Do to others what you would have them do to you, for this sums up the Law and the Prophets. (Gospel according to Matthew 7:12)
Stand out firmly with justice as witnesses for God, even if it be against yourselves or parents and relatives, be he rich or poor. (Koran 4:135)

সোমবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৩

পিরামিড থেকে তাজমহল এবং তারপর

মৃতরা নিজের সমাধি গড়ে অনন্তকাল বেঁচে থাকতে চায়; আর সমাধি ও মৃতদেহের ভার বইতে হয় জীবন্ত মানুষকে নিজ জীবনের রিক্ততা ও বঞ্চনার মধ্য দিয়ে।

অনন্ত জীবনের প্রত্যাশায় গড়ে ওঠে পিরামিড আর তাজমহল। পিরামিড ও তাজমহল অহংকারী আকাঙ্ক্ষার চূড়ান্ত প্রকাশ। দুঃখপীড়িত যন্ত্রণাক্লিষ্ট মূর্ত অস্তিত্বশীল মানুষের জীবনের চেয়ে নিজের সুখ তো অবশ্যই, এমনকি মৃতদেহটির মূল্যও এখানে অনেক বেশী। সকলের জন্য জীবন বিকাশের সুযোগ করে দেয়ার চেয়ে এবং সে কাজে সহায়তা করার চেয়ে সৃষ্টি ও নৈপুণ্যের মূল্য এখানে বেশী সাব্যস্ত করা হয়। কারণ সমাধি বা মৃতদেহ নিজেকে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারে না, এখানে সৃষ্টি ও নৈপুণ্যের প্রতি জীবন্তের ভক্তির প্রয়োজন হয়। মানব শিশু প্রতিদিন ’গণ্ডায় গণ্ডায়’ জন্মায় বলে এখানে মানব শিশুর গায়ে পাড়া দিয়ে হলেও মৃতদেহকে রক্ষা করে চলতে হয়।

এর বিপরীতে নবীদের মধ্যে আমরা দেখি নাটকীয়ভাবে ভিন্ন ও সম্পূর্ণ বিপরীত ধরণের জীবন ও জীবনবীক্ষা। এরূপ জীবনের প্রতি তাঁরা মানুষকে আহ্বান করেন এ ধারণাসহ যে, প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যেই এরূপ জীবন গঠনের সম্ভাবনা ও সক্ষমতা বিদ্যমান। তাই তাঁরা ‘আমি যা করি তোমরা তা দেখ’ না বলে বলতেন ‘আমি যা করি তোমরা তা কর’ এবং তাঁরা কখনও ‘আমি যা চাই তা তোমরা আমাকে গড়ে দাও’ আবদারটি করতেন না। বরং মানুষের স্বাধীনতা ও মহিমা ঘোষণার জন্য নবী অহংকারীদের বিচারে সবচে ব্যর্থ বলে গণ্য মানুষটিকে তুলে দেন কাবার ছাদে, যেন মানুষ শুনতে পায় মহিমার মন্ত্র ও দেখতে পায় ইটপাথরের মূল্য।

নুহ নবী মানুষকে বাঁচানোর জন্য নৌকা তৈরি করেছিলেন, ডেকেছিলেন সবাইকে পরম মমতায়, আর স্থান করে দিয়েছিলেন সব প্রজাতির প্রাণকে। কিন্তু ফ্যারওরা নৌকা তৈরি করে নিজের পরিবারের জন্য ও সম শ্রেণীভুক্ত পরিবারগুলোর জন্য; আর সাথে নেয় মোনালিসা জাতীয় অর্জনগুলোকে। সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে তারা কেবল তাদেরকে বেছে নেয় যারা কোন না কোন কায়িক শ্রমে দক্ষ—এটা এ জন্য যে, এদের শ্রম তাদের সুখময় অস্তিত্বের জন্য আবশ্যক।

এ সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির আর একটি বাস্তব প্রকাশ ঘটে যখন মানুষ মদিনার খেজুরপাতা নির্মিত নিরাভরণ সাদামাটা মসজিদটির মধ্যে উচ্চ জীবনবীক্ষার অবস্থিতি দেখতে অক্ষম হয় এবং পরবর্তী কালে তৈরি আল-হামরাসহ নানা শাহী মসজিদের মধ্যে মানুষের সাংস্কৃতিক সম্পদের সন্ধান পায়।

মুসা ফ্যারওয়ের প্রাসাদে দাঁড়িয়ে ফ্যারও-নির্মিত সভ্যতার ফসলের ভাগ চাননি, নিজেদের বকেয়া মজুরীও দাবী করেননি। তিনি কেবল বলেছিলেন, ‘লেট মাই পিপল গো।’ আর ওতেই যে পিরামিড ধ্বসে পড়ে। অন্যদিকে মদিনায় নবী একটি মাত্র মসজিদ তৈরি করেছিলেন—কারও চলে যাওয়ার আবেদনে সাড়া দিলে যা ভেঙ্গে পড়ে না—যেখানে তিনি নিজেও সাধারণ শ্রমিকের মত কাজ করেছিলেন।

মুসার সাথে ফ্যারওয়ের শত্রুতা এবং মদিনার সাথে মক্কার শত্রুতার মধ্যেই নিহিত আছে দুই আদর্শের বৈপরীত্য। পূর্বোক্ত দুই ভাইয়ের সংগ্রাম আর পরের দুই নগরীর সংগ্রাম এ দুই জীবনবীক্ষার চিরায়ত বিরোধের মূর্ত প্রকাশ। সুখের নীতি একটি স্বার্থপর নীতি এবং মমতার নীতি চরম পরার্থপর নীতি। নবীদের সাথে নবীদেরকে যারা শত্রু জ্ঞান করতো তাদের মধ্যকার বিরোধটি এই দুই নীতির বিরোধ।

আমাদের কালে এসে দুটি বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। আমাদের কালে পিরামিড ও তাজমহল বিমূর্ত হয়ে উঠেছে। আগের কালে ইস্রাইলের সন্তানদেরকে শিকল দিয়ে বাঁধতে হয়েছিল, ভারতীয়দের উপর অপ্রয়োজনীয় করের বোঝা চাপিয়ে দিতে হয়েছিল। আগের কালে সাধারণ মানুষ যা অনিচ্ছায় ও দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে করতো, আমাদের কালে আমরা তা স্বেচ্ছায় ও সানন্দে করতে শিখেছি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন