Do to others what you would have them do to you, for this sums up the Law and the Prophets. (Gospel according to Matthew 7:12)
Stand out firmly with justice as witnesses for God, even if it be against yourselves or parents and relatives, be he rich or poor. (Koran 4:135)

মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩

আমাদের ইনোসেন্স

আমাদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি বলে একটি কথার বেশ চল আছে। একজন মুসলিম কারও জীবন, সম্পদ ও সম্মানে যেমন আঘাত করতে পারে না, তেমনই পারে না কারও ধর্মীয় অনুভূতিতেও আঘাত করতে। কিন্তু কথা হচ্ছে একজন মুসলিমের কি ধর্মীয় অনুভূতি বলে কিছু থাকতে পারে?—যে ধর্মীয় অনুভূতিতে অন্যে এত সহজেই আঘাত করতে পারে? এমন অনুভূতি যতদিন আমাদের মধ্যে কাজ করবে ততদিন বুঝতে হবে যে, আমরা নবীদের মানসিক দৃঢ়তা ও তাদের চিন্তার বলিষ্ঠতা আয়ত্ত করতে পারিনি।

এক ব্যক্তি নবীর বাড়ীতে এক বোতল মদ নিয়ে গিয়ে তা নবীকে উপহার দিতে চাইল। এতে নবী তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কি জান না যে আল্লাহ এটি আমাদের জন্য নিষিদ্ধ করেছেন? এই প্রশ্নটি এমন যার উত্তর দুটির একটি হতে বাধ্য—না অথবা হ্যাঁ। উভয় উত্তরই ব্যক্তিটির জন্য বিব্রতকর। সে যদি বলে “হ্যাঁ”, তবে তো সে নিজেই নিজের নিকট ধৃত অবস্থায় দেখতে পাবে। আর যদি হয় “না”—তবে, যদি সে ভদ্রলোক হয়ে থাকে তবে অজ্ঞতাবশত এ কাজ করার জন্য তাকে দুঃখিত হতেই হবে। আর যদি সে জেনেশুনেই তা করে তবে ‘না’ বলে যতই দুঃখ প্রকাশ করুক, সে যে মিথ্যাচারী তা তার নিজের কাছে আর অজানা থাকে না।

নবীর আমলে মসজিদে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা উদাহরণ হিসেবে আমরা উল্লেখ করতে পারি। জনৈক ব্যক্তি বিশ্বাসীদেরকে অপমান করার জন্য মসজিদে প্রবেশ করে স্বয়ং নবীর উপস্থিতিতে প্রস্রাব করে দিয়েছিল। এ দেখে কেউ কেউ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলে ও তাকে মসজিদ থেকে বের করে দিতে চাইলে নবী বলেছিলেন, তাকে শান্তিমত কাজটি শেষ করতে দাও। আগন্তুক তার কাজ শেষ করলে নবী তাঁর অনুসারীদেরকে বলেছিলেন মেঝেতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ঢেলে দিতে। প্রস্রাবকারীকে পরে তিনি শুধু বলেছিলেন, তুমি কি জান না এটি প্রস্রাব করার স্থান নয়?

নবীকে উপহাস করার কাজটি নতুন কিছু নয়। সকল নবীকেই স্ব স্ব সম্প্রদায়ের কাছ থেকে উপহাস পেতে হয়েছে। নবীর অনুসারীদেরকেও নিজেদের চোখ কান দিয়ে তা দেখতে শুনতে হয়েছে। কিন্তু তারা তা অবলীলায় উপেক্ষা করেছেন। নবীরা তাদেরকে তা উপেক্ষা করতেই শিক্ষা দিয়েছিলেন। নবীদের ও তাদের অনুসারীদের আত্মমর্যাদাবোধ এতো ঠুনকো ছিল না যে এতো সহজেই বা কেবল উপহাসেই তা ভেঙ্গে পড়তে পারে। উপহাসকারী নিজেকে এমন বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত করে যে সে বিশ্বাসীর মনোযোগ লাভের উপযুক্ততা হারায়।

নবীকে নিয়ে যারা উপহাস করে সিনেমা তৈরি করল তাদের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান যার ফলে তারা এবিষয়ে বিশ্বাসীদের মনোযোগ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে। এমন উপহাস বইয়ের মাধ্যমে বহু করা হয়েছে, করা হচ্ছে ইন্টারনেট ভিত্তিক ওয়েবে, এখন সিনেমার মাধ্যমে করলেই বা কি? যে ব্যক্তি এমন স্থূল চিত্রায়ন দেখে বিভ্রান্ত হয় সে আমাদের দলে না আসলেও আমাদের তেমন ক্ষতি নেই। আর যে হয় না সে আমাদের প্রতি বিরূপ হবে না। মানুষকে ধরে ধরে জান্নাতে নেয়ার কোন দায় তো আমাদেরকে কেউ দেয়নি। তার উপর আমরা কার কাছে প্রতিবাদ করছি? কার কাছে প্রত্যাশা করছি? আমাদের দেশের সরকারের এখানে করার কিছু নেই—ওরা আমাদের আইনের আওতায় নেই। আমেরিকা তোমার আমার বাসনামত বিচার করবে না—তার কাছে বিচার প্রত্যাশা করাটাও এরূপ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য করণীয় নয়।

আমরা আরও দেখলাম রাষ্ট্রদূতসহ কয়েকজন নিহত হলেন। যাদের নিরাপত্তা দেয়া আমাদের কর্তব্য ছিল, আমাদের অঙ্গীকারের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তারা জীবন হারালেন। নানা দেশে নিজেদের মানুষ নিহত হল, সম্পদ বিনষ্ট হলো। নবীর প্রতি যে ভক্তি, যে প্রীতি হেন পরিণাম এনে দেয় তা নবীদের শিক্ষার একেবারে ১৮০ ডিগ্রী বিপরীত দিকে চলার ফল। এটি একটি বিরাট অত্যাচার এবং নিজেদের দিক থেকে বৌদ্ধিক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক হীনমন্যতাবোধের চরম প্রকাশ। এহেন লজ্জাজনক দুষ্কর্মের পর বিশ্বের সামনে এখন আমাদের “পরের ভিক্ষা চাই না, নিজের দুর্বৃত্ত সামলাও” দশা হয়েছে। আমরাই আমাদের নিজেদের এবং নিজেদের ধর্মের প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছি। যারা এপথে মানুষকে ডাকে তাদেরকে উপেক্ষা করা, তাদের এরূপ ডাকে সাড়া না দেয়া এবং তাদের সম্পর্কে সতর্ক হওয়াও আমাদের আরেক কর্তব্য হয়ে উঠেছে।

গতবার যখন নবীকে নিয়ে ডেনিশরা কার্টুন আঁকল তখন আমি কানাডার কুইবেক সিটিতে। আমাদের প্রশিক্ষক ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল ও আন্তরিক মানুষ। হোটেলে কানাডীয় চ্যানেলের খবরে প্রথম শুনলাম কার্টুনটির কথা। এ নিয়ে আমাদের প্রশিক্ষকেরও আগ্রহ ছিল আমাদের সাথে ভাব বিনিময় করার। তিনি তাঁর নিজের গাড়ীটিতে করেই হোটেল থেকে আমাদেরকে তুলে নিয়ে যেতেন ফ্যাক্টরিতে। নিজেই ড্রাইভ করতেন। আমি বসতাম তাঁর পাশের সিটটিতে। একদিন তিনি আমাকে জানালেন, কানাডীয় মুসলিমরা একটি ডেমনস্ট্রেশনের আয়োজন করেছে। কিন্তু এতে আমার তেমন আগ্রহ না দেখে তিনি সরাসরিই প্রশ্ন করলেন: আচ্ছা তোমরা এতো হৈচৈ কর কেন? অন্যদেরও তো মত প্রকাশের অধিকার আছে। উত্তরে আমি বললাম, দেখ, তোমরা কোথায় কি কার্টুন এঁকেছ তা আমরা জানতাম না। সে পত্রিকায় প্রতিদিন কার্টুন আঁকা হয়। কোন কার্টুনের খবর টিভিতে আসে না। ওটার খবর তোমরা টিভিতে প্রচার করলে কেন? আমরা যে দেখিনি সেটা তোমাদের মনপুত হয়নি—তাই তোমরা আমাদেরকে একরকম জোর করেই দেখিয়েছ। কেন? তিনি বললেন, আমি ওভাবে আগে চিন্তা করে দেখিনি। মনে হয় তোমার পয়েন্টটা আমি ধরতে পেরেছি।

এরপর আমি তাকে অনেক কথা বললাম। তিনি গাড়ী চালাতে চালাতে মন দিয়ে শুনলেন। বললাম: দেখ, এখন তোমরা এগিয়ে আছ, মানবসমাজকে নেতৃত্ব দেয়ার সামর্থ্য তোমাদেরকে আল্লাহ দিয়েছেন। কাজেই তোমাদের দায়িত্ব বেশী—এটা তো তোমরা অস্বীকার করতে পার না। আমরা এই যে কষ্ট পাই, হৈচৈ করি তাও তো তোমরা জান। তবে আমাদেরকে কষ্ট দিতে চাও কেন? আজ থেকে ৫০০ বছর পর আমরাও হৈচৈ করব না। আমাদেরকে এগিয়ে আনার ক্ষেত্রে তোমরা কাজ করবে, আমাদেরকে সহায়তা করবে এটা কি কেউ আশা করতে পারে না? মধ্যযুগে তোমরা জঙ্গলে বাস করতে। জেরুসালেমে তোমাদের একটি গির্জা এক পাগল ফাতেমী শাসক ভেঙ্গে দিয়েছিল। কিন্তু সেজন্য তার উত্তরসুরী শাসক দুঃখিতও হয়েছিলেন। বাইজেন্টাইনদের তত্ত্বাবধানে ও কারিগরি সহায়তা নিয়ে গির্জাটি তিনি নতুন করে তৈরি করেও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই পাগল ও ব্যতিক্রমী শাসকের কাজটিকে অবলম্বন করে ক্রুসেডের নামে সভ্য জেরুসালেমে তোমরা মুসলিমদের মাংস রান্না করে খেয়েছ। তারপরও সেকালে এগিয়ে থাকা মুসলিমরা কি তোমাদের সাথে দায়িত্বহীন কাজ করেছে? সালাদিনকে তো তোমরা ভাল করেই চেন।

আমাদের প্রশিক্ষক বললেন, আমি তোমাদেরকে ভাল বুঝি। কারণ আমি শিক্ষক এবং আমার ছাত্রদের অনেকেই মুসলিম বিশ্বের নানা দেশ থেকে আসা। তবে তোমরাও ফাঁদে পা না দিতে শেখ। ওতেই তোমাদের কল্যাণ।

কেউ যদি আমার কোরান, আমার বাইবেল বা আমার গীতার কপিটি নিয়ে পুড়িয়ে দেয় তবে আমি কী করতে পারি? সেটি সংগ্রহ করতে আমার যে অর্থ খরচ হয়েছে তা আমি তার কাছে দাবী করতে পারি। আমার কপি পোড়ানোর অধিকার তাকে তো আমি দেই নি। কিন্তু যদি সে তার নিজের পকেটের টাকা খরচ করে পোড়ায় তাতে আমার কি আসে যায়? সে যত ইচ্ছা কিনুক আর পোড়াক—তার টাকা বা তার বাপের টাকা সে আগুনে দিল কি জলে ফেলল তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। কেউ যদি তার ঈশ্বরের সামনে, তার সমাজের প্রাজ্ঞজনদের সামনে নিজেকে বোকা বানায় তবে আমাদের তো কোন ক্ষতি হয় না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন