Do to others what you would have them do to you, for this sums up the Law and the Prophets. (Gospel according to Matthew 7:12)
Stand out firmly with justice as witnesses for God, even if it be against yourselves or parents and relatives, be he rich or poor. (Koran 4:135)

মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩

চিন্তকদের কর্তব্য

মাছের পচন ধরে মাথা থেকে। সমাজের পচন ধরে চিন্তকদের বিচারে ভ্রান্তি, পক্ষপাত ও দ্বৈতনীতির কারণে। চিন্তক বলতে আমি তাঁদেরকে বুঝচ্ছি আমাদের সমাজে সাধারণত যাঁদেরকে বুদ্ধিজীবী বা চিন্তাবিদ বলা হয়ে থাকে। এই চিন্তকদের মধ্যে পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, দার্শনিক, কবি, সাহিত্যিক, সংবাদপত্রের সম্পাদক, শিল্পী ও তাঁদের মত ব্যক্তিবর্গকে। একটি সমাজের মানুষেরা ভুল করতে পারে, রাজনীতিবিদেরা ভুল করতে পারে। কিন্তু চিন্তাবিদেরা সমাজের জাগ্রত অভিভাবকের মত তাদের ভুলগুলিকে ধরিয়ে দেবেন, কেন সেগুলো ভুল তা ব্যাখ্যা করবেন এবং মানুষকে সঠিক পথের দিশা দিয়ে ফিরে আসতে উদ্বুদ্ধ করবেন। এই গুরুদায়িত্ব তাঁদের দ্বারা পরিত্যক্ত হলে সমাজ হারায় পথের দিশা, হারায় কাণ্ডারি।

আমাদের সমাজের অবস্থাটি কী? এখানে সংকীর্ণ রাজনৈতিক বলয়ে বিভক্ত হয়েছে কেবল সাধারণ মানুষেরাই নয়, সমাজের অভিভাবকরাও। কিন্তু চিন্তকের চিন্তা ও কথার মধ্যে নিজ রাজনৈতিক মতের, সেই মত অবলম্বনকারী রাজনৈতিক দলের প্রতি নির্বিচার পক্ষপাত থাকা সমাজের জন্য মঙ্গলজনক হয় না। সমাজে যদি একটি অত্যাচারের, নিষ্ঠুরতার, অমানবিকতার ঘটনা সংঘটিত হয় তবে দলমত নির্বিশেষে মিলিতভাবে নিন্দা করাই তাঁদের কর্তব্য। কিন্তু দেখা যায়, নিন্দা যাদের জন্য সুবিধা প্রদায়ী হয় তারাই কেবল নিন্দার ঝড় তোলেন। নিজের অনুসারীর গায়ে আঁচড়টিও আমরা সহ্য করি না, কিন্তু প্রতিপক্ষের কাউকে নির্মমভাবে আঘাত করার দৃশ্য দেখেও নীরব হয়ে থাকি। এনীতিকে অনেকে আক্ষেপ করে অভিহিত করে থাকেন রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি হিসেবে।

এ অবস্থানের পিছনের চিন্তাটি কী? আমরা নানা মতে বিভক্ত হয়েছি। কিন্তু এটি তো স্বাভাবিক। এতে অসুবিধার কিছু তো ছিল না। অসুবিধা হয়ে দাঁড়ায় যখন আমরা এই সিদ্ধান্ত নেই যে, মতের সাথে মতের এই বৈপরীত্য নিছক মতের বৈপরীত্য মাত্র নয়, এটি রীতিমত যুদ্ধাবস্থা; যদি প্রতিপক্ষকে সমূলে উৎখাত করা যায়, বিনাশ করা সম্ভব হয় তবেই কেবল সমাজের, জাতির অগ্রগতি সম্ভব। এজন্য সকল পন্থা অবলম্বন করাকে বৈধ মনে করা হয়। গণতন্ত্র, মূল্যবোধ, মানবতা, প্রগতি—এসব মহান ধারণা ও আদর্শ রাজনৈতিক সংগ্রামের হাতিয়ারে পরিণত হয়।

এই রকম অবস্থা যে মনোভাবের উন্মেষ ঘটায় তা অত্যন্ত ভয়াবহ—এ মনোভাব থেকেই তৈরি হয় উগ্রপন্থা; অনুমোদন পায় উগ্রপন্থা। সমাজের সার্বজনীন ও সর্বকালীন মূল্যবোধগুলো সম্পূর্ণ ধ্বসে পড়ে। এপথে কেয়ামত তক দৌড়ালেও উন্নতি হবে না। এই মনোভাব নিয়ে প্রাথমিক সফলতা হিসেবে যদি আজকের প্রতিপক্ষকে সম্পূর্ণ বিনাশ করাও সম্ভব হয় তবুও না। একসময়ের একমতাবলম্বীরা তখন এমিবার মত বিভাজিত হবে এবং বিনাশের যুদ্ধের প্রয়োজন আবার দেখা দেবে। এ যুদ্ধের অবসান কখনই হবে না।

সে মানুষটিও অনেক ভাল যে অন্যায় করেও সেটিকে অন্যায় মনে করে; জিজ্ঞেস করলে কাজটিকে সে অন্যায় বলেই স্বীকার করে। কিন্তু চিন্তকরা যখন নিজের মতের অনুসারীদেরকে যুদ্ধংদেহী করে তোলেন ও তাদের অন্যায়-অবিচার-অত্যাচারকে সবাক হয়ে বা মৌন থেকে অনুমোদন দেন তখন সমাজ কেবল বিশৃঙ্খলই হয়ে উঠে না, মূল্যবোধেরও পতন ঘটে। তখন অন্যায় করেও একজন নিজেকে ন্যায়ের আপোষহীন যোদ্ধা মনে করে বসে।

চিন্তাবিদদের প্রধান কর্তব্যই হচ্ছে নিজ মতের অনুসারীদের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখা ও তাদেরকে সঠিক পথের নির্দেশনা দেয়া, নিজের কোন অনুসারীকে অন্যায় করতে দেখলে তার প্রতি বিরক্তি ও কঠোরতা প্রদর্শন করা, তাকে সর্তক করা। কোন আদর্শের অভিভাবকবৃন্দ যখন তাদের অনুসারীদেরকে প্রতিপক্ষের দুর্গের দিকে চালিত করতেই কেবল সক্ষম হন, কিন্তু নৈতিকভাবে গড়ে উঠার জন্য আবেদন করে কোনরূপ সাড়া পেতে কেবলই ব্যর্থ হন, তখন অভিভাবকদের কর্তব্য হয় নিজেদের দিকে ফিরে তাকানো।

যোদ্ধা তৈরি করা সেনাপতিদের কাজ। চিন্তাবিদদের কাজ মূল্যমান ও মানবতা সংরক্ষণে নিরপেক্ষভাবে ও জোরালোভাবে কাজ করে যাওয়া।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন