Do to others what you would have them do to you, for this sums up the Law and the Prophets. (Gospel according to Matthew 7:12)
Stand out firmly with justice as witnesses for God, even if it be against yourselves or parents and relatives, be he rich or poor. (Koran 4:135)

বুধবার, ৮ এপ্রিল, ২০২০

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এবং এম.আই.বি

আমাদের আব্দুল্লাহর মুখ দেখে আজ বুঝার উপায় নেই যে অহিফেনের সাথে তার কোন কালে কোন সম্পর্ক ছিল। ফুরফুরা মেজাজ দেখে অবাক হয়ে তত্ত্ব-তালাশ করতে লেগে গেলাম, ব্যাপার কী আব্দুল্লাহ, বউ-মেয়ে নিয়ে কেমন আছ? আমার মতোই আমাদের আব্দুল্লাহর একটি মাত্র বউ এবং একটি মাত্র সন্তান। প্রশ্নের ধারে-কাছে না গিয়ে সে কেতাবি ঢংয়ে শুরু করে দিল, দাদা! কাজের মানুষের যখন কাজ থাকে না তখন সে অকাজ করে বেড়ায়। আর আমার মতো অকাজের মানুষের যখন কাজ করার সখ হয় তখন সে টেলিভিশন নামের বাক্সটির রিমোট কন্ট্রোল নিয়ে শয্যাশায়ী হয়। ইদানীং আমি এই যাদুর বাক্সতে কি হয় না হয় তা নিয়ে বেশ বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছি। আবার, জানেনই তো, মানুষ যখন তেলের অভাবে চলার শক্তি হারায়, বলার শক্তি হারায়, সোজা হয়ে দাঁড়ানোর মুরদ হারায়, তখন সে আঁতেল হয়। বিতরণেই জ্ঞানের সার্থকতা - তা আপনার মতো আঁতেল মাত্রই জানেন। তাই না, দাদা!

বাক্স নিয়ে গবেষণা করে আব্দুল্লাহ যে একটা মজার কিছু আবিষ্কার করেছে তা বুঝতে পারলাম। এই বাক্স ও বাক্সের তাসির নিয়ে আমারও কৌতূহল কম নয়। আমাদের কালের গণ-দাস-মন তৈরিতে এটি যে ফ্যারওয়ের আমলের যাদুকরদের মতই যাদুকরী তা অনেকেরই অলক্ষ্যে থেকে যায়। আব্দুল্লাহ নিজেই কথা পাড়ে ও বলে। এটা তার স্বভাব। সে ভণিতাসহ কথা পাড়ল, দাদা! আজ আমি দুইটা মুভি ও দুইটা সিরিয়ালের সাথে আপনার পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। তা বেশ তো, বলে আমি কান খাড়া রেখে বইতে মন দিলাম। কেন জানি না আজ তার কথা শুনতে আমার ভাল লাগছিল না।
দাদা, ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ নামটির সাথে আপনার পরিচয় তো অনেক কালের। আব্দুল্লাহর কথায় আমার মেরি শেলী’র নামটি মনে পড়ে গেল। তার লেখা বই ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, অর দি মডার্ন প্রমিথিউস’। এ বইয়ের কাহিনী নিয়ে নানা সময়ে তৈরি চলচ্চিত্রগুলো নামটির বিস্তারে বেশী সহায়ক হয়েছে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন একজন ডাক্তার ও বিজ্ঞানী। কবর খুড়ে খুড়ে সে মৃতদের নানা অঙ্গ যোগাড় করত। এবং ল্যাবরেটরিতে সেসব একসাথে জুড়ে দিয়ে সে তৈরি করতে চেয়েছিল তার আদর্শ মানব। এই মানব নড়েচড়ে উঠলে সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে চিৎকার করেছিলেন ‘ইটস এলাইভ’ বলে। কিন্তু সৃষ্টি তার হয়ে উঠেছিল এক মনস্টার; যে শেষে তার স্রষ্টা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকেই হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল। কাহিনীর একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের একটি নাম আছে, পরিচয় আছে; কিন্তু তার সৃষ্টির কোন নাম নেই - সে কেবলই ‘দি মনস্টার’।
১৭৯৭ সালে লন্ডনে জন্ম নেয়া মেরির জন্মের আগেই ফরাসি বিপ্লব ঘটে গিয়েছে। আর ইংল্যান্ডে তখন চলছে শিল্প বিপ্লবের ধুমধাম। একের পর এক বিশাল বিশাল সব বিজ্ঞানী আর চোখ ধাঁধানো সব উদ্ভাবকের মধ্যে যেন একটা মার মার কাট কাট রবে প্রতিযোগিতা চলছে। মানুষ সরে যাচ্ছে একে অপর থেকে। আর, সবচে বড় কথা, প্রকৃতি থেকে। কৃত্রিম পরিবেশে কৃত্রিম মানুষের আগমনের আশংকায় শঙ্কিত হয়ে উঠছে তখনকার রোমান্টিকতাবাদীরা। এ রকম একটি সময়ে জন্মানো মেরি তার স্বামী কবি শেলী, স্বামীর বন্ধু কবি বায়রন এবং তাদের সমকালীন কবি কোলরিজ ও কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের রোমান্টিসিজম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে উঠেছিলেন। এসময়ের পটভূমিতে ভবিষ্যতের আশঙ্কার চিত্র তুলে ধরতে চাইলেন মেরি তার লেখা ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ বইতে একটি অনবদ্য কাহিনীর মধ্য দিয়ে।
আমার মুখের দিকে চেয়ে এ নিয়ে পাণ্ডিত্য দেখানোর চেষ্টা করাটা সুবিধেজনক হবে না বুঝতে পেরে আব্দুল্লাহ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ছেড়ে সোজা অন্যগুলো নিয়ে পড়ল। দাদা, ‘মেন ইন ব্ল্যাক’ বা এম.আই.বি হচ্ছে হাল জমানার হিরো ছেলেপুলেদের কাছে একটি প্রিয় ছবি। খালি কি তাই? এম.আই.বি’রা তাদের কেতা ও ফ্যাশনেরও আদর্শ। এই এজেন্টরা একেবারে যাকে বলে মহাজাগতিক রক্ষী। তারা স্বরাজের বাসিন্দা। আপনার আমার কথা তাদের কাছে কেবলই ক্যারিক্যাচার। এখানে দেখি আরেক যুদ্ধ। দুষ্টদের হাত থেকে মহাবিশ্বকে রক্ষা করার মিশন নিয়ে নিবেদিতপ্রাণ তারা কত কী যে করে যায়, দাদা, দেখলে তাজ্জব হতে হয়। আপনি যা-ই দেখেন, যা-ই শোনেন তা ভুলিয়ে দেয়ার আলকেমিও তাদের দখলে।
সনি টিভিতে দুটো সিরিয়াল একবারও মিস না করে নিয়মিত দেখেই চলেছি। ঘড়ি ধরে অপেক্ষা। একটা ‘সি.আই.ডি’ আরেকটা ‘আদালত’। আমি প্রসন্নভাগ্য, দাদা, মেয়েটারও এই দুইখান বেশ পছন্দ। গণতন্ত্রের নিয়মে ফেঁসে গিয়ে বেচারি বউ এখানে লাজওয়াব, লাচার। তার সোপ অপেরা ততক্ষণ বন্ধ। তবে মজার কাণ্ড, ‘আদালত’ আর ‘সি.আই.ডি’কে এনে এক এপিসোডে জোড়া লাগিয়ে দেয়া হলো। এই ক্রসওভারের কথা ভাবলে আপনার নিশ্চয়ই গা শিউরে উঠে - কে.ডি বনাম এ.সি.পি! সি.আই.ডি আদালতে! কী ধুন্ধুমার লড়াই! যদি দেখতেন! আহা! একই ভাবে হলিউডও যদি ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ আর ‘এম.আই.বি’কে জোড়া দিয়ে দিত তবে কেমন দেখার মতোই না হতো? ভাবতে পারেন, দাদা?

সাথে সাথেই ভুলটা বুঝতে পেরে আর ভুল না করে পরক্ষণেই বলল, দাদা, বেয়াদবি নেবেন না। আপনার কল্পনাশক্তি যে আমার শক্তির চেয়ে অনেক বেশী তা না বুঝার মতো অবুঝ অন্য যে-ই হোক আমি কিন্তু না। চোখ বুজে একটু কল্পনা করেন তো দাদা। নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন মহাধুন্ধুমার সব একশন। এম.আই.বি’রা বিশেষ কায়দায় দৃষ্টিনন্দন কেতায় ঢুকে পড়ছে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ল্যাবরেটরিতে। স্রষ্টাকে হত্যা করতে উদ্যত অবাধ্য, বিগড়ে যাওয়া মনস্টারের সাথে তাদের সে কী কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ! এর হাতে রে-গান তো ওর হাতে সব-ভুলানো’র অষুধঅলা যন্ত্র। আপনি নিশ্চয়ই আরও শুনতে পাচ্ছেন এজেন্টদের চিৎকার, গো গো গো, এবং তাদের অধিনায়কের কণ্ঠে একালের সেরা ডায়ালগ, “কিল দি মনস্টার এন্ড সেইভ ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইন।”

কিন্তু আমার মুখের ভাব দেখে চতুর আব্দুল্লাহর বুঝতে বাকী রইল না যে এ যাত্রা সে ভুল করেছে। আমি তার ছাইপাঁশ কথার আগা-মাথা কোন মানে যে বুঝতে পারি নি এটি বুঝতে পেরে এবং কী জানি কী মনে করে সে বোকার মতো কৈফিয়তের সুরে মরিয়া হয়ে ‘সত্যি’ শব্দটির উপর বেজায় জোর দিয়ে বলল, দাদা! আজ কদিন ধরে আমি সত্যি আফিমের ধারে কাছেও যাইনি। বুঝলাম অনেক দিন ধরেই পকেট খালি যাচ্ছে, ফলে মাথা গুলিয়ে গেছে। তার মুখ থেকে নিস্তার লাভের ব্যবস্থা করতে আমি বই রেখে মানিব্যাগের খোঁজে উঠে দাঁড়ালাম।

[ছবিগুলো ওয়ার্ড ওয়াইড ওয়েব থেকে গুগল সার্চ করে পাওয়া।]

কথার কচায়ন

পারমেনাইডিসের কথা মেনে নিলে বলা সম্ভব, এ-গাঙ ও-গাঙ, যত গাঙেই পা নামানোর চেষ্টা করো না কেন ব্যাপারটা আখেরে একই। গাঙে গাঙে ফারাক নেই। চেষ্টা থাকে নানা প্রেক্ষিত থেকে দেখার, নানা ঢংয়ে উপস্থাপনার। তবু পোস্টগুলো ঘুরে ফিরে একই বলয়ে থেকে যায়—বৈচিত্র্যহীন, একঘেয়ে। তার উপর, একটি সমাজ বা জাতি যখন অস্থির থাকে তখন অস্থিরতার বিষয়টিতেই সকলে আগ্রহী হয়ে থাকেন। স্বাভাবিক মনস্তাত্ত্বিক কারণেই অন্যান্য বিষয়ে আমাদের মন বসে না। তারও উপর এই ব্লগ হচ্ছে সিটিজেন জার্নালিজমের ধারায় গড়ে উঠা। এরকম ব্লগে দর্শন থাকতেই পারে, কিন্তু তা নিশ্চয়ই একটি অপ্রধান ও পার্শ্ব বিষয়। সব সাংবাদিকতামূলক পত্রিকাতেই দর্শন-সাহিত্য-শিল্পকলার স্থান থাকে এবং একই নিয়মে এই ব্লগেও চিন্তা-দর্শন নামের একটি ক্যাটাগরি সন্নিবিষ্ট হয়েছে। তবুও শেষ কথা হচ্ছে এটি কোনোভাবেই প্রধান বিষয় নয়। আগামী ফেব্রুয়ারিতে বিডিনিউজ২৪ ব্লগের আরেকটি বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। এর প্রাক্কালে কী লেখা যায় তা নির্ধারণ করাও আমার জন্য কষ্টকর হচ্ছে। ভাবছি এই ছুতায় ব্লগ লেখার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করে নেয়া যাক।

ব্লগ লেখা হচ্ছে ভাষা নিয়ে কারবার। ভাষার তিনটে দোষ রয়েছে: এক. ভাষার সীমাবদ্ধতা; দুই. ভাষার সীমা ছাড়ার স্বভাব; ও তিন. কথকের ভাষা-অদক্ষতা। যেকোনো বচনের নানা অর্থ করা চলে। কথক কী বলতে চেয়েছেন আর পাঠক কী বুঝছেন তার মধ্যে অমিল থেকে গেলে যোগাযোগটাই ব্যর্থ হয়ে পড়ে। ফলে অর্থকে পরিষ্কার করতে হলে আরও বচন দরকার। কিন্তু সে বচনগুলোও তো একই সমস্যায় আক্রান্ত। কোনো বচনে যে শব্দগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলোর অর্থ অন্যসব অব্যবহৃত শব্দের অর্থের উপরও নির্ভর করে। গরু বলতে কেবল গরুই বুঝায় না; এটাকে ছাগল নয়, মহিষ নয় ইত্যাদি দিয়েও বুঝতে হয়। ফলে বচনের পর বচন সাজিয়ে কথাকে সম্পূর্ণ করা তো যায়ই না, বরং উল্টো নানা অসঙ্গতি তৈরি হয়।
ভাষার আবার সীমা ছাড়ার প্রবণতাও রয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের কোনো এক মিসির-আলী-গল্পের বইয়ে একটি ধাঁধা দেখেছিলাম। ধাঁধাটি এরকম: জীবনভর জলে বাস করা একটি প্রাণী সারাটা জীবন ডাঙাতেই থাকে, এক মুহূর্তের জন্যও তা পানিতে বাস করে না; প্রশ্ন হচ্ছে, এ প্রাণীটি থাকে কোথায়? বইটির শেষে অবশ্য উত্তরটি দেয়াও হয়েছে: কল্পনায়। কিন্তু আমাদের মনে কি সত্যি এমন প্রাণী বাস করে? আমরা কি এমন প্রাণী সত্যি কল্পনা করতে পারি? এটি তো আমাদের বুদ্ধির বা চিন্তার বা যুক্তির মূল নিয়মের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বাঘের মাথায় শিং, ঘোড়ার ঘাড়ের উপর মানুষের মাথা—আমরা এসব কল্পনা করতে পারি। কিন্তু জলে বাস না করা জলবাসীকে তো কল্পনায় আনতে পারি না। তা হলে এ প্রাণীটা থাকে কোথায়? কোথাও না কোথাও তো প্রাণীটা আছে—তা না হলে প্রাণীটার কথা উঠলো কী করে? এ প্রাণীটা ভাষায় থাকে। ভাষায় এমন সব জিনিসও থাকতে পারে যা জগতে না থাকলেও, আমাদের কল্পনায় না থাকতে পারলেও, দিব্যি ভাষার দুনিয়ায় উন্মেষিত হতে পারে।
এবার বিচার করে দেখুন উপরের প্যারার শেষ বাক্যে “জগতে না থাকলেও” কথাটার “জগত” শব্দটিকে। উপরে পড়ার সময় আমার এই কথাটিকে অনেকে ঠিক বলেই হয়তো ধরেছেন। আসলেই তো! মিসির আলীর প্রাণীটি জগতে নেই, বাস্তবে নেই, আমাদের ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণের দুনিয়ায় নেই; আবার কল্পনা মাত্র করাও যাচ্ছে না। কিন্তু রাসেলের মতো বাস্তববাদী বলবেন, না, এ প্রাণীটিও বাস্তব; তা আছে ভাষায়, ভাষাও জগতেরই অংশ, জগত বাস্তব। কাজেই মিসির আলীর প্রাণীটিও জগতেই কোনো না কোনো অর্থে বাস্তব হিসেবে বিদ্যমান। ভাষায় হেঁয়ালির আরও একটি উদাহরণ দেয়া যাক। আমি যদি বলি, “আমি সত্যবাদী”—তবে কথাটি সত্য হতেও পারে আবার মিথ্যাও হতে পারে, কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই অসঙ্গতি তৈরি হবে না। কথাটি সত্য হলে আমি সত্যবাদী, মিথ্যা হলে মিথ্যাবাদী। কিন্তু যদি বলি, “আমি মিথ্যাবাদী”—তবে আমার কথাটি সত্য হলে আমি মিথ্যাবাদী, এবং মিথ্যা হলে আমি সত্যবাদী। এখানে একটি উদ্ভট অসঙ্গতি তৈরি হয়।
এখন তা হলে দার্শনিকদের অবলম্বন এই ভাষা নিয়ে কী করা যায়? সব দার্শনিকের অধিবিদ্যাকেই ‘আজাইরা’ বলে ফেলে দেয়া বা সব নীতিবিদের জীবনবীক্ষাকে ‘অসম্পূর্ণ, একপেশে’ বলে দাবী করা সম্ভব। কিন্তু আপনি সব জ্যোতিষীকে এভাবে ফেলে দিতে পারবেন না। তাদের কারও না কারও ভবিষ্যৎবাণী ফলেই থাকে। ফাইনাল খেলার দিন এক জ্যোতিষী যদি বলেন আর্জেন্টিনা জিতবে, তো আরেকজন বলবেন ব্রাজিলের নাম। একজন তো সঠিক হবেনই। আমার জীবনে করা যৎসামান্য জ্যোতিষী-বচনের সবগুলোই বেঠিক প্রমাণিত হয়েছে। আর সাহস নেই। কাজেই দর্শনের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু না বলে বরং তার দুরবস্থা নিয়েই তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। জ্যোতিষীর কাজ জ্যোতিষেরাই করুক।
সবশেষে আছে কথকের বচন তৈরিতে অদক্ষতা। এই অদক্ষতার ফলে তৈরি হতে পারে ভুল বুঝাবুঝি। সব কথা স্পষ্ট করে বলা যায় না—নানা সীমাবদ্ধতার কারণে। যাও বা বলা যায় তাও ঠিকভাবে বলা হয় না। সঠিকভাবে বলার চেষ্টা করেও ভাষার নিজ দোষে সফল হওয়া যায় না। ফলে এন্তার বিভ্রান্তি, অসংলগ্নতা, স্ববিরোধীতা তৈরি হতে পারে। এই সূত্রটি বোধ হয় একেবারে বেঠিক নয়: মানবসমাজের গুরুতর সংকটগুলোর মূলে রয়েছে যোগাযোগে অদক্ষতা। আর যোগাযোগের জন্য যে সিম্বল বা রিপ্রেজেন্টেশনই ব্যবহার করি না কেন তা আদতে ভাষারই অন্তর্ভুক্ত। তবে শুধু এতটুকুতেই অনেকে তুষ্ট হবেন না। তারা বলবেন, ভাষাটা উৎস নয়, উৎস হলো মন। মনের ভেতর যে প্রবণতাগুলো রয়েছে সেগুলোকে প্রাকসিদ্ধভাবে সঠিক ধরে নেয়ার কারণে বা সেগুলোকে যুক্তির আবরণে সিদ্ধ করে রাখার কারণেই স্বাভাবিক ভুল বুঝাবুঝি তো বটেই, এমনকি ইচ্ছাকৃত ভুল বুঝাবুঝি সম্ভব।
সে যা-ই হোক, ভাষা নিয়ে এতো গোল সত্ত্বেও কিছুটা অবাকও হই। গোটা চারেক বছরে ১৯০টা পোস্ট করা গেছে। এদের মধ্য থেকে গোটা চল্লিশেক ফেলে দিলেও দেড়শ বাকী থাকে। এদের মান ভাল না হলেও লেখার আগ্রহ সবটুকুই উবে যায়নি। এরও একটি কারণ রয়েছে। ব্লগে আসার আগের সময়ে হাতে গোণা মাত্র কয়েকটি লেখা লিখতে পেরেছিলাম। লিখতে গিয়ে তাল খুঁজে পাওয়া যেতো না, লেখাটা শেষ করা যেতো না। তাল অবশ্য এখনও পাই না। কিন্তু ব্লগের ক্ষেত্রে পাবলিশ করার একটি তাড়না থাকায় কোনো না কোনোভাবে একটা ইতি টানতেই হয়। ব্লগের সাথে লেপটে থাকতে না পারলে লেখা যে সম্ভব হবে না তা হয়তো হলফ করেও বলা যেতো। এখানে অনেক জনপ্রিয় ব্লগার রয়েছেন—যাঁরা অনেক ভাল লিখেছেন ও পাঠকপ্রিয়ও হয়েছেন। আরও আনন্দের বিষয় হচ্ছে, ইদানিং নতুন অনেকেই যুক্ত হয়েছেন। একালে ব্লগ সার্ভিস যারা দিচ্ছেন তারা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য একটি বড় উপকার করছেন তা বলাই বাহুল্য।
তবে হিরাক্লিটাসের কথা মেনে নিলে বলা যায়, এক গাঙে দুবার চান করা অসম্ভব। ফলে দুটি লেখা এক না হওয়ারই কথা। যিনি পড়ছেন তিনি যদি নিজে চিন্তায় সক্রিয় হন তবে ভিন্নতা খুঁজে বের করাও সম্ভব। পড়ার মধ্যে একটি স্বাধীনতাও থাকে। উদ্ভাবনের স্বাধীনতা। লেখক যা বুঝোতে চেয়েছেন সেটাই যে বুঝতেই হবে তা তো নয়। লেখার মধ্য দিয়ে যেতে গিয়ে যদি কেউ অন্য উন্নতর ইন্টারপ্রিটেশন বা অন্য কোনো নতুন ধারণার সন্ধান পান তবেও বা মন্দ কী। লেখকের মনে বিদ্যমান মর্ম উদ্ধার করার চেয়ে এই পাঠকের নিজ মতো মর্ম উদ্ভাবন করাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সৃজনশীলতার বাহন বা নিমিত্ত হিসেবে ভাষার সামর্থ্যটিও একটি ইতিবাচক বিষয়। নীটিশে তার কেতাবে যা লিখেছেন তার শত ব্যাখ্যা সম্ভব। পাঠকের কী ঠেকা পড়েছে আসলটি খুঁজে পাওয়ার? তার লেখা পড়ে আমি কিভাবে নিজেকে নিজস্বভাবে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করতে পারি তাও-বা গুরুত্বে কম কিসে? সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধিটাই হচ্ছে আসল কথা।
কোনো বড় লেখকের মত ও ধারণা উল্লেখ করতে গেলে এ সমস্যায় পড়তে হয়—আমি কি তাকে ঠিকঠাক মতো বুঝতে পেরেছি? আমার মতো অজ্ঞ মানুষের পক্ষে শুদ্ধতার দাবী করা নিশ্চয়ই হাস্যকর হবে। ফলে এখানে আরেকটি কাজ করা যায়। তা হচ্ছে, আমি যা বুঝলাম তা নিজ দায়িত্বে নিজের কথা হিসেবে লিখে দিলাম। এতে অন্য লেখকের উপর ভ্রান্ত তাৎপর্য চাপিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা থেকে রেহায় জোটে। কিন্তু এরও আবার অন্য একটি অসুবিধা আছে। তা হলো, কথাটি সঠিকভাবে উপস্থাপিত হলে চুরির দায়ে পড়তে হয়। মধ্যযুগের মুসলিমরা জ্ঞানকে প্রাপকের হারানো সম্পদ বলেই জ্ঞান করতেন। ফলে তারা সূত্র উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করতেন না। তারা গ্রীক, রোমান, ভারতীয় বা চীনা জ্ঞান—যেখানে যা পাওয়া যেতো—সবই নিজের করে ফেলতেন। জ্ঞান বা ধারণা চুরি করা অপরাধ কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করার পক্ষে যুক্তি আছে বলেই মনে হয়। আমার আরও ধারণা, জ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি অনৈতিক কাজ হচ্ছে, জ্ঞানকে লুকিয়ে রাখা বা তা সংগ্রহে বাধা সৃষ্টি করা। একথা বলা যায় যে, জ্ঞান চুরি করা যেমন পুণ্য, তেমনই তা গোপন করার ইচ্ছাও পাপ।
অবশেষে বলা যায়, যেহেতু আমাদের সব কাজেরই একটি নৈতিক লক্ষ্য রয়েছে, সেহেতু লেখার ও পড়ার মধ্যেও তা রয়েছে। লেখা ও পড়া এক ধরণের কম্যুনিকেশন, এবং এরও একটি নৈতিক লক্ষ্য থাকতে পারে। কম্যুনিকেশনে মধ্যস্থতা করার একটি রীতিও মানবসমাজে রয়েছে। এই মধ্যস্থতাকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার নেগোসিয়েশনও বলা যায়। লেখার ক্ষেত্রে নেগোসিয়েশন বলতে বুঝোচ্ছি বিভিন্ন মত ও সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যের একটি জায়গা খুঁজে বের করার বিশ্লেষণমূলক চেষ্টাকে। কম্যুনিকেশন ও নেগোসিয়েশনের মাধ্যম হচ্ছে ডায়ালগ। এই ডায়ালগের বাসনা থেকেই আমরা লেখালেখি করতে উৎসাহী হই। নিজেকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করার সাথে সাথে সকলের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির ভিত খুঁজে বের করাকে ডায়ালগের নৈতিক লক্ষ্য হিসেবে নেয়া যায়। সবসময় যে ডায়ালগ সফল হবে তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। কিন্তু সফলতাকে যদি উদ্দেশ্য হিসেবে নেয়া যায় তবে কথার ধরণের উপর তার প্রভাব পরবে। সাফল্যের ইচ্ছা ও চেষ্টার মধ্যেই আমাদের কাজের নৈতিক মূল্য বিদ্যমান।
নেগোসিয়েশনের গুরুত্ব অনেক। একটি ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যায়। মুসা ভবিষ্যৎ খুঁজেছিলেন নীল দরিয়া ভেঙে। কিন্তু মুহম্মদ ভবিষ্যৎ পেয়েছিলেন তাঁর নেগোশিয়েট করার দক্ষতা থেকে। নবুওতের তের বছরের মাথায় আবু-তালিবের মৃত্যুতে তিনি সম্পূর্ণ সহায়হীন, নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েন। তাঁর নিজ গোত্রের নেতৃত্ব চলে আসে আবুজেহেলের হাতে, যিনি নিজেই নবীর ঘোর জিঘাংসু শত্রু। নবী তায়েফ ছুটে গেলেন। কেউই তাঁকে গ্রহণ করলেন না। উল্টো অত্যাচারিত হয়ে ফিরে আসলেন। মক্কাবাসীরা নবীর যেকোনো দিন নিহত হবার সংবাদের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি নীল নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা মুসার মতো দেখছিলেন “নোহোয়ার টু স্টে, নোহোয়ার টু গো, নোহোয়ার টু রিটার্ন।” ওদিকে, মদিনার প্রভাবশালী আওস ও খাযরায গোত্রদুটি নিজেরা নিজেরা হানিহানি ক’রে ক’রে হয়রান হয়ে শেষে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে রাজা হিসেবে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তখনও অভিষেক হয়নি। এরই মধ্যে তারা অলৌকিকভাবে মুহম্মদকে গ্রহণ করার প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। এই প্রস্তাবের পেছনে নেগোসিয়েশনে নবীর সুদক্ষতা ও বিশ্বস্ততা প্রধান কারণ ছিল।

সোমবার, ১৯ মে, ২০১৪

মালয়েশিয় ফ্লাইট MH370

কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (KLIA) এশিয়ার একটি অন্যতম প্রধান, বৃহৎ ও ব্যস্ত বিমানবন্দর। মালয়েশিয়া দেশ হিসেবে নিজেও একটি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ। দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান পরিবহন সংস্থা মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স-এর বেজিংগামী একটি উড়োজাহাজ—ফ্লাইট নম্বর MH370, এয়ারক্রাফট টাইপ Boeing777-2H6ER, রেজিস্ট্রেশন 9M-MRO, ক্যাপাসিটি ২৮২ জন যাত্রী, ফ্লাইট আওয়ার ৫৩,৪৬০, টেক-অফ ল্যান্ডিং ৭,৫২৫—মোট ২৩৯ জন যাত্রী ও ক্রু নিয়ে রহস্যজনকভাবে হারিয়ে গেল। KLIA থেকে জাহাজটি উড়েছিল মালয়েশিয় সময় ৮ মার্চ ২০১৪ ০০:৪১ মিনিটে, বাংলাদেশ সময় ৭ মার্চ ২০১৪ ১০টা ৪১ মিনিটে, ঘন্টাখানেকের মধ্যেই কন্ট্রোলারের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়, হারিয়ে যায় সিভিল রাডার থেকে। ৮ মার্চ মালয়েশিয় সময় ৭টা ২৪ মিনিটে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ জাহাজটির হারিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। এ শতাব্দীতে যখন সামরিক স্যাটেলাইটের মাধ্যমে মাটিতে পড়ে থাকা একটি ফুটবলকে চিহ্নিত করা যায়, সব দেশ সামরিক রাডারের সাহায্যে অচেনা-অজানা এয়ারক্রাফট ডিটেক্ট করতে বদ্ধপরিকর, তখন এতো বড় একটি এয়ারক্রাফট হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা বিস্ময়কর ও অবিশ্বাস্য হলেও এখন পর্যন্ত দুমাসেরও বেশী সময় পরেও তার কোন সন্ধান মেলেনি—না কোন ভগ্নাংশের।

২। জাহাজে কারা ছিলেন


জাহাজের ক্রু সদস্যদের ১২ জনের সকলেই মালয়েশিয়ার নাগরিক। পাইলট ছিলেন ৫৩ বৎসর বয়স্ক যাহারি আহমেদ শাহ ও কোপাইলট ২৩ বৎসর বয়স্ক ফারিক আব্দুল হামিদ। মোট ১২টি দেশের ২২৭ জন যাত্রীর মধ্যে ১৫৩ জনই চীনের ও ৩৮ জন মালয়েশিয়ার নাগরিক; বাকী ৩৬ জন যাত্রী ইরান (২), যুক্তরাষ্ট্র (৩), কানাডা (২), ইন্দোনেশিয়া (৭), অস্ট্রেলিয়া (৬), ভারত (৫), ফ্রান্স (৪), নিউজিল্যান্ড (২), ইউক্রেন (২), রাশিয়া (১), তাইওয়ান (১) ও নেদারল্যান্ডের (১)। যাত্রীদের ৭ জন ছিল শিশু। চীনাদের মধ্যে ১৭ জন ছিলেন দেশে সুপরিচিত শিল্পী, যারা কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত একটি আর্ট প্রদর্শনীতে অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে এসে তাতে অংশ নিয়েছিলেন। মালয়েশিয়ার এয়ারলাইন সূত্রে জানা যায়, ৪ জন যাত্রী চেক-ইন করা সত্ত্বেও জাহাজে উঠেনি।

৩। যতটুকু জানা গিয়েছে

৩.১। ভয়েস কমিউনিকেশন

জাহাজটি মালয়েশিয় সময় ৭ এপ্রিল রাত ০০:৪১ মিনিটে বেজিংয়ের উদ্দেশ্য কুয়ালালামপুর রানওয়ে থেকে উড়ে। ঘন্টা খানেক পর—সময় ০১:০১—ক্রু নিশ্চিত করে ৩৫ হাজার ফুট অল্টিচুড এবং তার কয়েক মিনিট পর—সময় ০১:০৭—শেষ ACARS মেসেজ পাওয়া যায়, এবং ক্রু দ্বিতীয়বারের মতো ৩৫ হাজার ফুট অল্টিচুড কনফার্ম করে। তারপর ১২ মিনিট পর—সময় ০১:১৯—কোপাইলটের নিকট থেকে শোনা যায় “গুড নাইট, মালয়েশিয়ান থ্রি সেভেন যিরো”—এটাই ছিল মালয়েশিয়ার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের সাথে বৈমানিকের শেষ কথা। এই সাইন অফের পর পাইলটের যোগাযোগ করার কথা ছিল ভিয়েতনামের হোচিমিন সিটির কন্ট্রোলারের সাথে। তবে পরবর্তী FIR’য়ের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কয়েক মিনিটের মতো বিলম্ব ঘটতে পারে। এই সময়টিকে বলা হয়ে থাকে ব্ল্যাক স্পট। কিন্তু হোচিমিনের সাথে জাহাজের প্রত্যাশিত সময়ের চেক-ইনি বা কোন রকম যোগাযোগ শেষতক হয়নি। হোচিমিনের অনুরোধে অন্য একটি এয়ারক্রাফটের পাইলট MH370 এর সাথে ইমার্জেন্সি ফ্রিকোয়েন্সিতে যোগাযোগের চেষ্টা করে। এই পাইলটের বর্ণনায় জানা যায়, যোগাযোগ স্থাপতি হয়েছিল বটে, কিন্তু অপর পক্ষের কথা কিছুই বুঝা যায়নি ও স্ট্যাটিক নয়েজ ছিল প্রচুর—এটি ১টা ৩০ মিনিটের ঘটনা হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।

৩.২। সিভিল রাডার সার্ভিল্যান্স

দক্ষিণ চীন সাগরে ভিয়েতনামি এয়ার স্পেসে জাহাজটি প্রবেশ করার পর এবং কোপাইলটের বিদায় সম্ভাষণের মাত্র দুই মিনিটের মাথায় (০১:২১) জাহাজের ট্রান্সপন্ডার—যা ভূমিতে স্থাপিত সার্ভিল্যান্স সিস্টেমের সাথে যোগাযোগ করে—বন্ধ হয়ে যায়। সেকেন্ডারি সার্ভিল্যান্স রাডার (SSR) ট্রান্সপন্ডার এবং অটোমেটিক ডিপেন্ডেন্ট সার্ভিল্যান্স ব্রডকাস্ট (ADS-B) ট্রান্সমিটার উভয়েই একসাথে বন্ধ হয়। ফলে মালয়েশিয়ার এরিয়া কন্ট্রোলারের SSR/ADS-B সমন্বিত সার্ভিল্যান্স স্ক্রিন থেকে জাহাজটি অপসৃত হয়। এসময়ে এটি নির্ধারিত পথে ওয়েপয়েন্ট IGARI-তে ছিল; ৩৫ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ছিল ঘন্টায় ৫৪২ মাইল বেগে। এই স্থানটিই মালয়েশিয়ান সিভিল এভিয়েশন কর্তৃক শেষ দৃষ্ট অবস্থান। শেষ অবস্থান সংক্রান্ত এই তথ্যের ভিত্তিতেই মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামের মধ্যবর্তী থাই উপসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরে প্রথম সার্চ অপারেশন শুরু করে মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও চীন।

উড়ার পর প্রায় সোয়াঘন্টা জাহাজটি কন্ট্রোলারের নজরদারীতে ছিল।

৩.৩। মিলিটারি প্রাইমারি রাডার ডাটা

এরপর জাহাজটির গতিপথ নিয়ে নতুন তথ্য পাওয়া যায় মিলিটারি প্রাইমারি রাডার থেকে। প্রাইমারি রাডার কোন ট্রান্সপন্ডারের সাহায্য নেয় না। এটি মাইক্রোওয়েভ ট্রান্সমিট করে ও উড়োজাহাজের গা থেকে প্রতিফলিত হয়ে ফেরত আসা অংশের সাহায্যে সেটিকে ডিটেক্ট করে। মালয়েশিয়ার মিলিটারি রাডার উপাত্ত থেকে জানা যায়, শেষ দৃষ্ট অবস্থান IGARI থেকে জাহাজটি অস্বাভাবিকভাবে গতিপথ পরিবর্তন করে পশ্চিমে যায়। রাডারটি জাহাজটিকেকে রাত ২টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত ট্রেস করে; জাহাজটির তখনকার অবস্থান ছিল থাইল্যান্ডের ফুকেট থেকে দক্ষিণ বরাবর মালাক্কা প্রণালীতে। এটিকেই তার শেষ জ্ঞাত অবস্থান হিসেবে ধরা হয়। থাইল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ তাদের মিলিটারি রাডার লগ থেকে দাবী করেছে যে, জাহাজটি ঘুরে প্রথমে পশ্চিম দিকে ও পরে উত্তরে আন্দামান সাগরের দিকে যায়। এই দুই কর্তৃপক্ষের কথার মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু এই তথ্য পেতে বিলম্ব হয়েছিল ও এই তথ্যের ভিত্তিতে ৯ মার্চ অনুসন্ধান কাজ মালাক্কা প্রণালী ও আন্দামান সাগরে সম্প্রসারিত করা হয়।

সিভিল রাডার থেকে হারিয়ে যাবার পর প্রায় ঘন্টাখানেকের পথ মিলিটারি রাডার থেকে জানা গিয়েছে।

৩.৪। ACARS ও ডাটা কমিউনিকেশন

এয়াক্রাফট কমিউনিকেশনস এড্রেসিং এন্ড রিপোর্টিং সিস্টেম (ACARS) একটি ডিজিটাল ডাটালিংক প্রটোকল। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে গ্রাউন্ড স্টেশনের কাছে মেসেজ, পজিশন রিপোর্টি ইত্যাদি পাঠানোর জন্য এই প্রটোকল ব্যবহৃত হয়। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স বহুজাতিক তথ্য প্রযুক্তি কোম্পানি SITA’র কাছ থেকে স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন সার্ভিস গ্রহণ করে, আর ডাটালিংকের জন্য SITA চুক্তি করেছে ব্রিটিশ স্যাটেলাইট টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি INMARSAT’য়ের সাথে—যার রয়েছে এগারটি জিয়োস্টেশনারি কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটের কনস্টেলেশন। ACARS-সংশ্লিষ্ট পুরো সিস্টেমটির দুটি প্রধান অংশের একটি হচ্ছে ACARS-সিস্টেম, যা মেসেজ প্রেরণ করে, ও অন্যটি SATCOM টার্মিনাল, যা স্যাটেলাইটের সাথে কমিউনিকেশন লিংক স্থাপন করে। গ্রাউন্ড স্টেশন মোটামোটি প্রতি ঘন্টায় একবার SATCOM টার্মিনালের কাছে ‘লগ-অন/লগ-অফ’ মেসেজ পাঠায়—এটি Ping নামে বেশী পরিচিত, আর পুরো প্রসেসটিকে বলা হয়ে থাকে হ্যান্ডশেক। এই প্রসেসটি সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়। MH370 ১টা ৭ মিনিটে ACARS এর মেসেজ পাঠায় এবং এরপর আর কোন মেসেজ পাঠায়নি। ফলে ধারণা করা হয়, রাডার ট্রান্সপন্ডার বন্ধ হবার সময় ACARS সিস্টেমটিও বন্ধ হয়েছিল। তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, এরপরও ACARS-এর SATCOM টার্মিনাল থেকে নির্ধারিত সময় মতো হ্যান্ডশেক ঘটছিল, যার তথ্য স্যাটেলাইটে সংরক্ষিত হয়। সময়োচিত ছয়টি পূর্ণ হ্যান্ডশেকের—প্রথমটি ০২:২২ মিনিটে ও সর্বশেষটি ০৮:১১ মিনিটে—তথ্য INMARSAT কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে পাওয়া যায়। তারপর থেকে আর কোন হ্যান্ডশেক হয়নি। অবশ্য ৮:১৯ মিনিটে একটি অনির্ধারিত ও ব্যাখ্যাহীন আংশিক হ্যান্ডশেক ঘটেছিল বলে জানা যায়, কোন গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে Ping করা হয়েছিল তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানা গিয়েছিল।


৪। INMARSAT ও দুটি প্রকল্পিত বৃত্তচাপ

Ping/হ্যান্ডশেক নিজ থেকে জাহাজের অবস্থান সংক্রান্ত কোন উপাত্ত দেয় না। এটি গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে জাহাজের স্যাটকম টার্মিনাল পর্যন্ত কমিউনিকেশন লিংকের সচলাবস্থা নিশ্চিত করে। কিন্তু ping-এর জবাব থেকে সময়ের হিসাব-কিতাব করে প্রকৌশলীরা স্যাটেলাইট থেকে জাহাজের দূরত্ব নির্ণয় করতে পারে। সর্বশেষ ping’য়ের উপর ভিত্তি করে নির্ণীত দূরত্ব বিবেচনা করে তারা দুটি বৃত্তচাপ এঁকেছেন। সেই সাথে মউজুদ জ্বালানীতে জাহাজটির পক্ষে সোজা যতদূর উড়া সম্ভব (৫৩শ কিমি) ছিল তা হিসেবে এনে একটি বৃত্ত আঁকা হয়। এই বৃত্তের পরিধির যেখানে সেই চাপ দুটি মেলে সেখান পর্যন্ত প্রলম্বিত ফ্লাইট করিডোর দুটি জাহাজটি বিধ্বস্ত হবার সম্ভাব্য স্থান বলে ধারণা করা হয়। যে দুটি করিডোর নির্ধারণ করা গিয়েছে তাদের উত্তরেরটি দক্ষিণ থাইল্যান্ড থেকে কাজাখস্তান পর্যন্ত প্রলম্বিত ও অপরটি বিপরীত দিকে ইন্দোনেশিয়া থেকে দক্ষিণ ভারত মহাসাগরে অস্ট্রেলিয়ার পার্থ থেকে আরও দক্ষিণ পর্যন্ত। তবে পরবর্তীতে সংশোধিত হিসাব অনুসারে উত্তরের অংশটিকে বাদ দেয়া গিয়েছে। এটি খুব ভালভাবেই দাবী করা হয়েছে যে, MH370 দক্ষিণ ভারত মহাসাগরেই পড়েছে—যা অনুসারে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী টেলিভিশনে ঘোষণা দিয়েছিলেন। ৫৩শ কিমি ফ্লাইট হিসেবে নিলে বলা যায় পার্থের নিকটবর্তী সমুদ্রগর্ভই যাত্রীদের সমাধিস্থান।

মিলিটারি রাডার থেকে হারিয়ে যাবার পর থেকে শেষ ACARS হ্যান্ডশেক পর্যন্ত জাহাজটি ছয় ঘন্টা উড়েছে। তারপর তেলের হিসেবে আরও এক ঘন্টা উড়া সম্ভব।


৫। চোরাই পাসপার্ট

চোরাই পাসপোর্টধারী ২ জন ইরানী—১৯ বছরের পোরিয়া নুর আহমেদ মেহেরদাদ ও ২৯ বছরের দেলওয়ার সাইয়েদ মোহাম্মদ রেজা—বেজিং হয়ে ইউরোপ যাচ্ছিলেন। পাসপোর্ট দুটির একটি এক ইতালীয় ও অপরটি এক আস্ট্রিয় নাগরিকের যারা বছরখানেক আগে থাইল্যান্ডে তাদের পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেন। আন্তর্জাতিক পুলিশ এজেন্সি ইন্টারপোল তাদের বিশ্বব্যাপী হারানো পাসপোর্টের ডাটাবেস থেকে এই তথ্য নিশ্চিত করে। তবে কোন সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে এই দুই যাত্রীর জড়িত থাকার আলামত পাওয়া যায়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি একটি শঙ্কার বিষয় যে, দুজন যাত্রী অন্যের পাসপোর্ট ব্যবহার করে জাহাজে উঠতে পেরেছিল—মালয়েশিয় নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ তাদেরকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

৬। পাইলটের আত্মহত্যা তত্ত্ব

পাইলট কর্তৃক আত্মহত্যার তত্ত্ব প্রথমদিকে বেশ আলোচিত বিষয় ছিল। কিন্তু এই তত্ত্বের সমর্থনে কোন প্রমাণ মেলেনি। এফবিআই ও মালয়েশিয় পুলিশ পাইলট ও কোপাইলটের বাড়ি তলাশি করে। এফবিআই পাইলটের হোম ফ্লাইট সিমুলেটরে মুছে ফেলা তথ্য উদ্ধার করে এবং তাদের মতে ওতে সন্দেহজনক কিছু ছিল না। তবে বৈমানিকের বিমানসহ আত্মহত্যার সন্দেহ এটিই প্রথম নয়। ১৯৯৯ সালে ইজিপ্ট এয়ার ফ্লাইট ৯৯০ এবং ১৯৯৭ সালে সিল্ক এয়ার ফ্লাইট ১৮৫ বিধ্বস্ত হবার জন্য পাইলটের আত্মহত্যাকে কারণ হিসেবে দেখা হয়। অবশ্য এই দাবীকে অনেকেই চ্যালেঞ্জও করেছেন। এভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্কের দাবী মতে, ১৯৭৬ সাল থেকে এভাবে আত্মহত্যার ছয়টি ঘটনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞের মতে, মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে এই তত্ত্ব অন্য তত্ত্বগুলোর মতোই একটি তত্ত্ব মাত্র, যা প্রমাণিত হয় নি, আবার অপ্রমাণিতও হয়নি।

৭। ককপিটে সাময়িক আগুন তত্ত্ব

ককপিটে আগুন লেগে যাওয়া একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। আগুনের কারণে ভয়েস কমিউনিকেশন ভেঙ্গে পড়ে। পাইলট অন্যান্য ইলেকট্রনিক সিস্টেম নিরাপত্তার স্বার্থে বন্ধ করে দিতে পারেন, অথবা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। দ্রুত আগুন নিভিয়ে ফেলাও সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু ককপিটের ক্ষতি এতদূর হয়ে উঠে যে, পাইলট এয়ারক্রাফট পুরো নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হন। পাইলট দ্রুত ফেরার সিদ্ধান্ত নেয় ও লংকাবির নামতে চান। নিয়ন্ত্রণের অভাবে শেষতক নামতে পারেনি। জাহাজ নিজে নিজে উড়ে শেষে যখন তেল ফুরিয়ে যায় তখন দক্ষিণ ভারত মহাসাগরে নেমে সাগরের তলায় চলে যায়। যদি এরকমটি ঘটে থাকে তবে একথা বলা যায়, যাত্রীরা এতই দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছেন যে, ভালভাবে ‘গুডবাই’ বলার পরপরই দ্রুত এমনসব কাণ্ড ঘটতে থাকে যার ফলশ্রুতিতে ‘মে-ডে’ কল করার সুযোগ ও সামর্থ্য ক্রু’রা পানি। সেই সাথে ধীরে ধীরে জাহাজের ভেতরে বাতাসের চাপ কমেও থাকতে পারে—যার ফলশ্রতিতে যাত্রী ও ক্রুরা নিজেদের অজ্ঞাতেই হয়তো অজ্ঞান হয়েও পড়েছিলেন।

৮। যান্ত্রিক গোলযোগ তত্ত্ব

মেকানিক্যোল ফেইলিউরকেও সম্ভাব্য কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে। তবে এখানে একটি বড় প্রশ্ন হতে পারে এই যে, সে ক্ষেত্রে যোগাযোগ বন্ধ হবে কেন? ককপিটে আগুনের কারণে মেকানিক্যাল সমস্যাও হতে পারে। কাজেই আগুন তত্ত্বটিই বেশ মজবুত তত্ত্ব।

৯। স্যাবোটাজ, হাইজ্যাক ইত্যাদি

পরপর কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে যাদের উপযুক্ত ও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা মিলছে না—ব্ল্যাক স্পট থেকে ঘটনার সূত্রপাত হওয়া, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সব যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়া, এয়ারক্রাফটের গতির দিক বদল করে পশ্চিমে উড়তে থাকা, জাহাজের কোন চিহ্ন না পাওয়া। ফলে মানুষের হাত থাকার সন্দেহও করা হয়েছে। হাইজ্যাকের সন্দেহ প্রথমে গিয়ে পড়েছিল দুই ইরানীর উপর। সুইস জেট চার্টা কোম্পানির ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার পদে চাকুরে এক যাত্রীকেও অবশ্য খুবই স্বল্পকালের জন্য সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছিল, যেহেতু সে অভিজ্ঞ ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হবার সুবাদে সিস্টেম বিকল করার বিদ্যা তার ছিল।

১০। পর্যালোচনা

কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য যতটুকু জমি গ্রহণ করা হয়েছে তার মাত্র ১০ শতাংশ কাজে লাগানো হয়েছে, বাকীটা ভবিষ্যতের জন্য রেখে দেয়া হয়েছে (এখন সেখানে পাম চাষ করা হচ্ছে, এজন্য একটি লিমিটেড কোম্পানিও বানানো হয়েছে)। কিন্তু এতটুকুতেই ইতোমধ্যে তা একটি অত্যাধুনিক ও সুবিশাল বিমানবন্দর হয়ে উঠেছে। মালয়েশিয়রা তাদের বিমান পরিবহণ অবকাঠামোর জন্য বেশ গর্বিতও। এই অঞ্চলে এভিয়েশন সেক্টরে ব্যস্ততম হাব হবার উচ্চাভিলাষ নিয়েই তারা এগুচ্ছে। প্রয়োজনীয় এভিয়েশন টেকনলজির জন্যও তাদের ব্যয় প্রচুর। তাদের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সেন্টার অত্যাধুনিক সিস্টেম সমৃদ্ধ। এই সেক্টরে মানব সম্পদ উন্নয়নে তারা সিঙ্গাপুরের সাথে পাল্লা দিয়ে এগুতে চাচ্ছে। কোঅর্ডিনেশনের জন্য কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে রয়েছে বিরাট কমান্ড-কন্ট্রোল সেন্টার। কিন্তু এতদসত্বেও তারা নগ্ন হয়ে পড়লো; প্রমাণ করলো, তাদের মানবশক্তি কতখানি অমনোযোগী—কি সিভিল, কি মিলিটারি। এবং তাদের সিভিল-মিলিটারি-এয়ারলাইন্স কোঅর্ডিনেশন কোন কাজেই লাগলো না।

বিমান হারিয়ে যাওয়ার এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক সমালোচকরা এমনভাবে নয়া টেকনোলজি প্রবর্তনের কথা বলছেন যেন মালয়েশিয়রা উন্নত টেকনোলজির পুরো সুবিধা সর্বোচ্চ দক্ষতার সাথে ব্যবহার করা সত্বেও জাহাজটি হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু দৃশ্যতই স্পষ্ট যে, মালয়েশিয়ার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সেন্টার ও বিমান বাহিনী নিতান্তই অদক্ষতা ও অসজাগতার পরিচয় দিয়েছে। সিভিল রাডার থেকে বিমানের অপসৃত হবার সময়টিও এটিসি ঠিক মতো রিপোর্ট করতে পারেনি। তারা জাহাজের এভাবে রাডার থেকে হারিয়ে যাবার পরও কোন নড়াচড়া করেনি, যা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। অন্যদিকে, বিমান বাহিনী এভাবে একটি অফ-ট্র্যাক জাহাজকে রিয়াল টাইমে মনিটর পর্যন্ত করেনি। অথচ এই সময়ে তাদের ফাইটার এয়ারক্রাফটের আকাশে উড়ার কথা ছিল; কারণ জাহাজটি কেবল যে রাডার থেকে অপসৃত হয়েছিল তা মাত্র নয়, ভয়েস কমিউনিকেশনও বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। এতে মালয়েশিয়ার ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়েছে। সম্ভবত অর্থনৈতিকভাবেও তাদেরকে ক্ষতির সম্মুখিন হতে হবে।

১১। ঘটনার ঘাত

MH370-এর হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি যে বিষয়গুলোকে এখন আলোচিত-সমালোচিত তুলেছে তাদের মধ্যকার প্রধানগুলো হচ্ছে সিকিউরিটি স্ক্রিনিং সিস্টেম, সার্ভিল্যান্স সিস্টেম, কমিউনিকেশন সিস্টেম এবং সার্চ এন্ড রেসকিউ সহায়ক সিস্টেম। সিকিউরিটি সামনে এসেছে একারণে যে, দুজন ইরানী যাত্রী চুরি করা পাসপোর্ট নিয়ে এয়ারক্রাফটে উঠতে সক্ষম হয়েছে বলে জ্ঞাত হওয়া; সার্ভিল্যান্স ও কমিউনিকেশন এসেছে দুই ফ্লাইট ইনফরমেশন রিজিওন (FIR)-এর মধ্যবর্তী ব্ল্যাক স্পট থেকে জাহাজটির যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়া ও সেকেন্ডারি সার্ভিল্যান্স রাডার (SSR) ট্রান্সপন্ডারের নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া থেকে; এবং সার্চ এন্ড রেসকিউ এর বিষয়টি এসেছে জাহাজটির পরিবর্তিত পথের হদিস সহজে বা নিশ্চিতভাবে না পাওয়া এবং ব্ল্যাক বক্স থেকে সুফলদায়ক কোন সাড়া না পাওয়া থেকে। ঘটনাটি আর নিছক একটি এয়ারক্রাফটের হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে সীমিত নেই, এটি এখন হয়ে উঠছে এভিয়েশন টেকনোলজি ও এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টে মিসিং লিংক অন্বেষণের ঘটনা। এই ঘটনা সম্ভবত ভবিষ্যৎ এভিয়েশন টেকনোলজি ও প্রসেডিওরে বিরাট পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে।

আমরা জাহাজের হদিস হয়তো নিকট ভবিষ্যতে পাবো; কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক রহস্যই সম্ভবত রহস্য হয়েই থেকে যাবে। দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বিমান চলাচল সিস্টেমে ফাঁক রয়ে গেছে এবং এই ফাঁক পূরণে এখন বিশ্বের সব দেশকে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে। তবে এগিয়ে আসার সাথে জড়িয়ে আছে উন্নত বিশ্বের, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য শেয়ার করা ও বিপুল পরিমাণে আর্থিক সংশ্লেষ। এই অর্থ কে যোগান দেবে?—যাত্রী, এয়ারলাইন, নাকি রাষ্ট্র, তা-ও একটি বড় প্রশ্ন। ৯/১১-এর ঘটনার মতোই এঘটনাটিও একালের এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিতে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে আরেকটি মাইল ফলক ঘটনা হতে যাচ্ছে—এটি অনুমান করা যায় সহজেই।

শনিবার, ৩ মে, ২০১৪

বিমান চলাচলে নেক্সটজেন টেকনোলজি – ৩/৩ (নতুন প্রযুক্তি)

১.১। ভবিষ্যৎ এয়ার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সনাতন কমিউনিকেশন, ন্যাভিগেশন ও সার্ভিল্যান্স সিস্টেমসমূহের সীমাবদ্ধতার এবং বিমান চলাচলকে একুশ শতকে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এই তিন ক্ষেত্রে আবশ্যক উন্নতি সাধনের প্রয়োজনীয়তার কথা গত ৮০’র দশকের শুরুতেই আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (ICAO) ভাবতে শুরু করে। এই ভাবনার ফসল ফিউচার এয়ার ন্যাভিগেশন সিস্টেম (FANS) – যা ICAOএর একটি কনসেপ্ট। ১৯৮৩ সালে ICAO এই কনসেপ্টের উপর ভিত্তি করে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে। নতুন সম্ভাবনা ও নতুন প্রযুক্তি অন্বেষণ করার দায়িত্ব ন্যস্ত হলো এই কমিটির উপর। কমিটির প্রতিবেদনে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ভিত্তিক যোগাযোগ, স্যাটেলাইট প্রযুক্তি, ডাটা লিংক যোগাযোগ ইত্যাদি প্রাধান্য পায়। পরবর্তীতে আরও একটি ফলো-অন কমিটি (FANS Phase II) গঠিত হয় – নতুন সিস্টেমগুলো বিশ্বজুড়ে সমন্বিতভাবে বাস্তবায়নের পন্থা ও উপায় খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে। এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টে প্রয়োজনীয় কমিউনিকেশন, ন্যাভিগেশন ও সার্ভিল্যান্স এর সিস্টেমগত বা প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর ক্ষেত্রটিকে ICAO সংক্ষেপে CNS বলে অভিহিত করে থাকে। বিগত ২০ বছরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন CNS বাস্তবায়নে অনেক কাজ হয়েছে এবং নানারূপ অসুবিধার মধ্যেও এই কাজ এগিয়ে যাচ্ছে।

১.২। আমরা এই পর্বে নেক্সট জেনারেশন CNS সিস্টেম ও এপ্লিকেশন নিয়ে পরিচিতিমূলক সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে চেষ্টা করব। ভবিষ্যতে ATN, CPDLC ও ADS-B নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে লেখার ইচ্ছা আছে।

২। কমিউনিকেশন

২.১। এরোনটিক্যাল টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক (ATN)

২.১.১। আগে বলা হয়েছিল যে, এরোনটিক্যাল বার্তা আদান প্রদানের জন্য এতকাল ধরে ব্যবহার করে আসা হচ্ছে এরোনটিক্যাল ফিক্সড টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক (AFTN)। আরও বলা হয়েছিল যে, এটি মূলত টেক্সট বেইজড মেসেজ সুইচিং সিস্টেম মাত্র। গত তিন দশকে কম্পিউটার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ও কম্পিউটার এপ্লিকেশনে বিস্তর অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। তাই এভিয়েশন কমিউনিটির জন্য পুরাতন প্রযুক্তির AFTN এর স্থলে বিশ্বব্যাপী অধুনা বহুলভাবে ব্যবহৃত ইন্টারনেটের মত একটি নেটওয়ার্ক স্থাপন প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। পরিকল্পিত এই নেটওয়ার্কের নাম দেয়া হয়েছে এরোনটিক্যাল টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক বা ATN। আকাশের এয়ারক্রাফটকেও এই ইন্টারনেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে বিধায় ‘ফিক্সড’ শব্দটি এখানে পরিহার করা হয়েছে।

২.১.২। এই ইন্টারনেটওয়ার্কের জন্য প্রথমে OSI মডেল ও OSI প্রটোকলগুলো স্থির করা হয়েছিল। ৮০’র দশকে সঙ্গত কারণেই এই সিদ্ধান্ত নেয় হয়েছিল: এভিয়েশন কমিউনিটির প্রয়োজন পূরণে ইন্টারনেটে ব্যবহৃত IPv4 সক্ষম ছিল না – IPv4 এর এড্রেস অপ্রতুলতা, সিকিউরিটির অপর্যাপ্ততা, সর্বোপরি মোবাইল নেটওয়ার্ককে ম্যানেজ করার ক্ষেত্রে তার অক্ষমতার কারণে। তাই একরকম বাধ্য হয়েই সেসময় OSI এর মত নিছক কেতাবি আর্কিটেকচার অবলম্বন করতে হয়েছিল।

২.১.৩। OSI মডেল কখনোই বাস্তবে ব্যাপকভাবে রূপায়িত হয়নি, হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার লেভেলে পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষাও হয়নি এবং ইন্ডাস্ট্রির আনুকূল্য পায়নি; যে কারণে স্বাভাবিকভাবেই OSI সফটওয়্যার ও যন্ত্রপাতির মূল্য অনেক বেশী। যখন IPv6 এর আবির্ভাব হলো তখন OSI নিয়ে আর অগ্রসর হবার ক্ষেত্রে এভিয়েশন কমিউনিটি বিভক্ত হয়ে পড়ে। একারণে ATN এর অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে তার পূর্ণ বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটছে। ICAO অবশ্য ইতোমধ্যেই ATN/OSI এর পাশাপাশি ATN/IPS এর জন্যও স্পেসিফিকেশন প্রস্তুত করেছে। IPS দ্বারা তারা ইন্টারনেট প্রটোকল স্যুটকে বোঝাচ্ছে: যা আসলে প্রধানত TCP/IP।

২.১.৪। এই ATN হতে যাচ্ছে এভিয়েশন কমিউনিটির প্রধান যোগাযোগ অবকাঠামো যা একই সাথে ব্যবহৃত হবে সিভিল এভিয়েশন এডমিনিস্ট্রেশন, এরোড্রাম ও এয়ার ন্যাভিগেশন সার্ভিস প্রভাইডার, এয়ারপোর্ট ও এয়ারক্রাফট অপারেটর এবং প্যাসেঞ্জারদের দ্বারা।

২.১.৫। বাইনারি ডাটা আদান প্রদান করতে সক্ষম ATN কম্পিউটার ভিত্তিক নেটওয়ার্ক। তাই AFTN এর চেয়ে ATN এর সম্ভাবনা অনেক বেশী। ATN প্ল্যাটফর্মের উপর নানা ধরণের এয়ার ন্যাভিগেশন সার্ভিস এপ্লিকেশনও ডেভেলপ করা সম্ভব। ইন্টারনেটওয়ার্ক রাউটিং বিবেচনায় এই এপ্লিকেশনগুলোকে দুভাগে ভাগ করা যায়: গ্রাউন্ড-গ্রাউন্ড এপ্লিকেশন এবং এয়ার-গ্রাউন্ড এপ্লিকেশন। ইতোমধ্যে যেসব এপ্লিকেশনের স্পেসিফিকেশন ও প্রসেডিওর তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়েছে সেগুলো মধ্যে প্রধান কয়েকটির নাম নীচে দেয়া হলো।

গ্রাউন্ড-গ্রাউন্ড এপ্লিকেশন:
(ক) এয়ার ট্রাফিক সার্ভিসেস মেসেজ হ্যান্ডলিং সিস্টেম (ATSMHS),
(খ) এয়ার ট্রাফিক সার্ভিসেস ইন্টার-ফ্যাসিলিটি ডাটা কমিউনিকেশন (AIDC)।

এয়ার-গ্রাউন্ড এপ্লিকেশন:
(ক) কন্ট্রোলার পাইলট ডাটা লিংক কমিউনিকেশন (CPDLC)
(খ) অটোমেটিক ডিপেন্ডেন্ট সার্ভিল্যান্স (ADS)

২.২। এয়ার ট্রাফিক সার্ভিসেস মেসেজ হ্যান্ডলিং সিস্টেম (AMHS)

এটিএস মেসেজ হ্যান্ডলিং সিস্টেম একটি ই-মেইল সিস্টেম যার মাধ্যমে এরোনটিক্যাল বার্তা আদান প্রদান করা হয়। AMHS মেসেজ AFTN মেসেজের স্থলাভিষিক্ত নতুন পদ্ধতি। AMHS প্রতিষ্ঠিত X.400 মেসেজ ট্রান্সফার এজেন্টের উপর এবং মেসেজ ট্রান্সফারে ব্যবহার করা হয় P1 প্রটোকল। যতদিন না AFTN সম্পূর্ণভাবে অপসারিত হচ্ছে ততদিন আবশ্যক ক্ষেত্রে উভয় নেটওয়ার্কের মধ্যে গেইটওয়ে হিসেবে কাজ করবে AMHS-AFTN গেইটওয়ে।

২.৩। এটিএস ইন্টার-ফ্যাসিলিটি ডাটা কমিউনিকেশন (AIDC)

একটি দেশের এয়ারস্পেস এক বা একাধিক ফ্লাইট ইনফরমেশন রিজিওন (FIR)-এ বিভক্ত। এক FIR থেকে এয়ারক্রাফট পার্শ্ববর্তী FIR-এ প্রবেশকালে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল অথরিটির পরিবর্তন হয়। এটি সম্পন্ন হয় এয়ারক্রাফট হ্যান্ডওভার/টেকওভার-এর মাধ্যমে। এজন্য সংশ্লিষ্ট দুই ATC সেন্টারের কন্ট্রোলারের মধ্যে যোগাযোগের প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হয় ফ্লাইট ডাটা ও রাডার ডাটা ইনফরমেশন আদান-প্রদানের। বর্তমান কালে এই আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে ফ্লাইটের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাওয়ার কারণে। AIDC হচ্ছে এরূপ পাশাপাশি ATS ফ্যাসিলিটি যুগলের মধ্যে ATC ইনফরমেশন আদান-প্রদানের সিস্টেম। এর জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট মেসেজ ফরমেট।

২.৪। কন্ট্রোলার পাইলট ডাটা লিংক কমিউনিকেশন (CPDLC)

২.৪.১। CPDLC একটি এয়ার-গ্রাউন্ড ডাটা লিংক এপ্লিকেশন যা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার ও পাইলটের মধ্যে টেকস্ট ভিত্তিক মেসেজ আদান প্রদান করার কাজ করে। এটি তাই একটি কমিউনিকেশন এপ্লিকেশনও বটে। ভবিষ্যতে CPDLC সনাতন VHF ভয়েস কমিউনিকেশনের স্থলাভিষিক্ত হয়ে ATC এর মুখ্য সিস্টেম হিসেবে গণ্য হবে এবং VHF রেডিও টেলিফোনি একটি স্ট্যান্ড-বাই ও সহযোগী সিস্টেম হিসেবে থাকবে মাত্র । অধুনা ওশানিক রিজিওনসমূহে CPDLC ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে যোগাযোগ ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে।

২.৪.২। VHF রেডিও টেলিফোনির সমস্যা অনেক। VHF চ্যানেলের সংখ্যা সীমিত। কথোপকথন নিজেই একটি দীর্ঘ ও সময়-সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। তাছাড়া টেলিফোনির ক্ষেত্রে একজন পাইলট যখন কন্ট্রোলারের সাথে কথা বলেন তখন অন্য পাইলটদের অপেক্ষায় থাকতে হয়। এই পদ্ধতি এয়ারস্পেসের ক্যাপাসিটি বাড়ানোর অন্তরায়। যে হারে ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ছে তাতে এই পদ্ধতি ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণে অক্ষম হয়ে পড়বে। CPDLC-তে এসব সমস্যা থাকছে না।

২.৪.৩। CPDLC অনেকটাই টেক্সট ভিত্তিক চ্যাট এপ্লিকেশনের মতো। তবে এখানে কিছু পূর্বনির্ধারিত ছোট ছোট মেসেজের সেট রয়েছে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এগুলোই ATC-তে ব্যবহৃত হয় ও যথেষ্ট হয়। এর মধ্যে রয়েছে সব ধরণের ATC ক্লিয়ারেন্স, ফ্লাইট ইনফরমেশন ও রিকোয়েস্ট মেসেজ। CPDLC এর মাধ্যমে পাইলট নিজে থেকে শর্তসাপেক্ষ ক্লিয়ারেন্স নিতেও সক্ষম। রেডিও টেলিফোনিতে যেমন রিকোয়েস্ট-এপ্রুভাল-কনফারমেশন রূপে কথোপকথন হয়, তেমনই CPDLC-তে কন্ট্রোলার-পাইলটের মধ্যে রীতিমত লিখিত বার্তা ভিত্তিক ডায়ালগ চলে। লেভেল ও স্পিড এসাইনমেন্ট, রুট চেঞ্জ, আনুভূমিক ডেভিয়েশন, ইমার্জেন্সি ঘোষণা, ফ্রি টেক্সট সবই আছে CPDLC-তে।

২.২.৪। CPDLC-তে ডাটা লিংক হিসেবে যে দুটি প্রটোকল ব্যবহৃত হয় তা হলো ACARS (Aircraft Communications Addressing and Reporting System) ও VDLm2 (VHF Digital Link Mode 2)। প্রথমটি অনেক আগে থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে এয়ারলাইন অপারেশনাল কন্ট্রোল কাজের জন্য, কিন্তু এর ব্যান্ডউইডথ অনেক কম। অন্যদিকে, VDLm2 হচ্ছে ICAO সমর্থিত ডাটা লিংক যা ATN-এর ক্ষেত্রেও ব্যবহারযোগ্য। এর ডাটা ক্যাপাসিটি অনেক বেশী এবং এটি অনেক বেশী রিলায়েবল।

৩। ন্যাভিগেশন

৩.১। গ্লোবাল ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম (GNSS)

৩.১.১। এয়ার ন্যাভিগেশনের জন্য ব্যবহৃত সব সনাতন সিস্টেমই ভূমি ভিত্তিক। এতে সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটি তৈরি হয়েছে তা হলো, সোজা পথের বদলে এয়াররুট অপ্রয়োজনীয়ভাবে আঁকাবাঁকা হয়েছে। এতে ফ্লাইট টাইম ও ফুয়েল কন্সাম্পশন বেড়েছে। সমুদ্রের উপর ন্যাভিগেশন সিস্টেম স্থাপনের সুযোগ নেই – এটিও একটি সমস্যা। স্যাটেলাইট সিস্টেম ভিত্তিক ন্যাভিগেশনে এসব সমস্যা অতিক্রম করা সম্ভব।

৩.১.২। GNSS শিরোনামে ICAO বিমান চলাচলে ন্যাভিগেশনের জন্য ব্যবহৃতব্য স্যাটেলাইট সিস্টেমের স্পেসিফিকেশন প্রণয়ন করেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে GNSS একটি জেনেরিক টার্ম, এ নামে বাস্তবে রূপায়িত কোন সিস্টেম নেই। যুক্তরাষ্ট্রের GPS (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) এবং রাশিয়ার GLONASS (গ্লোবাল ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম) হচ্ছে সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত দুটি GNSS সিস্টেম। ইউরোপীয় দেশগুলো অন্যদের উপর নির্ভরশীলতা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখার জন্য গ্যালিলিও নামে স্বতন্ত্র আরেকটি সিস্টেম নির্মাণ করছে। আবার চীন এবং ভারতও আলাদা আলাদাভাবে ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম তৈরি করছে। এই স্যাটেলাইটগুলো মিডিয়াম আর্থ অরবিটে অবস্থিত (অল্টিচুড: GPS–২০২০০, GLONASS–১৯১০০, Galileo–২৩২২২ কিলোমিটার)।

৩.১.৩। GPS-এর নাম আমরা অনেকেই শুনেছি ও ব্যবহারও করছি। অনেক গাড়ীতে, মোবাইল ফোন সেটে GPS রিসিভার রয়েছে। GPS সিস্টেমের স্পেস সেগমেন্ট মূলতঃ ২৪টি স্যাটেলাইটের একটি কন্সটেলেশন নিয়ে গঠিত – যাতে রয়েছে ৬টি অরবিট ও প্রতিটিতে ৪টি করে স্যাটেলাইট। স্যাটেলাইটগুলো নিজ অরবিটে থেকে ক্রমাগতভাবে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে চলেছে ১২ ঘণ্টায় একবার করে। স্যাটেলাইটগুলোর অরবিট, অবস্থান ও গতি এমন যে, পৃথিবীর যেকোনো স্থানে যেকোনো সময়ে অন্তত ৪টি স্যাটেলাইট আনুভূমিক দৃষ্টিবলয়ের উপরে অবস্থান করে। নীচের ছবিটি থেকে GPS স্যাটেলাইটগুলোর অবস্থান ও গতি সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়।

৩.১.৪। প্রতিটি স্যাটেলাইট ক্রমাগতভাবে ন্যাভিগেশন ডাটা ফ্রেম ট্রান্সমিট করে চলেছে। প্রতিটি ফ্রেমে তিন ধরনের তথ্য বিদ্যমান থাকে: (ক) ট্রান্সমিট টাইম, (খ) অরবিটাল ইনফরমেশন (ephemeris), এবং (৩) সাধারণভাবে সিস্টেমের অবস্থা এবং GPS অরবিটসমূহের ডাটা (Almanacs)। অন্তত ৪টি স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত এই ডাটা ফ্রেম থেকে GPS রিসিভার নিজ অবস্থানের অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ, উচ্চতা ও সময় নির্ধারণ করতে পারে।

৩.১.৫। GPS সিস্টেমকে তিনটি প্রধান সেগমেন্টে ভাগ করে বর্ণনা করা হয়। (১) স্পেস সেগমেন্ট, (২) কন্ট্রোল সেগমেন্ট ও (৩) ইউজার সেগমেন্ট। কন্ট্রোল সেগমেন্টের তিনটি অংশ রয়েছে: (ক) মাস্টার কন্ট্রোল স্টেশন, যা কলোরাডো স্প্রিংয়ের বিমান বাহিনী ঘাঁটিতে অবস্থিত, (খ) বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত কয়েকটি মনিটর স্টেশন ও (গ) বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত কয়েকটি গ্রাউন্ড এন্টেনা।

৪। সার্ভিল্যান্স

৪.১। অটোমেটিক ডিপেন্ডেন্ট সার্ভিল্যান্স (ADS)

৪.১.১। আমরা গত লেখায় বলেছিলাম যে, প্রাইমারি সার্ভিল্যান্স রাডার (PSR), সেকেন্ডারি সার্ভিল্যান্স রাডার (SSR) এবং ট্রাফিক কলিশন এভয়ডেন্স সিস্টেম (TCAS) বর্তমানে ব্যবহৃত হয়ে আসছে সার্ভিল্যান্সের সিস্টেম হিসেবে। এদের মধ্যে PSR ও SSR গ্রাউন্ড সিস্টেম যা কন্ট্রোলারগণ ব্যবহার করেন এবং TCAS এয়ারবোর্ন সিস্টেম যা পাইলটেরা ব্যবহার করেন। মোটামুটিভাবে বলতে গেলে, PSR-এ ১০০ নটিক্যাল মাইল কভার করতে ৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে SSR-এও রোটেটিং এন্টেনার প্রয়োজন পড়ে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, TCAS অপারেশন PSR/SSR অপারেশন নিরপেক্ষ হওয়ায় কন্ট্রোলারের RADAR স্ক্রিন ও পাইলটের TCAS স্ক্রিন উপাত্তের দিক থেকে একরূপ নয়।

৪.১.২। ADS-এর ক্ষেত্রে উচ্চ ক্ষমতা, রোটেটিং এন্টেনা, ইন্টারোগেশন-রিপ্লাই ইত্যাদির কোন প্রয়োজন হয় না। এখানে এয়ারক্রাফট গ্লোবাল ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম (GNSS) থেকে প্রাপ্ত নিজের অবস্থান সম্পর্কীয় ডাটা অন্যপক্ষকে ডাটা লিংকের মাধ্যমে ক্রমাগত সরবরাহ করে। গ্রহণকারী পক্ষ এই উপাত্ত থেকে রাডার ডিসপ্লের অনুরূপ ডিসপ্লে তৈরি করে। ADS অপারেশন দুরকমের: ADS-C (কন্ট্রাক্ট) ও ADS-B (ব্রডকাস্ট)। এদের মধ্যে ATS সার্ভিল্যান্সের জন্য ব্রডকাস্ট টাইপটি বেশী ব্যবহৃত হয় এবং এটি SSR-এর প্রকৃত বিকল্প হিসেবে কাজ করতে সক্ষম। আমরা ADS-B এর অপারেশন নিয়ে কিছু কথা বলে আজকের লেখা শেষ করব।

৪.১.৩। ADS-B এয়ার-গ্রাউন্ড এবং এয়ার-এয়ার ডাটা লিংক যোগাযোগ (ADS-C কেবল এয়ার-গ্রাউন্ড)। এয়ারক্রাফটের ADS-B ট্রান্সমিটার স্যাটেলাইট উপাত্ত থেকে নির্ণয় করা নিজের অবস্থান সম্পর্কীয় উপাত্ত ক্রমাগত ট্রান্সমিট করে (যে কারণে এর টাইপ নাম ব্রডকাস্ট) যা গ্রাউন্ড স্টেশন এবং পার্শ্ববর্তী এয়ারক্রাফটসমূহ রিসিভ করে। সকল ADS-B এনাবল্ড এয়ারক্রাফট যদি এভাবে তাদের স্ব স্ব অবস্থান জানাতে থাকে তবে গ্রাউন্ড স্টেশনসহ সব এয়ারক্রাফটই একই উপাত্তভিত্তিক রাডার-সদৃশ ডিসপ্লে পেতে পারে যা SSR ও TCAS এর মাধ্যমে সম্ভব ছিল না। যেসব এয়ারক্রাফটে ADS-B নেই, গ্রাউন্ড স্টেশন SSR এর মাধ্যমে তাদের অবস্থান জানতে পারে। SSR ও ADS-B এর ডাটা একত্রে সন্নিবিষ্ট করে আকাশের সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরা যায় এবং ADS-B গ্রাউন্ড স্টেশন SSR ডাটা এয়ারক্রাফটকে প্রদান করলে এয়ারক্রাফটেও সম্পূর্ণ চিত্র পাওয়া যায়। এভাবে কন্ট্রোলার ও পাইলট সমভাবে সমরূপ সিচুয়েশনাল এওয়ারনেস লাভ করতে পারে। ADS-B গ্রাউন্ড স্টেশন এয়ারক্রাফটকে নানা রকম ফ্লাইট ইনফরমেশন সার্ভিসও দিতে পারে।



৪.১.৪। ADS-B একটি ডিজিটাল রেডিও ডাটা লিংক প্রযুক্তি। এর জন্য তিনটি ডাটা লিংক প্রটোকল ব্যবহৃত হয়ে আসছে: (১) 1090 MHz Extended Squitter (1090-ES), (২) 978 MHz Universal Access Transceiver (UAT) and (৩) VHF Digital Link Mode 4 (VDLm4)। যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে UAT দিয়ে শুরু করলেও এখন 1090-ES এর অনুমোদনও দিয়েছে। ইউরোপের কিছু দেশ VDLm4 ব্যবহার করে। তবে বর্তমানে ICAO এর জোর প্রস্তাব হচ্ছে 1090-ES। 1090-ES হচ্ছে SSR Mode S এবং TCAS-এ ব্যবহৃত প্রটোকল।

৪.১.৫। স্যাটেলাইট হতে পাওয়া ডাটা থেকে পজিশন নির্ণয় করা হয় বিধায় ADS-B এর পজিশন ডাটার একিউরেসি সনাতন রাডারের চেয়ে অনেক অনেক ভাল এবং এই ডাটা অনেক বেশী নির্ভরযোগ্য।

সমাপ্ত

বিমান চলাচলে নেক্সটজেন টেকনোলজি – ২/৩ (সনাতন প্রযুক্তি)

এয়ার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন হয় নানা রকম কমিউনিকেশন, এয়ার ন্যাভিগেশন ও সার্ভিল্যান্স সিস্টেম। আমরা আগেই বলেছি যে, ট্র্যাডিশনাল সিস্টেমগুলো মূলত পুরনো প্রযুক্তির; ভয়েস রেডিও ট্রান্সমিশন, মেসেজ সুইচিং, টেলিটাইপরাইটিং, ভূমি ভিত্তিক ন্যাভিগেশন সিস্টেম ও রাডার প্রযুক্তি – এগুলোই বিগত অর্ধ শতাব্দীরও বেশী কাল ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই পর্বে আমরা এগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করব।

২। কমিউনিকেশন

পাইলট ও কন্ট্রোলারের মধ্যে যোগাযোগ এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের জন্য একান্ত আবশ্যক। স্টার্টআপ ক্লিয়ারেন্স, টেকঅফ ক্লিয়ারেন্স, ফ্লাইট লেভেল এপ্রুভাল, পজিশন রিপোর্টিং, ল্যান্ডিং ক্লিয়ারেন্স ইত্যাদি কন্ট্রোল ইন্সট্রাকশন এবং আবহাওয়া, নোটিফিকেশন ইত্যাদি তথ্য প্রদানের মধ্য দিয়ে ভূমি থেকে কন্ট্রোল সার্ভিস ও ইনফরমেশন সার্ভিস বিমানকে দেয়া হয়ে থাকে। এই যোগাযোগটি সম্পাদিত হয় কন্ট্রোলার-পাইলটের মধ্যে সরাসরি কথোপকথনের মাধ্যমে।

২.১। ভয়েস কমিউনিকেশন

২.১.১। VHF ফ্রিকোয়েন্সি ১১৮ থেকে ১৩৭ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের ক্যারিয়ারকে ভয়েস দিয়ে মডুলেশন করে রেডিও ওয়েভ ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে এই যোগাযোগ সাধন করা হয়। এই যোগাযোগে বেশ কয়েকটি সমস্যা রয়েছে। এটি কন্ট্রোলার ও পাইলটের বাচনিক ভাষা নির্ভর – যা সময়সাপেক্ষ এবং যেখানে বোধগম্যতা অনেকটাই বিষয়ীগত। এখানে একটি এরিয়ার সকল পাইলটের সাথে একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে কন্ট্রোলারকে যোগাযোগ করতে হয় বলে এক পাইলটের সাথে কথোপকথনের সময় অন্য পাইলটদের অপেক্ষা করতে হয়। এয়ার ট্রাফিক ঘনত্ব যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে এই পদ্ধতি একসময় অপর্যাপ্ত ও অকার্যকর হয়ে উঠবে।

২.১.২। VHF ফ্রিকোয়েন্সি দৃষ্টিরেখা বরাবর সঞ্চারিত হয় এবং তাদ্বারা অনেক দূরের বিমানের সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয় না। তাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে HF ফ্রিকোয়েন্সিতেও এয়ার-গ্রাউন্ড যোগাযোগ সম্পাদন করা হয়। সাধারণত এডভাইসারি সার্ভিসে এটি ব্যবহৃত হয়। তবে এরও কিছু সমস্যা রয়েছে। HF ট্রান্সমিশন ভূমির কার্ভেচার অনুসরণ করে অগ্রসর হতে পারে বলে অপেক্ষাকৃতভাবে বেশী দূরে যেতে পারলেও তার ভেতরকার তথ্য নানাভাবে সহজেই আক্রান্ত হয়। তাছাড়া এধরণের ট্রান্সমিশনে বড় আকারের এন্টেনা প্রয়োজন হয়।

২.২। এরোনটিক্যাল ফিক্সড টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক (AFTN)

২.২.১। বিশ্বব্যাপী বিমান চলাচলে নানা সংস্থা ও কর্তৃপক্ষের সেবা ও ক্রিয়াকলাপ জড়িত হয়ে আছে। প্রতিটি ফ্লাইট শুরু হওয়ার আগেই তার গন্তব্য দেশ এবং যাত্রাপথের অন্য সকল দেশের সাথে যাত্রারম্ভের দেশের যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই যোগাযোগ সাধিত হয় ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট স্টেশনের মধ্যে। এই স্টেশনগুলোকে বলা হয়ে থাকে এরোনটিক্যাল কমিউনিকেশন স্টেশন। এই স্টেশনগুলি এয়ারপোর্ট ভিত্তিক এবং এরা সকলে একটি কমিউনিকেশন নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত – যাকে বলা হয় এরোনটিক্যাল ফিক্সড টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক বা সংক্ষেপে AFTN। যেহেতু এই স্টেশনগুলি ভূমিতে স্থিরভাবে অবস্থিত তাই ফিক্সড শব্দটি তার নামে এসেছে।

২.২.২। এখানে যোগাযোগ সাধিত হয় সরল টেক্সট ক্যারেক্টার ভিত্তিক বার্তার মাধ্যমে। এখানে রয়েছে স্টেশনগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট এড্রেসিং স্কিম এবং মেসেজ সুইচিংয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট নোড ও পথ। বিশ বছর আগেও সুইচিং ছিল ম্যানুয়াল; অপারেটররা এক পোর্টের আউটপুট টর্ন টেপ অন্য পোর্টে ইনপুট হিসেবে ব্যবহার করে মেসেজ রিলে করত। বর্তমান কালের অধিকাংশ সুইচিং সিস্টেম কম্পিউটার ভিত্তিক এবং অটোমেটিক হলেও তার অন্তরালে রয়ে গিয়েছে সেই পুরাতন টেলিটাইপরাইটিং স্পেসিফিকেশন। এখানে বার্তা ক্যারেক্টারের ভিত্তিক এবং এই সিস্টেম বাইনারি ডাটা আদান প্রদান করতে পারে না। বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিকাশ হয়েছে আধুনিক কম্পিউটার নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির বিকাশের আগেই। AFTN-এ মেসেজ আদান প্রদানে তাই তার সামর্থ্যগত সীমাবদ্ধতা অনেক, যা কম্পিউটার ইন্টারনেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমেই কেবল অতিক্রম করা সম্ভব।

৩। ন্যাভিগেশন

বিশ্বযুদ্ধের কাল থেকে নানা ধরণের এয়ার ন্যাভিগেশন সিস্টেম প্রস্তুত ও ব্যবহার করা হয়ে আসছে। এসব সিস্টেম ভূমিতে স্থাপন করা হয় এবং সিস্টেমগুলি রেডিও ওয়েভ ট্রান্সমিটার। ন্যাভিগেশন সিস্টেমগুলির দুটো প্রধান কাজ: আকাশে এয়ার রুট নির্ধারিত বা নির্দিষ্ট (define) করা হয় এই সিস্টেমগুলোর মাধ্যমে এবং পাইলটের জন্য সিস্টেমগুলো প্রদান করে তার অবস্থান ও চলার দিক নির্ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় গাইডেন্স বা তথ্য।

৩.১। নন-ডিরেকশনাল বিকন (NDB)

৩.১.১। একটি NDB গ্রাউন্ড স্টেশন অত্যন্ত সরল একটি ট্রান্সমিটার যা HF ১৯০ থেকে ১৭৫০ কিলোহার্টজ ব্যান্ডে ট্রান্সমিশন করে। অবশ্য বাংলাদেশের সব NDB ১৯০ থেকে ৫৩৫ কিলোহার্টজ ব্যান্ডে কাজ করে। এর মধ্যে দিক সম্বন্ধীয় কোন তথ্য থাকে না বলে এর নামে নন-ডিরেকশনাল শব্দটি এসেছে। তবে প্রতিটি ন্যাভিগেশন সিস্টেমের একটি বিশ্বজুড়ে ইউনিক পরিচিতি কোড থাকে। প্রতিটি NBD-এর জন্যও আছে। এই কোড দুই বা তিনটি ইংরেজি অক্ষরের সমন্বয়ে গঠিত। যেমন, ঢাকার NDB-এর কোড DCN, VOR-এর কোড DAC, ILS-এর কোড IDA ইত্যাদি। এই অক্ষরগুলো মোর্স কোড অনুসারে ক্যারিয়ারের সাথে মডুলেটেড অবস্থায় ট্রান্সমিট করা হয়, যা এয়ারক্রাফটের রিসিভারে ডিমডুলেশনের পর পাইলট কানে মোর্স কোডটি শুনতে পান। এর মাধ্যমে পাইলট নিশ্চিত হতে পারেন তার টিউন করা NDB-টি পৃথিবীর কোন NDB স্টেশন তথা কোন স্থান।

৩.১.২। যে কোন পয়েন্ট অফ রেডিয়েশনের দিক নির্ণয় করা সহজ। NDB-এর ক্ষেত্রে একটি লুপ এন্টেনা তা করতে পারে। এই প্রযুক্তিকে বলা হয় ডিরেকশন ফাইন্ডিং। কিছু ইলেক্ট্রিক্যাল, ইলেক্ট্রনিক ও মেকানিক্যাল যন্ত্রের সাহায্যে খুব সহজেই ডিরেকশন ফাইন্ডিং কাজকে অটোমেটিক করে তোলাও যায়, যাকে বলা হয় ADF প্রযুক্তি। যদিও NDB সিগনালে দিক সম্বন্ধে কোন তথ্য থাকে না, তবুও এয়ারবোর্ন রিসিভারে ADF-এর মাধ্যমে NDB-এর দিক নির্ণয় করা যায় – আর এভাবেই একটি সরল ট্রান্সমিটারকে ন্যাভিগেশনের কাজে লাগানো যাচ্ছে। তবে এর একিউরেসি অত্যন্ত খারাপ এবং HF ট্রান্সমিশনের সব অসুবিধা এতে বিদ্যমান। নিকট ভবিষ্যতে NDB একটি পরিত্যক্ত সিস্টেমে পর্যবসিত হবে।

৩.২। ভিএইচএফ অমনি-ডিরেকশনাল রেডিও রেঞ্জ (VOR)

VOR একটি উন্নত ন্যাভিগেশন এইড, যা VHF ১০৮ থেকে ১১৮ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে কাজ করে। এর সিগনাল থেকে এয়ারবোর্ন রিসিভার এয়ারক্রাফটের হেডিং বা কোর্স নির্ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে পারে এবং এনরুট অটোপাইলটিংও এ থেকে সম্ভব। VOR সিস্টেমের মডুলেশন প্রক্রিয়া ও একটি এন্টেনা সিস্টেমের মাধ্যমে এর রেডিয়েশন প্রক্রিয়া এমন যে, আকাশের কোন পয়েন্টে গৃহীত সিগনালে বিদ্যমান একটি ৩০ হার্টজ রেফারেন্স ও একটি ৩০ হার্টজ ভেরিয়েবল এর ফেজ ডিফারেন্স থেকে ম্যাগনেটিক নর্থ এর সাপেক্ষে স্টেশনের দিক নির্ধারক কোণ (angle) এর মান পাওয়া যায়। এই কোণের মানকেই ন্যাভিগেশনের জন্য বা অটোপাইলটিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়। এর একিউরেসি NBD-এর চেয়ে অনেক ভাল। বর্তমান কালের বেশির ভাগ এয়াররুট VOR গ্রাউন্ড স্টেশনের সিগনাল দ্বারা তৈরি। মডুলেশনের ধরণ ও পদ্ধতি গত প্রযুক্তি অনুসারে VOR দুরকমের হয়: কনভেনশনাল (CVOR) ও ডপলার (DVOR)। নীচে একটি ডপলার ভিওআর স্টেশনের ছবি দেয়া হল।



৩.৩। ডিসটেন্স মেজারিং ইকুইপমেন্ট (DME)

VOR থেকে বিমানের অবস্থানের কৌণিক মান পাওয়া গেলেও স্টেশন থেকে তার দূরত্ব জানা যায় না। এই দূরত্ব জানার জন্য DME ব্যবহার করা হয়। NDB, VOR বা ILS-এর মত এক্ষেত্রে যোগাযোগটি গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে এয়ারক্রাফটের দিকে ইউনিলেটারাল নয়। বরং DME গ্রাউন্ড স্টেশন ও এয়ারবোর্ন স্টেশনের মধ্যে সক্রিয় সহযোগিতার মাধ্যমে দূরত্ব নির্ণয় কাজটি সম্পাদিত হয়। DME এয়ারবোর্ন স্টেশনকে বলা হয় ইন্টারোগেটর এবং গ্রাউন্ড স্টেশন কাজ করে ট্রান্সপন্ডার হিসেবে। ইন্টারোগেটর একটি কোড ট্রান্সমিট করে ও তার সময় সম্বন্ধে চেতন থাকে, অন্যদিকে ট্রান্সপন্ডার এই ইন্টারোগেশন পাওয়ার পর একটি রিপ্লাই কোড প্রেরণ করে। এই রিপ্লাই পাওয়ার পর এয়ারবোর্ন স্টেশন প্রথম সময় থেকে রিপ্লাই পাওয়ার সময়ের ব্যবধান হিসাব করে দূরত্ব নির্ণয় করে। DME কাজ করে UHF ৯৬২ থেকে ১২১৩ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে।

৩.৪। ইন্সট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম (ILS)

৩.৪.১। ভূমিতে বসানো ইন্সট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম থেকে প্রাপ্ত সিগনাল ব্যবহার করে এয়ারবোর্ন রিসিভার পাইলটকে রানওয়েতে নামার ভিজুয়াল গাইডেন্স দিতে পারে। রানওয়েতে নামার জন্য রানওয়ের সেন্টার প্লেন, ডিসেন্ট প্লেন এবং এয়ার ক্রাফট থেকে রানওয়ের শুরুর প্রান্তের দূরত্ব রেডিও সিগনালের মাধ্যমে কোনভাবে প্রদান করতে পারলে পাইলট রানওয়ে দেখতে না পাওয়া সত্ত্বেও রানওয়েতে নামার জন্য এপ্রোচ করতে পারবে। এই তিন ধরণের সিগনাল তৈরিতে তিন ধরণের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়:

ক) সেন্টার প্লেনের জন্য লোকালাইজার,

খ) ডিসেন্ট প্লেনের জন্য গ্লাইড পাথ, ও

গ) দূরত্বের নির্দেশক হিসেবে মার্কার অথবা ল্যান্ডিং ডিএমই।

৩.৪.২। লোকালাইজার

লোকালাইজার রানওয়ের সেন্টার লাইন গাইডেন্স প্রদান করে। এটি VHF ১০৮ থেকে ১১২ মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডে কাজ করে। এখানে দুটি অডিও ফ্রিকোয়েন্সি ৯০ এবং ১৫০ হার্টজ সাইনওয়েভকে ক্যারিয়ারের সাথে এমপ্লিচুড মডুলেশন করা হয় এবং অনেকগুলো এন্টেনার একটি বিন্যাস থেকে এমনভাবে রেডিয়েট করা হয় যে, রানওয়ের সেন্টার লাইন বরাবর ৯০ ও ১৫০ উভয় ফ্রিকোয়েন্সির ডেপথ অব মডুলেশন সমান থাকে (প্রত্যেকের জন্য ২০%)। ফলে ডিফারেন্স ইন ডেপথ অব মডুলেশন (DDM) এর মান হয় শূন্য। এই শূন্য DDM মান আকাশে যে তল তৈরি করে তা-ই লোকালাইজার তল, যা রানওয়ের সেন্টার লাইনের উপর উল্লম্বভাবে অবস্থান করে। পাইলটের আসন থেকে দেখলে, সেন্টার লাইন থেকে এয়ারক্রাফট ডানে বা বামে সরতে থাকলে এই DDM এর মান ক্রমেই বাড়তে থাকে – ডানে সরলে ১৫০ হার্টজ এর মডুলেশন ডেপথ ৯০ হার্টজ এর ডেপথ থেকে বাড়ে এবং বামে সরলে ৯০ হার্টজ এর ডেপথ অন্যটি থেকে বেশী হয়। রানওয়েতে নামার জন্য যেদিক থেকে এয়ারক্রাফট এপ্রোচ করে সেদিকে রানওয়ের সেন্টার লাইন বরাবর লোকালাইজারের কভারেজ হয়ে থাকে ২৫ নটিক্যাল মাইল। এয়ারক্রাফট ককপিটে সাধারণ অসিলোস্কোপের স্ক্রিনের মত একটি স্ক্রিন থাকে, যার উপর লোকালাইজার ইনডিকেটর লাইনটি থাকে উল্লম্বভাবে। এই লাইনটি স্কোপের মধ্যখানে থাকলে বুঝতে হবে এয়ারক্রাফট রানওয়ের সেন্টার লাইন বরাবর এগুচ্ছে; যদি লাইনটি ডানে সরে আসে তবে এয়ারক্রাফটকে ডানে (বামের বেলায় বামে) সরিয়ে আনলে সেন্টার লাইনের দিকে যাওয়া হয়। নীচে একটি লোকালাইজারের এন্টেনা এ্যারে-এর ছবি দেয়া হলো।



৩.৪.৩। গ্লাইড পাথ

এয়ারক্রাফটের ডিসেন্ট পাথ অনুভূমের সাথে সাধারণত ৩ ডিগ্রী হয়ে থাকে। গ্লাইডপাথ রানওয়েতে নামার এই ডিসেন্ট পাথ সম্বন্ধীয় গাইডেন্স প্রদান করে। এর কাজের প্রকৃতি লোকালাইজারের মতই, এটির ক্ষেত্রে ৯০ ও ১৫০ হার্টজের শূন্য DDM (উভয়ের ক্ষেত্রে ৪০%) যে তলটি তৈরি করে তা অবতরণ পথটি ধারণ করে। এর উপরের দিকে ৯০ হার্টজের ও নীচের দিকে ১৫০ হার্টজের মডুলেশন ডেপথের প্রাধান্য থাকে। লোকালাইজার প্রদত্ত শূন্য DDM তল ও গ্লাইড পাথ প্রদত্ত শূন্য DDM তল যে রেখায় পরস্পরকে ছেদ করে, সে রেখাটিই এয়ারক্রাফটের অবতরণ পথ। ককপিটের যে স্ক্রিনটিকে লোকালাইজার নির্দেশক ভার্টিক্যাল লাইনটি থাকে সেই একই স্ক্রিনে গ্লাইড পাথ নির্দেশক লাইনটি থাকে আনুভূমিকভাবে। গ্লাইড পাথ কাজ করে ৩২৮ থেকে ৩৩৬ মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডে এবং এর কভারেজ রানওয়ের অবতরণ প্রান্ত থেকে সাধারণত ৮ নটিক্যাল মাইল।

৩.৪.৪। মার্কার

রানওয়ের নিকটতার পরিমাণ নির্দেশ করতে সাধারণত মার্কার ব্যবহার করা হয়। এধরণের তিনটি মার্কার থাকতে পারে: আউটার মার্কার, মিডল মার্কার ও ইনার মার্কার। এগুলো সবই ৭৫ মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সিতে কাজ করে এবং ফানেল আকারে এবং উল্লম্বভাবে এদের রেডিয়েশন হয়ে থাকে। মার্কার তিনটির জন্য আলাদা পরিচিতি কোড রয়েছে, যা পাইলট কানে শুনতে পান। তবে বিশ্বের সব আউটার মার্কারের কোড একই এবং অন্য দুটির বেলাতেও একই কথা। অবতরণকালে এয়ারক্রাফট এই ফানেল অতিক্রমের সময় রেসপেকটিভ অডিও-ভিজুয়াল ইনডিকেশন পেয়ে থাকে। মার্কারগুলো যেহেতু পূর্বনির্ধারিত দূরত্বে স্থাপন করা হয় তাই এই ইনডিকেশনের সময় পাইলট রানওয়ের শুরুর প্রান্তের কতটুকু নিকটবর্তী হয়েছেন তা বুঝতে পারেন। তবে কোন রানওয়ের জন্য মার্কার স্থাপনে অসুবিধা থাকলে এগুলোর বদলে একটি ল্যান্ডিং DME ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই DME গ্লাইড পাথের সাথে সহাবস্থান করতে পারে, আবার রানওয়ের কোন এক পাশে তার মাঝামাঝি স্থানে স্থাপন করা যেতে পারে যেন একই রানওয়ের উভয় দিকের জন্য বসানো দুটি ILS একই DME ব্যবহার করতে পারে।

৪। সার্ভিল্যান্স

সবচেয়ে সরল এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল কাজ করা হয়ে থাকে এয়ারক্রাফটের পজিশন রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে – এই রিপোর্টিংটি সাধিত হয় এয়ার-গ্রাউন্ড VHF ভয়েস রেডিও যোগাযোগের মাধ্যমে। এখানে কন্ট্রোলার-পাইলটের মধ্যে কথার আদান প্রদান হয়। পাইলট তার পজিশন জানতে পারে VOR ট্র্যাক এবং DME ডিসটেন্স থেকে। কন্ট্রোলার সময়কে ব্যবহার করে সেপারেশনের জন্য। কিন্তু রাডার প্রযুক্তির মাধ্যমে কন্ট্রোলার এয়ারক্রাফটের অবস্থান সার্বক্ষণিকভাবেই দেখতে পান স্ক্রিন ডিসপ্লের উপর। বিমান চলাচল সার্ভিল্যান্সের ক্ষেত্রে দুধরণের রাডার প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়: প্রাইমারি রাডার ও সেকেন্ডারি রাডার প্রযুক্তি।

৪.১। প্রাইমারি সার্ভিল্যান্স রাডার (PSR)

PSR এয়ারক্রাফট চিহ্নিত করে উচ্চ ক্ষমতার রেডিও সিগনাল ট্রান্সমিট করা ও আকাশের কোন টার্গেট বস্তুর গা থেকে প্রতিফলিত রশ্মি রিসিভ করার মাধ্যমে। এই সিগনাল ট্রান্সমিট-রিসিভ করার কাজে ব্যবহার করা হয় খুবই ডিরেকশনাল বিম যা বিচ্ছুরিত হয় একটি ঘূর্ণায়মান এন্টেনা থেকে। এন্টেনার কৌণিক অবস্থান থেকে এঙ্গেল এবং ট্রান্সমিশন-রিসিপশনের মধ্যকার সময় থেকে টার্গেটের দূরত্ব পাওয়া যায়। আর এই দুই তথ্যকে একটি দ্বিমাত্রিক ডিসপ্লেতে তা ইলেকট্রনিক উপায়ে প্লট করা হয় – যাকে আমরা রাডার ডিসপ্লে বলে থাকি। প্রতিফলিত রশ্মি প্রয়োজন হয় বলে এই প্রযুক্তিতে বড্ড বেশী উচ্চ ক্ষমতার সিগনাল ট্রান্সমিশনের জন্য উৎপন্ন করতে হয়। এর জন্য জটিল ও ব্যয়বহুল এমপ্লিফায়ার (ক্লাইস্ট্রন জাতীয়, যা আকারেও অনেক বড়) দরকার হয়। এটিই এর সবচেয়ে বড় অসুবিধা। তবে এর সুবিধা হলো এতে এয়ারক্রাফট কর্তৃক একটিভ পারটিসিপেশন প্রয়োজন হয় না ও এয়ারক্রাফটে এর জন্য কোন সিস্টেম স্থাপন করতে হয় না। বেসামরিক বিমান চলাচলে যে প্রাইমারি রাডার ব্যবহৃত হয়ে আসছে তার আর একটি অসুবিধা হলো, এর মাধ্যমে এয়ারক্রাফটের অলটিচুড জানা সম্ভব হয় না।

৪.২। সেকেন্ডারি সার্ভিল্যান্স রাডার (SSR)

সেকেন্ডারি রাডার প্রযুক্তির মূল কার্যপ্রণালী DME-এর মতই। পার্থক্য হচ্ছে এক্ষেত্রে ইন্টারোগেটর হচ্ছে SSR গ্রাউন্ড স্টেশন এবং ট্রান্সপন্ডার থাকে এয়ারক্রাফটে। তবে এখানেও PSR-এর মতই রোটেটিং এন্টেনা প্রয়োজন হয় এবং কোণ ও দূরত্বের জন্য PSR-এর মত প্রসেসিং কৌশল ব্যবহার করা হয়। কিন্তু যেহেতু ইকো-এর আর কোন প্রয়োজন থাকছে না তাই উচ্চ ক্ষমতার ট্রান্সমিশন থেকে গ্রাউন্ড স্টেশন রেহাই পাচ্ছে। তাছাড়া SSR এয়ারবোর্ন ট্রান্সপন্ডার এয়ারক্রাফটে স্থাপিত অল্টিচুড মাপার অন্য সিস্টেম থেকে পাওয়া তথ্যটি তার রিপ্লাই কোড-এ সন্নিবিষ্ট করে দেয় বিধায় গ্রাউন্ড স্টেশন ভূমি থেকে এয়ারক্রাফটের উচ্চতাটিও জানতে পারে। একইভাবে এয়ারক্রাফটের পরিচয়টিও SSR এ পাওয়া যায়। রিপ্লাইয়ের প্রয়োজন হয় বিধায় SSR-এ এয়ারক্রাফটের একটিভ পার্টিসিপেশন আবশ্যক। যেসব এয়ারক্রাফটে SSR ট্রান্সপন্ডার নেই বা অকার্যকর হয়ে পড়ে সেসব এয়ারক্রাফট সম্বন্ধে গ্রাউন্ড স্টেশনের কোন সম্বিত থাকে না।

৪.৩। একাস/টিকাস (ACAS/TCAS)

PSR ও SSR এর মাধ্যমে ভূমিতে অবস্থিত এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল স্টেশন সার্ভিল্যান্স ও কন্ট্রোল কাজ সম্পন্ন করে। এরা পাইলটকে সরাসরি ও সার্বক্ষণিক সিচুয়েশনাল এওয়ারনেস প্রদান করতে পারে না। পাইলট তার আশেপাশের এয়ারক্রাফটের অবস্থান জানার জন্য ব্যবহার করে এয়ারবোর্ন কলিশন এভয়ডেন্স সিস্টেম (ACAS)। ACAS আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (ICAO) প্রণীত সিস্টেম স্পেসিফিকেশন। প্রডাকশন ইন্ডাস্ট্রিতে এই যন্ত্রাবলী বা সিস্টেম সাধারণত TCAS (ট্রাফিক কলিশন এভয়ডেন্স সিস্টেম) নামে পরিচিত। এরা SSR প্রযুক্তিতে কাজ করে তবে তুলনামূলকভাবে অল্প রেঞ্জে। সকল পক্ষ কর্তৃক সব সুবিধা পেতে হলে সকল এয়ারক্রাফটেই TCAS ইন্টারোগেটর ও ট্রান্সপন্ডার থাকতে হয় ও সচল থাকতে হয়। এই সিস্টেম দ্বারা পার্শ্ববর্তী এয়ারক্রাফটের অবস্থান, কৌণিক দূরত্ব, দূরত্ব ও আপেক্ষিক অল্টিচুড জানা যায় যা পাইলটের জন্য রাডার ডিসপ্লে হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তাছাড়া গায়ে গায়ে সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য বিপদকালে সংশ্লিষ্ট দুই এয়ারক্রাফটের কম্পিউটারাইজড এই সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেদের মধ্যে নেগোশিয়েট করে নিরাপদ ডিসেন্ট/ক্লাইম্ব ম্যানুভারের সিদ্ধান্ত দিতে পারে। TCAS ধরণের এলার্ট দিয়ে থাকে: ট্রাফিক এডভাইসারি (TA), রেজোল্যুশন এডভাইসারি (RA) ও ক্লিয়ার অব কনফ্লিক্ট। এয়ারবোর্ন TCAS অপারেশনের সাথে গ্রাউন্ড স্টেশন SSR অপারেশনের কোন সম্পর্ক নেই, তাই পাইলট ও কন্ট্রোলারের রাডার ডিসপ্লে সম্পূর্ণভাবে একরূপ হয় না।



চলবে…

শুক্রবার, ২ মে, ২০১৪

বিমান চলাচলে নেক্সটজেন টেকনোলজি – ১/৩ (প্রাথমিক কথা)

বিমান চলাচলে নানারকম কমিউনিকেশন, ন্যাভিগেশন ও সার্ভিল্যান্স প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিগত পঞ্চাশ বছরে এই প্রযুক্তির অঙ্গনে বিশাল অগ্রগতি সাধিত হলেও সমগ্র বিশ্ব জুড়ে বিমান চলাচলের বাস্তব ক্ষেত্রে সেই অনুপাতে উন্নত প্রযুক্তির বাস্তবায়ন হয়নি। এর কারণ হলো সমগ্র বিশ্বে বিমান চলাচলে এক ধরণের সমরূপতা প্রয়োজন হয়; সকল দেশের জন্য একই স্ট্যান্ডার্ড, স্পেসিফিকেশন, প্রটোকল ও অপারেশনাল প্রসেডিওর ছাড়া এক্ষেত্রে সমন্বিত কর্মকাণ্ড সম্ভব হয় না। আবার সমন্বয়ের অভাবে সংশ্লিষ্ট মানব সম্পদের প্রশিক্ষণে জটিলতা বাড়ে এবং বিমান চলাচলের নিরাপত্তায় হুমকি বাড়ে।

২। বিমান চলাচলে ট্র্যাডিশনাল কমিউনিকেশন সিস্টেমসমূহ এবং এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সার্ভিসের প্রসেডিওরসমূহ প্রচলনকালে অর্জিত সকল প্রযুক্তিকেই ব্যবহার করা হয়েছিল। তখনকার বিচারে তা ছিল আধুনিক। কিন্তু তা সমগ্র বিশ্বের দেশগুলোকে এমন একটি পরস্পর নির্ভরশীল অবস্থায় নিয়ে গিয়েছে যে, এখন সমন্বয়টি বজায় রেখে হুট করে তা বদলে ফেলা সম্ভব নয়। এতদুদ্দেশ্যে প্রয়োজন নতুন প্রবর্তনযোগ্য প্রযুক্তিরর সম্ভাবনা খুঁজে বের করা, প্রয়োজনীয় স্ট্যান্ডার্ড ও স্পেসিফিকেশন প্রণয়ন করা, সকল দেশের মধ্যে নতুন প্রযুক্তির জ্ঞান ট্রান্সফার করা ও সকলের মধ্যে সমন্বয় বজায় রেখে তা বাস্তবায়ন করা। বলাই বাহুল্য, একাজ বেশ কঠিন, আড়ম্বরপূর্ণ এবং সময় ও অর্থ সাপেক্ষ।

৩। এয়ার ট্রাফিক সার্ভিসের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্রধান ট্র্যাডিশনাল প্রযুক্তিগুলো হচ্ছে মেসেজ সুইচিং, টেলিফোনি, ভয়েস রেডিও ট্রান্সমিশন, ভূমিতে স্থাপিত রেডিও সিগনাল ট্রান্সমিশন ভিত্তিক ন্যাভিগেশন সিস্টেম এবং রাডার। এগুলোর জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন টেকনিক এবং এরা আলাদা আলাদাভাবে স্ট্যান্ড এলোন সিস্টেম হিসেবে সার্ভিস দিয়ে আসছে; যেখানে একজন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার সার্ভিসগুলোকে ব্যবহার করেন ও পূর্বনির্ধারিত প্রসেডিওর অনুসারে কাজ করেন।

