Do to others what you would have them do to you, for this sums up the Law and the Prophets. (Gospel according to Matthew 7:12)
Stand out firmly with justice as witnesses for God, even if it be against yourselves or parents and relatives, be he rich or poor. (Koran 4:135)

সোমবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৩

ভক্তির ভারে লুণ্ঠিত মর্যাদা

ফুলের যেমন মধু, মৃগের যেমন কস্তূরী, মানুষের তেমন মর্যাদা। মধুর ভার যে ফুলের কাছে অসহনীয়, সে ফুলের করুণ আলেখ্য লেখার ভার তোমার মত বিজ্ঞানীর হাতেই থাকল। কস্তূরিকার ভার যে মৃগের কাছে অসহ্য, তার সর্বনাশের কাব্য রচনার ভার তোমার মত কবির হাতেই থাকল। আমি কেবল মানুষের মর্যাদার ভার নিয়ে দুটি কথা বলি। মানুষের কাছে মর্যাদার ভার যেন এক অসহনীয় ভার, অস্পৃশ্য ভার, বিপদজনক ভার।

যেখানেই যাই সেখানেই দেখি ভক্তির ভারে ভূলুণ্ঠিত ন্যুব্জ মানুষ। সামন্তের পায়ে, পুঁজিপতির পায়ে লুণ্ঠিত মানুষ। ব্রাহ্মণের পায়ে, ক্ষত্রিয়ের পায়ে লুণ্ঠিত মানুষ। ভয়ের দেবতা আর বাসনার দেবীর পায়ে লুণ্ঠিত মানুষ। পচে-গলে খসে যাওয়া মাংসের ভেতর থেকে বের হয়ে পড়ে থাকা কঙ্কালের পায়ে লুণ্ঠিত মানুষ। সংস্কার আর কুসংস্কারের প্রেতদের পায়ে লুণ্ঠিত মানুষ। অত্যাচার আর স্বেচ্ছাচারের দেবতাদের পায়ে লুণ্ঠিত মানুষ। পিরামিড আর তাজমহলের পাষাণে লুণ্ঠিত মানুষ। ধুলোয় ধূসরিত মানুষের কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলি, ব্যাটা ওঠ্, মাথা উঁচু করে দাঁড়া, তোর চেয়ে বড় কেউ নেই এক ভগবান ছাড়া। অবিশ্বাসের চাহনি তারও চোখে মুখে। বলে, বাবু! আমিও বড়! এও কি সত্যি কথা!

তুমি মানুষকে কাড়ি কাড়ি টাকা দাও। নিয়ে বলবে, আরও দাও। এক পাহাড় দিয়ে দেখ। নিয়ে বলবে, কাঁধ যে আমার দুটো ছিল গো। কিন্তু মর্যাদা দিয়ে দেখ দেখিন। দেখবে কিভাবে সন্দেহের চোখে চাইতে শুরু করে সবাই। আমার একুল ওকুল দুকুলের শিক্ষকবৃন্দেরই কান হয়ে উঠে খাড়া। ভাবে, এ যে দেখি আমাদের ভিতটাই ভেঙ্গে দিতে চায়; এ যে দেখি আমাদের পিতাদের ধর্মের, ব্যবস্থার ঘোর শত্রু। এ তস্কর কোন সুমেরিয়’র কুঠার হাতে নিয়ে ঘুরে? রক্ষা কর! রক্ষা কর! তোমাদের দেবতাদের রক্ষা কর!

এ সংসারে বঙ্কিমচন্দ্র একটি শব্দ সর্বদা শুনতে পেতেন, ‘অমুক বড় লোক—অমুক ছোট লোক।’ তিনি আরও লিখেন, “এটি কেবল শব্দ নহে। লোকের পরস্পর বৈষম্য জ্ঞান মনুষ্যমণ্ডলীর কার্য্যের একটি প্রধান প্রবৃত্তির মূল। অমুক বড় লোক, পৃথিবীর যত ক্ষীর সর নবনীত সকলই তাঁহাকে উপহার দাও। ভাষার সাগর হইতে শব্দরত্নগুলি বাছিয়া বাছিয়া তুলিয়া হার গাঁথিয়া তাঁহাকে পরাও, কেন না, তিনি বড় লোক। যেখানে ক্ষুদ্র অদৃশ্যপ্রায় কণ্টকটি পথে পড়িয়া আছে, উহা যত্নসহকারে উঠাইয়া সরাইয়া রাখ—ঐ বড় লোক আসিতেছেন, কি জানি যদি তাঁহার পায়ে ফুটে। এই জীবনপথের ছায়াস্নিগ্ধ পার্শ্ব ছাড়িয়া রৌদ্রে দাঁড়াও, বড় লোক যাইতেছেন। সংসারের আনন্দকুসুম সকল, সকলে মিলিয়া চয়ন করিয়া শয্যারচনা করিয়া রাখ, বড় লোক উহাতে শয়ন করুন। আর তুমি—তুমি বড় লোক নহ—তুমি সরিয়া দাঁড়াও, এই পৃথিবীর সামগ্রী কিছুই তোমার জন্য নয়। …”

শুরু করেছিলাম মর্যাদা নিয়ে, বঙ্কিমের কথায় এসে পড়লাম বৈষম্যের মাঝে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে মর্যাদার চরম সমতা অস্বীকার করার প্রায়োগিক পরিণতি হচ্ছে এই বৈষম্যজ্ঞান। কেউ নিজেকে বড় মনে করলেও অত সমস্যা থাকতো না। সমস্যা প্রকট হয়ে দাঁড়ায় যখন কেউ তা মেনে নিয়ে নিজেকে ছোট সাব্যস্ত করে বসে। এখানেই প্রকৃত প্রস্তাবে বৈষম্যের আসল জয়। কেউ তোমাকে ছোট করতে পারবে না, যাবত না তুমি নিজেই তা মেনে নিচ্ছ। মেনে না নিলেই আর কথিত ‘চিরনমস্য’ বা ‘প্রাতঃস্মরণীয়’দের আশীর্বাদ বা চরণধূলির তেষ্টা লাগে না।

মিনিবাসে বসে দেখি, ছিন্নবসন যাত্রীকে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে আরেক ছিন্নবসন কন্ডাকটর। দুজনকেই আবার দেখি ধুপদুরস্তবসনকে সসম্মানে পথ ছেড়ে দিতে। দপ্তরের সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করি, কেমন আছেন? উত্তর মেলে, আপনার দোয়ায় ভাল আছি। রাখেন ভগবান, মারেন ভগবান। ভগবানের কথা সে মনে রাখে না। মানুষের দোয়ায়, মানুষের আশীর্বাদে মানুষের বুঝি ভাল থাকা হয়! পীরের মাজারে গিয়ে দেখ কিভাবে মানুষ নিজেকে অপমানিত করে। তুমি কি দেখনি কিভাবে কত রকমের গুরুর পায়ে নিজেকে সমর্পণ করে মানুষ? আরও দেখ, চারদিকে চেয়ে দেখ—তোষামোদের ছড়াছড়ি, তোষামোদের জয়জয়কার। নিজেকে ছোট না করে কে কবে অন্যের তোষামোদ করতে পেরেছিল তুমি খুঁজে দেখ দেখি।

অমুকে সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান বলে লোকে সার্টিফিকেট দেয়। ‘সম্ভ্রান্ত’ শব্দের অর্থ কী কে জানে! তবে ইংরেজি করে অনেকে লিখেন ‘এরিস্টোক্রেটিক’ ইত্যাদি। মানুষে মানুষে সাম্য রক্ষার দুর্গ থেকেও অসাম্যের দ্যোতনাযুক্ত কথা মাঝে মাঝে ভেসে আসে। যাঁরা চোখে কালো পট্টি বেঁধে অফিস করেন, কে ‘বড়’ কে ‘ছোট’ তা দেখতেই চাননা, তাদের কণ্ঠেও শোনা যায়, অমুক সমাজের শ্রদ্ধাভাজন বিধায় তাঁকে বিব্রত করতে তাঁরা খুবই অনীহ। অর্থাৎ, আমাদের সলিম মিঞা বা ভজন কুমার যে অখ্যাত, নগণ্য, অগণ্য; কাজেই তারা কেউ বিব্রত হলো কি হলো না তা তেমন বিবেচ্য বিষয় নয়। দেখা যায়, তাদের জামার কলার ধরে টেনে আনলেও দোষ হয় না।

নিজেকে ছোট জ্ঞান করার চূড়ান্ত বিষফল হচ্ছে ছোট আদর্শের ঘেরে নিজেকে বন্দী করে ফেলা। বড় আদর্শের ভার থেকে বাঁচার সহজ উপায় হলো নিজেকে ছোটর কাতারে ফেলে বড় আদর্শকে বড়দের সম্পত্তি বলে ঘোষণা করা। মনের দিক থেকে বড় হতে মানুষের কাড়ি কাড়ি বিত্তের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন একটু সচেতনতা, সতর্কতা, চিন্তা, নিজের দিকে একটু ফিরে তাকানো—যা প্রত্যেক মানুষের মাঝে সামর্থ্য হিসেবে আছে যথেষ্ট পরিমাণে। কিন্তু দেখ, যে মানুষটি রুটির জন্য, বিলাসিতার জন্য, আভিজাত্যের জন্য প্রাণান্ত চিন্তা ও পরিশ্রমে অক্লান্ত, সে মানুষটিই মনে করে নিজের দিকে একটু ফিরে তাকানো, মনের ঐশ্বর্যে নিজেকে সাজানো কেবল সক্রেটিসের কর্ম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন