমার দুটো ছিল গো। কিন্তু মর্যাদা দিয়ে দেখ দেখিন। দেখবে কিভাবে সন্দেহের চোখে চাইতে শুরু করে সবাই। আমার একুল ওকুল দুকুলের শিক্ষকবৃন্দেরই কান হয়ে উঠে খাড়া। ভাবে, এ যে দেখি আমাদের ভিতটাই ভেঙ্গে দিতে চায়; এ যে দেখি আমাদের পিতাদের ধর্মের, ব্যবস্থার ঘোর শত্রু। এ তস্কর কোন সুমেরিয়’র কুঠার হাতে নিয়ে ঘুরে? রক্ষা কর! রক্ষা কর! তোমাদের দেবতাদের রক্ষা কর!

এ সংসারে বঙ্কিমচন্দ্র একটি শব্দ সর্বদা শুনতে পেতেন, ‘অমুক বড় লোক—অমুক ছোট লোক।’ তিনি আরও লিখেন, “এটি কেবল শব্দ নহে। লোকের পরস্পর বৈষম্য জ্ঞান মনুষ্যমণ্ডলীর কার্য্যের একটি প্রধান প্রবৃত্তির মূল। অমুক বড় লোক, পৃথিবীর যত ক্ষীর সর নবনীত সকলই তাঁহাকে উপহার দাও। ভাষার সাগর হইতে শব্দরত্নগুলি বাছিয়া বাছিয়া তুলিয়া হার গাঁথিয়া তাঁহাকে পরাও, কেন না, তিনি বড় লোক। যেখানে ক্ষুদ্র অদৃশ্যপ্রায় কণ্টকটি পথে পড়িয়া আছে, উহা যত্নসহকারে উঠাইয়া সরাইয়া রাখ—ঐ বড় লোক আসিতেছেন, কি জানি যদি তাঁহার পায়ে ফুটে। এই জীবনপথের ছায়াস্নিগ্ধ পার্শ্ব ছাড়িয়া রৌদ্রে দাঁড়াও, বড় লোক যাইতেছেন। সংসারের আনন্দকুসুম সকল, সকলে মিলিয়া চয়ন করিয়া শয্যারচনা করিয়া রাখ, বড় লোক উহাতে শয়ন করুন। আর তুমি—তুমি বড় লোক নহ—তুমি সরিয়া দাঁড়াও, এই পৃথিবীর সামগ্রী কিছুই তোমার জন্য নয়। …”

শুরু করেছিলাম মর্যাদা নিয়ে, বঙ্কিমের কথায় এসে পড়লাম বৈষম্যের মাঝে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে মর্যাদার চরম সমতা অস্বীকার করার প্রায়োগিক পরিণতি হচ্ছে এই বৈষম্যজ্ঞান। কেউ নিজেকে বড় মনে করলেও অত সমস্যা থাকতো না। সমস্যা প্রকট হয়ে দাঁড়ায় যখন কেউ তা মেনে নিয়ে নিজেকে ছোট সাব্যস্ত করে বসে। এখানেই প্রকৃত প্রস্তাবে বৈষম্যের আসল জয়। কেউ তোমাকে ছোট করতে পারবে না, যাবত না তুমি নিজেই তা মেনে নিচ্ছ। মেনে না নিলেই আর কথিত ‘চিরনমস্য’ বা ‘প্রাতঃস্মরণীয়’দের আশীর্বাদ বা চরণধূলির তেষ্টা লাগে না।

মিনিবাসে বসে দেখি, ছিন্নবসন যাত্রীকে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে আরেক ছিন্নবসন কন্ডাকটর। দুজনকেই আবার দেখি ধুপদুরস্তবসনকে সসম্মানে পথ ছেড়ে দিতে। দপ্তরের সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করি, কেমন আছেন? উত্তর মেলে, আপনার দোয়ায় ভাল আছি। রাখেন ভগবান, মারেন ভগবান। ভগবানের কথা সে মনে রাখে না। মানুষের দোয়ায়, মানুষের আশীর্বাদে মানুষের বুঝি ভাল থাকা হয়! পীরের মাজারে গিয়ে দেখ কিভাবে মানুষ নিজেকে অপমানিত করে। তুমি কি দেখনি কিভাবে কত রকমের গুরুর পায়ে নিজেকে সমর্পণ করে মানুষ? আরও দেখ, চারদিকে চেয়ে দেখ—তোষামোদের ছড়াছড়ি, তোষামোদের জয়জয়কার। নিজেকে ছোট না করে কে কবে অন্যের তোষামোদ করতে পেরেছিল তুমি খুঁজে দেখ দেখি।

অমুকে সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান বলে লোকে সার্টিফিকেট দেয়। ‘সম্ভ্রান্ত’ শব্দের অর্থ কী কে জানে! তবে ইংরেজি করে অনেকে লিখেন ‘এরিস্টোক্রেটিক’ ইত্যাদি। মানুষে মানুষে সাম্য রক্ষার দুর্গ থেকেও অসাম্যের দ্যোতনাযুক্ত কথা মাঝে মাঝে ভেসে আসে। যাঁরা চোখে কালো পট্টি বেঁধে অফিস করেন, কে ‘বড়’ কে ‘ছোট’ তা দেখতেই চাননা, তাদের কণ্ঠেও শোনা যায়, অমুক সমাজের শ্রদ্ধাভাজন বিধায় তাঁকে বিব্রত করতে তাঁরা খুবই অনীহ। অর্থাৎ, আমাদের সলিম মিঞা বা ভজন কুমার যে অখ্যাত, নগণ্য, অগণ্য; কাজেই তারা কেউ বিব্রত হলো কি হলো না তা তেমন বিবেচ্য বিষয় নয়। দেখা যায়, তাদের জামার কলার ধরে টেনে আনলেও দোষ হয় না।

নিজেকে ছোট জ্ঞান করার চূড়ান্ত বিষফল হচ্ছে ছোট আদর্শের ঘেরে নিজেকে বন্দী করে ফেলা। বড় আদর্শের ভার থেকে বাঁচার সহজ উপায় হলো নিজেকে ছোটর কাতারে ফেলে বড় আদর্শকে বড়দের সম্পত্তি বলে ঘোষণা করা। মনের দিক থেকে বড় হতে মানুষের কাড়ি কাড়ি বিত্তের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন একটু সচেতনতা, সতর্কতা, চিন্তা, নিজের দিকে একটু ফিরে তাকানো—যা প্রত্যেক মানুষের মাঝে সামর্থ্য হিসেবে আছে যথেষ্ট পরিমাণে। কিন্তু দেখ, যে মানুষটি রুটির জন্য, বিলাসিতার জন্য, আভিজাত্যের জন্য প্রাণান্ত চিন্তা ও পরিশ্রমে অক্লান্ত, সে মানুষটিই মনে করে নিজের দিকে একটু ফিরে তাকানো, মনের ঐশ্বর্যে নিজেকে সাজানো কেবল সক্রেটিসের কর্ম।

জন্মকথা

আমি যখন ছোট ছিলুম তখন রচনা বই থেকে ‘একটি গাছের আত্মকথা’ মুখস্থ করেছিলুম। বইয়ের লেখককে পেলে শুধতুম—জন্মেছিলে মানুষ হয়ে, মিছেমিছি বানিয়ে বানিয়ে গাছের নামে জীবনী লিখতে তোমাকে দিব্যি দিয়ে কে বলেছিল গাছ হওয়ার ভান করতে! আর আমারইবা কি নিয়তি দেখ!—মানুষ হয়ে গাছের জীবনী লিখি, তা-ও আবার পরের লেখা চুরি করে।

শুনেছি, মুসলিমদের প্রথম প্রতিনিধি আবুবকর গাছদেরকে নাকি বেজায় হিংসে করতো—কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে বলতো, আহা! মানুষ না হয়ে যদি গাছ হয়ে জন্মাতুম। তাকে পেলেও শুধতুম, নবীর সত্য বন্ধু, জন্মেছিলে বন্ধনহীন মরুভূয়ে উদার আকাশের নীচে, আর মানুষ না হয়ে মাটির সাথে আটকে থাকা গাছ হয়ে জন্মানোর সাধ জাগল কেন তোমার মনে! জন্মের কথা শুনলে আমার প্রায়ই মনে পরে চতুর্থ প্রতিনিধি আলীর কথা। মায়ের পেটের ভেতর থেকে বেরিয়েই সে পড়েছিল আল্লাহর ঘরের ভেতর। শুনেছি শেষ জীবনে কেঁদে কেঁদে সে কথা বলতো কুপের সাথে। তাকে পেলেও শুধতুম, কাবা’র ভেতর জন্ম নেয়া বাঙময় কোরান,* আবদ্ধ জলের সাথে তোমার এত কিসের কথা।

আমি যখন জন্মেছিলুম আমার মা তখন জেলখানায়। আমি মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে জেলের গরাদের ভেতর এসে পড়লে মা আমার কানে কানে বলেছিল, তুই স্বাধীন। আমার মায়ের নোলক ছিল না—কোন দিনই নোলক পরেনি। কবি’র মায়ের নোলক ছিল। তা হারিয়ে গেলে ছেলে খুঁজে খুঁজে হয়রান। শুধাই বেজিরে, শুধাই সাপেরে। কোথায় পাই কবির মায়ের হারিয়ে যাওয়া সোনার নোলক!

* সিফফিনের যুদ্ধে যখন উমাইয়াদের চরম পরাজয় আসন্ন হয়ে উঠেছিল তখন বর্শায় কোরান বেঁধে তারা সন্ধির প্রস্তাব দিয়েছিল, যদিও যুদ্ধ শুরুর আগে তারা আলীর সব সন্ধি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। বর্শায় বিদ্ধ কোরানের পাতা দেখে খারেজিরা আর যুদ্ধ করতে নারাজ হয়ে উঠলে আলী তাদেরকে উমাইয়াদের চালাকিতে বোকা না হয়ে তাঁর কথামত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, “আই এম দি স্পিকিং কোরান।”

মানপত্র ও অনুকরণ

আমাদের পূর্বপুরুষেরা হাঁটতেন সামনের দিকে তাকিয়ে; মাঝে মাঝে পিছন ফিরে তাকাতেন—যেন খেই হারিয়ে না ফেলেন। আমরা হাঁটি উল্টোভাবে, পিছন দিকে মুখ করে; মাঝে মাঝে সামনের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই, যদি হোঁচট খাই—এই ভয়ে।

আমরা তৈরি করি পূর্বপুরুষদের সমাধি। আমরা লিখি জীবনী, লিখি ইতিহাস, লিখি অতীতের সমালোচনা। করি বার্ষিকী পালন। আর লিখি মানপত্র। হিজ হাইনেস, হিজ মেজেস্টির জাতি ইংরেজরা ভালই শিখিয়ে গেছে, তুর্কি-সাফাভিদ-মোঙ্গলদের শিক্ষাকে আরও পালিশ করে দিয়ে গেছে! আমাদের সব সৃজনী প্রতিভা তাই মানপত্রের সৌকর্যে সীমাবদ্ধ। যেখানেই যাবেন সেখানেই পাবেন ধূলিমলিন কীটভক্ষিত মানপত্রের শৈল্পিক সম্ভার।

অতীত দেখা সহজ—এটি সার্কাস দেখার মতো। দেখে দুদিকেই যেতে পারা যায়—মর্জি মাফিক, খায়েশ মাফিক। কী সাংঘাতিক! কী আশ্চর্য! জিনিয়াস বটে! আবার উল্টোদিকেও যেতে পারেন। ধড়িবাজ! ভেবেছে চালাকিটা বুঝতে পারিনি? আমার চোখকে ফাঁকি দেয়? কিন্তু ভবিষ্যৎ দেখা কঠিন—এটি শিল্পকর্মের মতো, সৃজনী প্রতিভা লাগে।

আমাদের পূর্বপুরুষেরা ঈশ্বরকে দেখেছেন, প্রকৃতিকে দেখেছেন একেবারে যাকে বলে সরাসরি, প্রত্যক্ষভাবে, নিজেদের চোখে; আমরা দেখি বা দেখতে চাই তাঁদের চোখ দিয়ে। আমাদের কেন ঈশ্বরের সাথে, প্রকৃতির সাথে নিজস্ব সম্পর্ক থাকবে না? আমাদের কেন নিজস্ব কবিতা, নিজস্ব দর্শন থাকবে না?—যে দর্শন তৈরি হয় অন্তর্দৃষ্টি থেকে; যা কেবল ঐতিহ্যের কঙ্কালসর্বস্ব অবশেষ মাত্র নয়।

আজও সূর্য আলো দেয় সবাইকে সরাসরি। তাহলে ঈশ্বরের বাণী আমাদেরকে আলো দিতে পারবে না কেন সরাসরি? ফসলের মাঠে, ফলের বাগানে আজ ফলন বেশী। ঈশ্বরের তৈরি প্রকৃতি থেকে আজ যদি আমরা বেশী কিছু আনতে পারি, তবে ঈশ্বরের বাণী থেকে কেন পারব না?

গোলাপেরা হেসে উঠতে চায় মানুষের মতো, আর মানুষ কেবলই শঙ্কিত হয়ে গুটিয়ে যায় অশনি সংকেতের ভয়ে। পাহাড়েরা নানা বৈচিত্র্যে মানুষ হয়ে আকাশের দিকে উঠতে চায়, আর মানুষ কেবলই নত মুখে অবনত হয়ে পড়ে থাকতে চায় মাটি কামড়ে। হাঁটতে গেলে পা ভাঙবে—এই ভয়ে কোন মা তার সন্তানকে নন্দলাল করে রেখেছে? উড়তে গেলে ডানা ভাঙবে—এই ভয়ে কোন মা তার সন্তানকে সরীসৃপ করে রেখেছে?

জগত তৈরি প্রকৃতি ও আত্মা দিয়ে। জগতের সব বস্তু, আমাদের সব কর্ম, আমাদের সব নিপুণতা, আমাদের সব সৃষ্টি, আমাদের দেহটি পর্যন্ত সবই প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতি হলো ফেরেশতারা আর আত্মা হলো আদম। ফেরেশতারাই আদমকে সেজদা করেছিল। আদম কবে ফেরেশতাদের সেজদা করতে গিয়েছিল?

আদমের যে সন্তানেরা উল্টো দিকে সেজদা করে নিজেদের অপমান করবে, তারা নিজেদেরকে উন্নত করতে পারবে না—এটাই নিয়ম। যে মানসিকতা মাথাকে উল্টো দিকে ঠেলে দেয়, সে মানসিকতা মানুষের মধ্য থেকে ভবিষ্যৎ দেখার, নিজের সম্ভাবনাকে দেখার, এবং তা গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় সৃজনশীল ক্ষমতা কেড়ে নেয়।

[Ralph Waldo Emerson এর Nature এর দেড় পৃষ্ঠার ভূমিকা অবলম্বন করে লেখা। প্রায় অর্ধেকটাই তাঁর নয়। কাজেই মিলিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে। আমার লেখার ভুল/খুঁত তাঁর লেখায় নেই।]

অহিংসা

হিংসা দুর্বলের অধঃপতনের অভিকর্ষ।

হিংসার উৎপত্তি বাস্তবিক পরাজয় বোধ থেকে অথবা আসন্ন পরাজয়ের শঙ্কা বোধ থেকে। একজন যখন দেখে যে, সে চরমভাবে হেরে গেছে বা তার পরম বিজয় সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছে, তখন তার মধ্যে হিংসার বিস্তার ঘটে, তার মন বিদ্বিষ্ট হয়ে ওঠে, সে ক্ষোভের জ্বালায় পুড়তে থাকে। আর তখন সে মরিয়া হয়ে প্রোপাগান্ডায় লিপ্ত হয়; বিদ্বেষপূর্ণ কথার দড়িতে শত্রুকে বধ করতে চায় ও অন্যদের মনে হিংসা সঞ্চালন করে নিজের দল ভারী করতে উদ্যত হয়।

অভিকর্ষের প্রভাবে বস্তু নীচের দিকে তাড়িত হয় ও তার গতি বাড়ে অভিকর্ষের অনুপাতে। তেমনই হিংসুকের কথায় বিদ্বেষের মাত্রা বাড়ে বিপন্নতা বোধের মাত্রা অনুসারে। তাই যে যত বেশী বিপন্ন মনে করে নিজেকে সে ততো জোরে চিৎকার। সে তোতাপাখির মত কেবলই আওরাতে থাকে ঘৃণার বচন।

হিংসা একটি দুষ্টচক্রের মত, একটি ভাইরাসের মত। হিংসা শত্রুর অন্তরে কেবলই বুনে চলে নিজের বীজ। হিংসা দিয়ে কেউ নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না, শত্রুকে সাথে নিয়ে কেবলই ঘুরতে থাকে শত্রুর বৃত্তে এবং পরিণামে নিজেকে ধ্বংস করে। লাভের লাভ হয়তো কেবল এটুকুই হয় যে, নিজের লাশটা স্থান পায় শত্রুর লাশের উপর। হিংসা দিয়ে হিংসার চক্র থেকে বের হওয়া যায় না, কেবল নিজের দশাটা লোককে জানান দেয়া হয় মাত্র।

অস্ত্র হিসেবে হিংসা আমাদের খুবই প্রিয় এ কারণে যে, তা ম্যাজিকের মত কার্যকর। মানুষকে নিজের চারপাশে জড়ো করতে ও শত্রুর দুর্গের দিকে চালিত করতে এর চেয়ে বেশী কার্যকর হাতিয়ার আমাদের হাতে নেই। কেন নেই তাও সহজেই অনুমেয়। আমরা আমাদের অনুসারীদেরকে বলতে পারি না যে, “তোমরা আমার মত হও। তাহলে মানুষ হতে পারবে।” সে সাহসই যে আমাদের নেই। তাই আমরা কেবলই চিৎকার করতে থাকি ‘তোমার এই নিয়ে গেল, তোমার সেই নিয়ে গেল’ বলে এবং তারপর কানে ঢেলে দেই হিংসার বিষ।

কিন্তু হিংসার পথে এগুনো যে ইঁদুর তাড়াতে গিয়ে নিজেদের সন্তানদের হারানো, তা আমরা বুঝতে পারছি না; যদিও হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালাকে আমরা ভালই চিনি বলে মনে করি।

[লেখাটা হিংসা নিয়ে, কিন্তু শিরোনামটা ‘অহিংসা’। অর্থাৎ আবেদনটা শিরে থাকল, কারণটা থাকল দেহে।]

পিরামিড থেকে তাজমহল এবং তারপর

মৃতরা নিজের সমাধি গড়ে অনন্তকাল বেঁচে থাকতে চায়; আর সমাধি ও মৃতদেহের ভার বইতে হয় জীবন্ত মানুষকে নিজ জীবনের রিক্ততা ও বঞ্চনার মধ্য দিয়ে।

অনন্ত জীবনের প্রত্যাশায় গড়ে ওঠে পিরামিড আর তাজমহল। পিরামিড ও তাজমহল অহংকারী আকাঙ্ক্ষার চূড়ান্ত প্রকাশ। দুঃখপীড়িত যন্ত্রণাক্লিষ্ট মূর্ত অস্তিত্বশীল মানুষের জীবনের চেয়ে নিজের সুখ তো অবশ্যই, এমনকি মৃতদেহটির মূল্যও এখানে অনেক বেশী। সকলের জন্য জীবন বিকাশের সুযোগ করে দেয়ার চেয়ে এবং সে কাজে সহায়তা করার চেয়ে সৃষ্টি ও নৈপুণ্যের মূল্য এখানে বেশী সাব্যস্ত করা হয়। কারণ সমাধি বা মৃতদেহ নিজেকে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারে না, এখানে সৃষ্টি ও নৈপুণ্যের প্রতি জীবন্তের ভক্তির প্রয়োজন হয়। মানব শিশু প্রতিদিন ’গণ্ডায় গণ্ডায়’ জন্মায় বলে এখানে মানব শিশুর গায়ে পাড়া দিয়ে হলেও মৃতদেহকে রক্ষা করে চলতে হয়।

এর বিপরীতে নবীদের মধ্যে আমরা দেখি নাটকীয়ভাবে ভিন্ন ও সম্পূর্ণ বিপরীত ধরণের জীবন ও জীবনবীক্ষা। এরূপ জীবনের প্রতি তাঁরা মানুষকে আহ্বান করেন এ ধারণাসহ যে, প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যেই এরূপ জীবন গঠনের সম্ভাবনা ও সক্ষমতা বিদ্যমান। তাই তাঁরা ‘আমি যা করি তোমরা তা দেখ’ না বলে বলতেন ‘আমি যা করি তোমরা তা কর’ এবং তাঁরা কখনও ‘আমি যা চাই তা তোমরা আমাকে গড়ে দাও’ আবদারটি করতেন না। বরং মানুষের স্বাধীনতা ও মহিমা ঘোষণার জন্য নবী অহংকারীদের বিচারে সবচে ব্যর্থ বলে গণ্য মানুষটিকে তুলে দেন কাবার ছাদে, যেন মানুষ শুনতে পায় মহিমার মন্ত্র ও দেখতে পায় ইটপাথরের মূল্য।

নুহ নবী মানুষকে বাঁচানোর জন্য নৌকা তৈরি করেছিলেন, ডেকেছিলেন সবাইকে পরম মমতায়, আর স্থান করে দিয়েছিলেন সব প্রজাতির প্রাণকে। কিন্তু ফ্যারওরা নৌকা তৈরি করে নিজের পরিবারের জন্য ও সম শ্রেণীভুক্ত পরিবারগুলোর জন্য; আর সাথে নেয় মোনালিসা জাতীয় অর্জনগুলোকে। সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে তারা কেবল তাদেরকে বেছে নেয় যারা কোন না কোন কায়িক শ্রমে দক্ষ—এটা এ জন্য যে, এদের শ্রম তাদের সুখময় অস্তিত্বের জন্য আবশ্যক।

এ সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির আর একটি বাস্তব প্রকাশ ঘটে যখন মানুষ মদিনার খেজুরপাতা নির্মিত নিরাভরণ সাদামাটা মসজিদটির মধ্যে উচ্চ জীবনবীক্ষার অবস্থিতি দেখতে অক্ষম হয় এবং পরবর্তী কালে তৈরি আল-হামরাসহ নানা শাহী মসজিদের মধ্যে মানুষের সাংস্কৃতিক সম্পদের সন্ধান পায়।

মুসা ফ্যারওয়ের প্রাসাদে দাঁড়িয়ে ফ্যারও-নির্মিত সভ্যতার ফসলের ভাগ চাননি, নিজেদের বকেয়া মজুরীও দাবী করেননি। তিনি কেবল বলেছিলেন, ‘লেট মাই পিপল গো।’ আর ওতেই যে পিরামিড ধ্বসে পড়ে। অন্যদিকে মদিনায় নবী একটি মাত্র মসজিদ তৈরি করেছিলেন—কারও চলে যাওয়ার আবেদনে সাড়া দিলে যা ভেঙ্গে পড়ে না—যেখানে তিনি নিজেও সাধারণ শ্রমিকের মত কাজ করেছিলেন।

মুসার সাথে ফ্যারওয়ের শত্রুতা এবং মদিনার সাথে মক্কার শত্রুতার মধ্যেই নিহিত আছে দুই আদর্শের বৈপরীত্য। পূর্বোক্ত দুই ভাইয়ের সংগ্রাম আর পরের দুই নগরীর সংগ্রাম এ দুই জীবনবীক্ষার চিরায়ত বিরোধের মূর্ত প্রকাশ। সুখের নীতি একটি স্বার্থপর নীতি এবং মমতার নীতি চরম পরার্থপর নীতি। নবীদের সাথে নবীদেরকে যারা শত্রু জ্ঞান করতো তাদের মধ্যকার বিরোধটি এই দুই নীতির বিরোধ।

আমাদের কালে এসে দুটি বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। আমাদের কালে পিরামিড ও তাজমহল বিমূর্ত হয়ে উঠেছে। আগের কালে ইস্রাইলের সন্তানদেরকে শিকল দিয়ে বাঁধতে হয়েছিল, ভারতীয়দের উপর অপ্রয়োজনীয় করের বোঝা চাপিয়ে দিতে হয়েছিল। আগের কালে সাধারণ মানুষ যা অনিচ্ছায় ও দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে করতো, আমাদের কালে আমরা তা স্বেচ্ছায় ও সানন্দে করতে শিখেছি।

মৃতের খোয়াবনামা

বাস্তবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি নিজেকে দেখার চেষ্টা করি না। বরং কাক’কে কিভাবে ময়ূরপুচ্ছ দিয়ে সাজানো যায় সে’ফিকির নিয়ে দাঁড়াই ও সাজানোর কোশেশ করি। কিন্তু স্বপ্ন তো স্বপ্নই—বাস্তব নয়, বাস্তবাধিক কিছু। অবচেতন মনের সব গহ্বর, অলিন্দ আর চোরাপথগুলোয় সেখানে আলো পড়ে ও উৎকটভাবে সেসব উদ্ভাসিত হয়। গতরাতে যখন ঘুমিয়ে ছিলাম তখন আমার গুরুজী শয়তান চুলের মুঠি ধরে টেনে-হিঁচড়ে আমাকে এক আয়নার সামনে নিয়ে ফেলে ও বাতাস বিদারী হুংকার দিয়ে বলে, “দ্যাখ্।” আমি মাথা তুলে তাকিয়ে ছিলাম আয়নার দিকে, যেভাবে সদ্য আকাশ হারানো উদ্ভ্রান্ত নারী আলুথালুভাবে বসে নিজেকে খুঁজে ফেরে। বেঁচে থাকলে মরে যেতাম, না থাকায় লেখার সুযোগটি পেয়ে গেলাম! যা দেখলাম তার বিবরণ, যিনি ভাববেন ও আমার জন্য কাঁদবেন তাঁর উদ্দেশ্যে লিখে দিলাম।

যুক্তিবাদ

আমি যুক্তিনিষ্ঠ যুক্তিবাদী। আমি ঈশ্বরকে দেখিতে পাই না বলিয়া তাঁহার উপাসনা করি না। আমি বস্তু দেখিতে পাই, তাই বস্তুর উপাসনা করি। ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’, তাই আমি সর্বদা রুটি খুঁজিয়া বেড়াই। ঈশ্বরের বচনে আমি সাড়া দেই না, কারণ আমি অনন্ত স্বর্গের প্রলোভন হইতে মুক্ত। আমি জ্ঞানের মধুভাণ্ডে বৃত্তের পরিধি বরাবর পিপীলিকার ন্যায় চলি এবং দৃষ্টির ক্ষীণতাকে একটি ‘পস্টুলেট’ ধরিয়া বক্রপথকে সরলপথ সাব্যস্ত করি। আমি কার্য-কারণের পশ্চাদগতি ছাড়িয়া কারণ-কার্যের সম্মুখগতিতে চলি। আমি ফল দ্বারা বৃক্ষকে চিনিতে চেষ্টা করি না বরং বৃক্ষের নাম সুন্দরী রাখিয়া ফলের পরিচয় নির্ণয় করি; ফল-গরলে দেহ আকণ্ঠ নীল হইয়া উঠিলে নীলকে রাঙ্গা ভাবিয়া কাব্য রচনা করি।

দ্বন্দ্বমূলক নীতিবাদ

আমি মার্ক্সের ন্যায় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী নহি, আমি মার্ক্সের শিক্ষকের ন্যায় দ্বন্দ্বমূলক ভাববাদীও নহি। আমি সার্বজনীন দ্বন্দ্বমূলক নীতিবাদী। আমি এক্ষণে একক্ষেত্রে যে নীতি প্রয়োগ করি, পরক্ষণেই অন্যক্ষেত্রে তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত নীতি প্রয়োগ করিয়া থাকি।

যোগের শিক্ষার প্রয়োগ

আমি তুচ্ছ ও মিথ্যা মায়ার সূত্রসকল ছিন্ন করিয়া নিজেকে তমসা ও রাজসিকতা হইতে মুক্ত করিয়াছি এবং সাত্ত্বিক হইবার সাধনায় নিয়োজিত হইয়া নিজেকে বিশ্বব্যাপী প্রসারিত করিয়া চলিয়াছি। আমি নিজের মাকে ছাড়িয়া অন্যের মাকে মা বলিয়া ডাকি, নিজের ভাইকে ছাড়িয়া অন্যের ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি, নিজের বউকে ছাড়িয়া অন্যের বউকে বউ বলিয়া ডাকি।

প্রেমের শিক্ষার প্রয়োগ

রাজশক্তির কোন মালিক বা অর্থশক্তির কোন নকিব আমার নিকট আমার জামাটির জন্য আব্দার করিলে আমি বত্রিশ পাটি দন্ত বিকশিত করিয়া তাহাকে আমার কোটটি পর্যন্ত দিয়া দেই। তিনি তাহার সহিত এক মাইল যাইতে বলিলে আমি তাহার তল্পি লইয়া তুষ্টচিত্তে দুই মাইল গমন করি। আমি খাজনা আদায়কারীদের মত নহি। আমি নিজের পীড়া ভুলিয়া শত্রুর চিকিৎসায় মত্ত থাকি। শত্রুর চোখে ধূলির কণায় আমি অস্থির হইয়া যাই। নিজের চোখের কড়িকাঠের জ্বালা ভুলিয়া তাহার সেবা করি। আমি বন্ধুর দোষ গোপন রাখি, প্রকাশ করিয়া তাহাকে হেয় করি না। দুষ্টজনের কর্মকাণ্ড আমি দেখিয়াও দেখি না, খুঁজিয়া-পাতিয়া তাহার কোন ভাল কাজের সন্ধান পাইলে, না পাইলে পরের কাজ চুরি করিয়া, উহা ফেরী করিয়া বেড়াই।

ন্যায়ের শিক্ষার প্রয়োগ

আমি ন্যায়বিচারে প্রস্তরবৎ অনমনীয়। শত্রু দেখিলে তাহার চুলচেরা বিচার করিয়া ও তন্ন তন্ন করিয়া ত্রুটি অনুসন্ধান করিয়া বেড়াই, এবং কণামাত্রের সন্ধান পাইলে, না পাইলে মিথ্যা অপবাদ দিয়া, ন্যায়ের স্বার্থে ন্যায়ের দাবীতে ঢোল পিটাইতে থাকি। ছিঁচকে চোর আমাকে দেখিলে ডাকাত ভাবিয়া পড়শির ঘরে লুকায়। ডাকাতের সরদার আমাকে দেখিলে খুনি ভাবিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ায়। আমার মুখের কাব্য শুনিয়া সিঁধেল চোরের মুখরা মা-ও শরমে মরিয়া যায়, আমার হাতের কাণ্ড দেখিয়া পিরামিডের মালিক মমি ছাড়িয়া পালায়।

পরিত্রাণ

আমি পরিত্রাণের মঞ্চ প্রস্তুত করি। সুখী তাহারা যাহারা দরিদ্র, স্বর্গরাজ্যের অধিকার তাহাদেরই। তাই যাহারা দারিদ্র্য হইতে মুক্তির সম্ভাবনারহিতভাবে দরিদ্র আমি তাহাদের নিকটেও যাই না। যেই সকল দরিদ্রের বাড়ীর মাটির নীচে মণিমুক্তা লুক্কায়িত, পাছে উদ্ধার করিয়া তাহারা স্বর্গরাজ্য হারায়—এই ভয়ে সুরঙ্গ কাটিয়া মণিমুক্তা গোপনে নিজের বাড়ীতে আনিয়া রাখি। কেহ ধনী হইয়া উঠিলে সকল পথে গিয়া আমি তাহাকে পুনরায় স্বর্গরাজ্যের উপযুক্ত করিয়া তুলি। আমি নিরীহ মানুষের এক গালে কষিয়া চড় মারিয়া তাহার জন্য অপর গাল পাতিয়া দেওয়াকে সহজ করিয়া দেই।

সংস্কৃতি

আমি কৃষকেরটা খাইয়া, শ্রমিকেরটা পরিয়া উদ্বৃত্ত মূল্য দিয়া বাঁদরনাচ দেখি এবং সংস্কৃতির উচ্চতা ও বিস্তার পরিমাপ করিয়া উদ্বৃত্ত সময় কাটাই। আমি ‘চাষার বাচ্চা’, ‘মজুরের বাচ্চা’ দুটি গালি বিশেষ বলিয়া লিখি এবং বাঁদরের গলায় মুক্তার মালা দিয়া তাহাকে ‘সেলিব্রিটি’ বলিয়া মানি।

বাস্তববাদ

আমি বাস্তববাদী, আবেগপ্রবণ নহি। আমি দূরের হরিণগুলিকে দৌড় প্রতিযোগিতায় মাতাইয়া দিয়া আমার নিকটে ছুটাইয়া আনি এবং সেরাটির গলায় মালা দিয়া তাহার মাংস ভক্ষণ করি। আমি সম্পদের কমতির কারণে বাধ্য হইয়া কেবল নিজের জন্য প্রাসাদ নির্মাণ করি আর বিহঙ্গদের সকলের জন্য গড়িয়া দেই একটি স্মৃতিসৌধ। উহারা বনবাদাড়ে ঘুরিয়া মরে ও ফুল ছিঁড়িয়া আনে, আমি প্রাসাদে বসিয়া গান গাহিয়া সেই ফুলমধু পান করিয়া যাই।

মৈত্রীর দূত

আমি ঈশ্বর ও শয়তানের মাঝে মিলনবিন্দু। আমি এক হাতে ধরিয়াছি ঈশ্বরের হাত, অন্য হাতে হাত শয়তানের। আমি কাশী গিয়া ঈশ্বরের পূজা দেই আর ভিটায় ফিরিয়া শয়তানের পায়ে দেই ফুল। আমি ঈশ্বরেরে আত্মাকে স্থাপন করি শয়তানের ক্রুশে। আমি বুকের ভিতর শয়তানকে রাখিয়া নিজেকে রাখি ঈশ্বরের ঘরে। আমি ঈশ্বরের বাণী বর্শায় বিঁধিয়া সওয়ার হই শয়তানের ঘোড়ায়। আমি ঈশ্বরের থেকে যাহা পাই তাহা তুলিয়া দেই শয়তানের হাতে, নিজের জন্য কানাকড়িটিও রাখি না—যেন ঈশ্বর তুষ্ট থাকেন আমার আমানতদারীতে আর শয়তান তুষ্ট থাকে সব পাইয়া।

ভার্চুয়াল

আমি স্বনির্ভর, আমি ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী। আমি পরের অনুগ্রহে প্রাপ্ত স্বচ্ছ সুধাজল ঘরের কোনায় রাখিয়া স্বোপার্জিত বিষের আগুনে জ্বলিয়া পুড়িয়া মরি। আমি পরের তৈরি আকাশের দিকে চাহিয়াও দেখি না, আমি পরের তৈরি সাগরের জলে অঙ্গ ভিজাই না, আমি পরের তৈরি মাটির সাথে খেলায় মাতি না। আমার জগত আমার জীবন আমার মনের মত করিয়া আমারই নিজের গড়া।

গণতন্ত্র

আমি গণতান্ত্রিক। আমি সজ্জনদিগের কথায় কর্ণপাত পর্যন্ত করি না, কারণ তাহারা সংখ্যালঘু। আমি দুর্জ্জনদিগের প্রতি মন পাতিয়া রাখি ও তাহাদের মন্ত্রণায় জীবনের ডালি সাজাই, কারণ তাহারা সংখ্যাগরিষ্ঠ।

সমাজতন্ত্র

আমি সমাজতন্ত্রী। আমি নিজে না ভাবিয়া সমাজের প্রবাহে ভাসিয়া বেড়াই, বিচার না করিয়া পিতৃপুরুষদিগের পদাঙ্ক দেখিয়া চলি।

কার্যবিভাজন

আমি যাহার যাহা কাজ তাহা তাহার জন্য রাখিয়া দেই, অন্যের কাজে নাসিকা সঞ্চালন আমার কর্ম নহে। আমি নিজে চিন্তা করি না, চিন্তার ভার ইব্রাহিমের মাথায় থাকুক। আমি নিজে কান পাতিয়া শুনি না, শোনার ভার মুসার কানেই থাকুক। আমি নিজে কর্ম করি না, কর্মের রথ কৃষ্ণের হাতেই থাকুক। আমি নিজে ভাবি না, ভাবনার রাজ্য বুদ্ধই ভোগ করুক। স্বীয় জীবনের ক্রুশ আমি নিজে বহন করি না, ক্রুশের ভার যীশুর কাঁধেই থাকুক। আমি নিজের পথ নিজে পাড়ি দেই না, চলার দায় মুহম্মদের কাছেই থাকুক। আমার কাজ তাঁদের ঘাড়ে সওয়ার হইয়া অগ্নি-পিতার চুলায় কাষ্ঠ দেওয়া।

তারা-বাতি কাহিনী

টমাস আলভা এডিসন বিদ্যুতের প্রবাহ থেকে আলো আবিষ্কার করেছিলেন।

দর্শন শাস্ত্রের পর মানব সভ্যতার বিকাশের ইতিহাসই সম্ভবত সবচে বেশী কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়। পাথরের যুগ, আগুনের যুগ, লোহার যুগ ইত্যাদি কত নামেই না সভ্যতার বিকাশস্তরগুলিকে পরিচিত করা হয়েছে। হাঁটিহাঁটি পা-পা করে করে এখন আমরা দৌড়ঝাঁপ দিয়ে বেড়াচ্ছি। আমরা যে কালে বাস করছি তার জুতসই নাম কি হতে পারে? বিদ্যুতের যুগ? যে দুটি কৌশল আমরা যে আগারে বাস করছি তা নির্মাণ করেছে সে দুটি হল চক্র-গোলকের ঘূর্ণন-কৌশল ও ইলেকট্রনের প্রবাহ-কৌশল। ইতোমধ্যে ঘূর্ণনশক্তির উৎস যথেচ্ছভাবে ঢুকে পড়েছে বিদ্যুতের প্রবাহ জগতে। কাজেই বিদ্যুৎ-প্রবাহ-কৌশলটিই যে আমাদের যুগাবয়বের চন্দ্রটীকা তা একরকম বলাই যায়।

১৮৮০ সালে এডিসন বিদ্যুতের প্রবাহ থেকে প্রথম আলো উৎপাদন করেছিলেন। তাঁর নিকট আমাদের ঋণের কথা স্মরণ করছি এবং খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি সে ঋণ আমাদেরকে কি পরিমাণ দেউলিয়া করেছে তা।

এডিসনের আলোর বর্তিকা বা কুপির ঝালরে নগরগুলি এখন রাতের বেলা হাস্যময়ী, লাস্যময়ী হয়ে উঠেছে। এ হাসি আর লাসি অর্থাৎ হাস্য আর লাস্য-এর প্রাপ্তিযজ্ঞাগ্নিতে কি বলী দিতে হয়েছে তা ভাবনার একটি বিষয় হতে পারে বলে আমরা এখন আর ভাবতেও পারছি না—হারানোর ব্যাপ্তি এতই বিশাল। নগরের আকাশে তারার রাজ্য দেখা যায় না—এ তথ্যটি নগরবাসী অনেক ছেলেমেয়েই আজ জানে না। তারা তারাদের অস্তিত্ব ও অবস্থানজগত সম্বন্ধে জানতে পারে ভূগোল বই থেকে—যেন তারা’রা ম্যাক্র-ওয়ার্ল্ডে ইলেকট্রন-প্রোটনের মত কিছু—চোখে দেখার বস্তু না, যৌক্তিক কায়দায় তৈরি মডেলের উপাদান মাত্র। তারাদের রাজ্য কী, তা জানে গ্রামের ছেলেমেয়েরা, যারা ঈষদঠান্ডায় কাঁথামুড়ি দিয়ে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দের অনুপম তানে আত্মার কথা শুনতে পায়।

গ্রামের প্রকৃত রূপটি দূর থেকে দেখা যায় না। দূর থেকে তাকালে নারীর মুখের হাসিটি দৃষ্ট হলেও তার মনের কথাটি যেমন অশ্রুত থেকে যায়, গাড়ীর জানালা দিয়ে গ্রাম দেখার ব্যাপারটিও সেরকম। গ্রামকে বুঝতে হলে গ্রামের অন্তরে প্রবেশ করতে হয়। গ্রামের অন্তর থেকে মধ্যরাতে উঠানে শুয়ে আকাশের দিকে তাকালে তবে অনুভব করা যায় তারাদের রাজ্যের মহিমা। যে অনুভূমে অন্ধকারে গাঢ়ত্ব নেই, নিস্তব্ধতায় ঘনত্ব নেই, মাটির বিস্তার নেই, জলের শব্দ নেই, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক নেই, বৃক্ষের রহস্যময়ী মায়াবী অবয়ব নেই সেখানে তারারাজ্যের আসল প্রদর্শনী নেই। তাই সে অনুভূম থেকে আকাশের দিকে উল্লম্ব প্রেক্ষায় ফল হয় না।

আমরা জানি ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করেছেন মানুষের জন্য। বিগব্যাং থেকে পৃথিবীর উৎপত্তির মধ্যে কালগত সুবিশাল ব্যবধানের ও পৃথিবীর উৎপত্তিকালে জগতের অর্জিত সুবিশাল বিস্তারের কী প্রয়োজন ছিল বোঝা মুশকিল।[১] আজ আমরা যেরূপ মানুষ সেরূপ মানুষ তৈরির জন্য শুধু একটি পৃথিবীই কি যথেষ্ট ছিল না? এত বিশাল দেশগত বিস্তার ও এত প্রলম্বিত কালের মহাসমারোহের বা আয়োজনের মর্ম বা মূল্য বা উপযোগিতা কী? সেখানে তখন তো দেখার জন্য বা শোনার জন্য কেউ ছিল না; অর্থাৎ সে জগতে রূপ ছিল না, সুর ছিল না।[২] আপনি যদি গ্রামে যান এবং মাঝরাতে তারাভরা আকাশের দিকে তাকান তবেই ঈশ্বরের মনে কি ছিল তা কিঞ্চিৎ অনুভব করতে পারবেন, যে অনুভব থেকে নগরবাসীরা বঞ্চিত।

তারাহীন আকাশের নীচে বসবাস আমাদেরকে পরিণত করেছে প্রজাতির ইচ্ছার কাছে সমর্পিতপ্রাণ যম্বিতে। যম্বিদের মত চলাচলই যেন আমাদের জেহাদ আর প্রজাতির ইচ্ছার নিকট সদাপ্রণত থাকাই যেন আমাদের এবাদত। মানব জীবনের যে মূল্যমানগুলির অভিব্যক্তি জীবনের বিকাশের মাত্রাকে নির্দেশ করে তার সাথে যেন আমাদের চিরকালের বৈরিতা। ভাবছেন—কী! এত বড় কথা!! প্রমাণ দিতে না পারলে সাড়ে তিন হাত দেখে নেবেন—এই তো! তাহলে একটি নিরাপদ উদাহরণ দেয়া যাক। গ্রামের কৃষকেরা মার্ক্সীয় তত্ত্বানুসারে নগরের শ্রমিকগণের সমশ্রেণীভূক্ত। কিন্তু গ্রামের কৃষকেরা সর্বহারা হওয়া সত্ত্বেও আজও লালন করে চলেছেন আত্মার অনেক ঐশ্বর্য। নগরের শ্রমিকেরা কি করে একেবারে সর্বস্বসর্বহারা হয়ে উঠলেন তার রহস্য জানে আকাশের তারারা।

টমাস আলভা এডিসনের কুপির ঝালর আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে সীমিত করেছে মাটির বলয়ে, আর কেড়ে নিয়েছে তারাভরা আকাশের অসীম রাজ্য।

[১] ভাববাদীদের উত্থাপিত সমস্যাগুলো আমলে ইচ্ছে করেই নেইনি, সুবিধার জন্য, এবং ধরে নিয়েছি যে বিজ্ঞান জগতের সারপদার্থকে ‘দেখতে’ পায়।

[২] বিজ্ঞানের নিয়মে এগোলেও ‘রূপ-সুরের’ সমস্যাটি থেকেই যায়।