৪। যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমাদের কালে সবচে বড় অগ্রগতি এসেছে কম্পিউটারের ক্ষমতা, কম্পিউটারে ব্যবহৃত কমিউনিকেশন প্রটোকলের ইন্টেলিজেন্স, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক আর্কিটেকচারে প্রাপ্তব্য সম্প্রসারণশীলতা, নানাবিধ এপ্লিকেশন চালনায় একই কম্পিউটারাইজড সিস্টেমের সক্ষমতার মধ্য দিয়ে। তাছাড়া ন্যাভিগেশনের ক্ষেত্রে জিপিএস, গ্লোনাসের মত স্যাটেলাইট সিস্টেম ভূমি ভিত্তিক সকল ন্যাভিগেশন সিস্টেমকে অনাবশ্যক ও অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছে।

৫। আকাশে পাইলট তার এয়ারক্রাফট চালান বটে, কিন্তু সকল এয়ারক্রাফটের চলাচল ভূমি থেকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যিনি এই নিয়ন্ত্রণকাজ করেন তাকে বলা হয় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার। এরূপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে কোন সিভিল এয়ারক্রাফট সাধারণত চলাচল করে না। এই এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল বা ব্যবস্থাপনার মূল লক্ষ্য তিনটি: সকল এয়ারক্রাফটের নির্বিঘ্ন চলাচল, নিরাপদ চলাচল ও দক্ষতাসম্পন্ন চলাচল।

৫.১। নির্বিঘ্ন চলাচল

নির্বিঘ্ন চলাচল বলতে বুঝায় পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে বিমানের উড্ডয়ন, গমন ও অবতরণ। আকাশে এয়ারক্রাফট প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তার ও যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে। কিন্তু এয়ার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি হলে ফ্লাইট ক্লিয়ারেন্স বা ল্যান্ডিং ক্লিয়ারেন্স বিলম্বিত হতে পারে এবং এরূপ ঘটলে আমরা বলতে পারি এয়ার ট্রাফিক বিঘ্নিত হয়েছে।

৫.২। নিরাপদ চলাচল

নিরাপদ চলাচলের জন্য ট্রাফিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আকাশ উন্মুক্ত হলেও এয়ারক্রাফটের জন্য পথ কিন্তু পূর্ব নির্ধারিত। কাজেই পথের সংখ্যা, পূর্বাপর এয়ারক্রাফটের মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব ও বিমানের গতি এই প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। ব্যবহৃত প্রযুক্তির সামর্থ্য, একিউরেসি ও নির্ভরযোগ্যতার উপর ভিত্তি করে নিরাপদ ব্যবধানের পরিমাণ নির্ধারিত হয়।

৫.৩। বিমান চলাচলে দক্ষতা

অন্যদিকে, ট্রাফিক প্রবাহে দক্ষতা বা এফিশিয়েন্সি বলতে বুঝায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে কী পরিমাণ এয়ারক্রাফট প্রবাহিত করা যায়; ট্রাফিক সংখ্যা যত বেশী হবে এফিশিয়েন্সি তত বেশী হবে। বিমান পথের সংখ্যা বাড়াতে পারলে অথবা/এবং নিরাপদ ব্যবধান কমাতে পারলে দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব। আবার, বিমান চলাচলে ফ্লাইট ট্র্যাজেকটরি, ওভারহেড হোল্ডিং, ফ্লাইট ডিউরেশন, ফুয়েল কন্সাম্পশন ইত্যাদি কমিয়ে আনতে পারলে অর্থনৈতিক দিক থেকেও এফিশিয়েন্সি বাড়ে। ফুয়েল কন্সাম্পশন কমাতে পারা পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক হয়।

৬। আমাদের এই আকাশে উড়তে পারা সম্ভব হয়েছে প্রযুক্তি ও মানুষের নৈপুণ্যের ফসল হিসেবে। বিগত আশির দশকে ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (ICAO) নেতৃত্বে, ফিউচার এয়ার ন্যাভিগেশন সিস্টেম (FANS) – এই কন্সেপ্টের আওতায় নতুন কমিউনিকেশন, ন্যাভিগেশন ও সার্ভিল্যান্স টেকনোলজির সম্ভাব্য উপাদানগুলো, যা এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টে ব্যবহার করা সম্ভব, খুঁজে বের করা হয়। একে অনেকেই বলে থাকেন বিমান চলাচলে নেক্সট জেনারেশন টেকনোলজি। দু-দুটো FANS কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর, ICAO একুশ শতকের সম্ভাব্য নতুন সিস্টেমগুলোর জন্য যথারীতি স্ট্যান্ডার্ড প্রণয়ন করে এবং বিশ্বব্যাপী সমন্বিত প্রয়োগের উদ্দেশ্যে একটি বিশাল প্রোগ্রাম শুরু করে। বর্তমানে আমরা একটি ট্রানজিশন দশায় আছি বলা যায়। উন্নত বিশ্বে এর প্রয়োগ অনেকটাই হয়েছে, অনুন্নত বিশ্বেও এর প্রয়োগ বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে জোরেশোরে। অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী এর পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্পন্ন হবে বলেই আশা করা হচ্ছে। এই অগ্রসর প্রকৌশল ও প্রযুক্তিকে অবলম্বন করে বিমান চলাচল ব্যবস্থাপনায়ও আসছে বিরাট বিপ্লব। ICAO দুটি অঙ্গনে বিভক্ত করেছে এই ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তির বাস্তবায়ন ক্ষেত্রকে। অনুচ্ছেদ ৭ ও ৮ এ তা সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

৭। এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট (ATM)

৭.১। এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট বলতে প্রধানত বুঝায় এয়ারস্পেস ব্যবস্থাপনা, এয়ার ট্রাফিক প্রবাহ ও এয়ারস্পেস ক্যাপাসিটির ব্যবস্থাপনা এবং এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলকে। আকাশে এয়ারক্রাফট প্রবাহে দক্ষতা বাড়ানো এবং সেই সাথে তাদের মধ্যে নিরাপদ ব্যবধান বজায় রাখাই ATM এর উদ্দেশ্য। এই জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রসেস, প্রসেডিওর ও রিসোর্স ATM এর উপাদান। আগেই বলা হয়েছে, আকাশ উন্মুক্ত হলেও এয়ারক্রাফট চলাচল করে পূর্বনির্ধারিত পথে। অন্যদিকে, আকাশ পথে যাত্রী ও পণ্যের পরিবহন দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। এতে বাড়াতে হচ্ছে বিমানবন্দর ও ফ্লাইটের সংখ্যা। কিন্তু এয়ারস্পেস তো আমাদের যা আছে তা-ই – এতে তো আর বৃদ্ধি ঘটছে না। কাজেই এয়ার রুট ও এয়ারস্পেস ম্যানেজমেন্ট ক্রমাগতভাবে উন্নত না করে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ চাহিদা মেটাতে পারব না; একই সাথে ট্রাফিক প্রবাহ এবং এয়ারস্পেস ক্যাপাসিটিও ক্রমাগত বাড়াতে হবে।

৭.২। নিরাপত্তার জন্য বিমান চলাচল ভূমি থেকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। স্বভাবতই এই উদ্দেশ্যে একটি এরিয়ার জন্য কেবল একজন কন্ট্রোলার থাকেন ও তিনি তার এরিয়ার সকল বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন। এই নিয়ন্ত্রণের মূল লক্ষ্য হচ্ছে চলাচলরত এয়ারক্রাফটসমূহের পূর্বনির্ধারিত ন্যূনতম নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা। এই ন্যূনতম নিরাপদ দূরত্বকে বলা হয় সেপারেশন মিনিমা। কাজেই সেপারেশন মিনিমা যেন লঙ্ঘিত না হয় সেজন্য আকাশে এয়ারক্রফটসমূহের মধ্যে অগ্র-পশ্চাৎ ব্যবধান, উল্লম্ব ব্যবধান ও আনুভূমিক ব্যবধান যথাযথভাবে বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রসেডিওর ATC তথা ATM এর অন্যতম প্রায়োগিক উপাদান।

৮। কমিউনিকেশন, ন্যাভিগেশন, সার্ভিল্যান্স (CNS)

৮.১। এয়ার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে বা ব্যবস্থাপনায় যে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো ব্যবহৃত হয় তাকে প্রয়োগের ধরণ অনুসারে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়েছে: কমিউনিকেশন, ন্যাভিগেশন ও সার্ভিল্যান্স; একে সংক্ষেপে বলা হয় CNS। এই CNS অবকাঠামো নির্মিত হয় রেডিও ওয়েভ, কমিউনিকেশন ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল ও প্রযুক্তি দ্বারা। নির্বিঘ্ন, নিরাপদ ও সুদক্ষ বিমান চলাচল নিশ্চিত করতে হলে পাইলট ও কন্ট্রোলারের মধ্যে বা এক কন্ট্রোল স্টেশনের সাথে অন্য কন্ট্রোল স্টেশনের সময়োচিত যোগাযোগ অত্যাবশ্যক। আকাশে বিমান পথ নির্ধারিত করা এবং পাইলটের উদ্দেশ্যে ন্যাভিগেশন গাইডেন্স প্রদান করার জন্য নানাবিধ রেডিও ন্যাভিগেশন সিস্টেম স্থাপন করা প্রয়োজন হয়। তদুপরি, বিমানের নিরাপত্তার জন্য কন্ট্রোলারের প্রয়োজন হয় এমন সার্ভিল্যান্স সিস্টেম, যার মাধ্যমে তিনি তার কন্ট্রোল এরিয়ায় চলাচলরত এয়ারক্রাফটসমূহের প্রাত্যক্ষণিক অবস্থানের বাস্তব ট্রাফিক ম্যাপ ডিসপ্লে দেখতে পান।

৮.২। এয়ারস্পেসের ক্যাপাসিটি বাড়াতে হলে সেপারেশন মিনিমা কমিয়ে আনতে হবে। সেপারেশন মিনিমা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটানোর অর্থই হলো ATM-এ বিপ্লব ঘটানো। বলাই বাহুল্য, CNS-এ প্রভূত উন্নতি ছাড়া ATM-এ বিপ্লব আনা সম্ভব নয়। আর একারণেই আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে বিমান চলাচলে নেক্সট জেনারেশন টেকনোলজির দ্রুত বাস্তবায়ন।

চলবে…

রুশো—স্বর্গরাজ্য বনাম সামাজিক চুক্তি

জ্যাঁ জ্যাক রুশো তাঁর লেখা ‘দি সোশাল কন্ট্রাক্ট অর প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল রাইট’ নামক বইয়ের জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন। তিনি ব্যক্তির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, আইন প্রণয়ন, ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে তাঁর বইতে আলোচনা করেছেন। রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে সাধারণত সেই রাষ্ট্রের জনগণের উপাস্য ঈশ্বরের ভূমিকা নিয়েও তিনি আলোচনা করেছেন—কারণ সাধারণত রাজা সেই ঈশ্বরের ‘অনুমোদন’কে নিজের শাসনাধিকারের উৎস হিসেবে দাবী করে থাকে এবং আইন প্রণয়নে ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করে বলে মনে করে। এর বিরুদ্ধে ও বিপরীতে রুশো সামাজিক চুক্তিকে শাসনের অধিকার হিসেবে গ্রহণ করেন।

তিনি তাঁর বইয়ের চতুর্থ ভাগের অষ্টম অধ্যায়ে ‘সিভিল রিলিজিয়ন’ সম্বন্ধে বলেন, “The dogmas of civil religion ought to be few, simple, and exactly worded, without explanation or commentary. The existence of a mighty, intelligent and beneficent Divinity, possessed of foresight and providence, the life to come, the happiness of the just, the punishment of the wicked, the sanctity of the social contract and the laws: these are its positive dogmas. Its negative dogmas I confine to one, intolerance, which is a part of the cults we have rejected.”

কোরানে বিশ্বাসের বিষয়গুলোকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা অত্যন্ত সরল, কাণ্ডজ্ঞান তা বুঝতে সক্ষম এবং এগুলো হয়ে আছে নৈতিক জীবনের যৌক্তিক ভিত। জীবনের সাথে সম্পর্কহীন ও দুর্বোধ্য স্কলাস্টিক ডিটেইলস, যা আমাদের আকায়েদ শাস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে, তা পরবর্তী কালের উদ্ভাবন। কোরানের পুরো এপ্রোচটিই চুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত: অঙ্গিকার, শপথ, প্রতিশ্রুতি, চুক্তি, সন্ধিপত্র প্রতিপালন বা অনুসরণ করা কোরানের নৈতিক আদর্শের একটি অন্যতম প্রধান বিষয়। এমনকি ঈশ্বরের উপাসনাকেও কোরানে একটি চুক্তি বা কাভন্যান্ট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। লা ইকরাহা ফিদ্দীন, অর্থাৎ ধর্মে বা আনুগত্যে কোন শক্তি প্রয়োগ নেই—এই নীতি কোরানে স্পষ্ট ভাষায় বিধৃত হয়েছে।

তিনি তাঁর বইটির একই অধ্যায়ে মুহম্মদ (স) ও তাঁর উত্তরসূরি খলিফাদের শাসন সম্বন্ধে বলেন, “Mahomet held very sane views, and linked his political system well together; and, as long as the form of his government continued under the caliphs who succeeded him, that government was indeed one, and so far good.”

এখন প্রশ্ন হচ্ছে মুহম্মদ একই সাথে ঈশ্বরের বার্তাবাহক হয়েও সামাজিক চুক্তি অনুসরণ করতে পারেন কিভাবে? কোরান ঈশ্বরের বাণী, যেখানে নৈতিক নিয়ম ছাড়াও কিছু সিভিল আইনও রয়েছে, সেখানে তিনি ঈশ্বরের রাজত্ব বা স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন সেটিই অনেকে প্রত্যাশা বা ধারণা করে বসবেন। আমরা কোরানে বিধৃত নৈতিক ও রাজনৈতিক মত এবং মদিনার সনদ পরীক্ষা করলে দেখতে পাব ইসলাম ধর্মে একই সাথে দুটিকে সমন্বিত করা হয়েছে—অর্থাৎ ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ থেকে জাত ধর্ম ও সামাজিক চুক্তি থেকে উৎপন্ন নাগরিকতা সমন্বিত হয়েছে, কোন রকম স্ববিরোধ ছাড়াই। একারণে আল্লাহর নবী হওয়া সত্ত্বেও তিনি কাওকে তাঁর উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করে যাননি।

ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের প্রায়োগিক অর্থ হচ্ছে মানুষের উপর থেকে মানুষের প্রভুত্বের অবসান—অর্থাৎ প্রতিটি ব্যক্তি স্বাধীন ও স্বশাসনের অধিকারী। মুসলিমরা প্রত্যেকে তাই ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে এবং একই সাথে অন্যদের উপর প্রভুত্বের সকল আকাঙ্ক্ষাও পরিত্যাগ করে। ফলে সামাজিক চুক্তিই রাজনৈতিক সংগঠনের জন্য প্রথম আবশ্যিকতা হিসেবে দেখা দেয়। মদিনা সনদ এই প্রয়োজনটিই পূরণ করে। কোরানে বিধৃত রাজনৈতিক আদর্শটিতে তাই ‘স্বর্গরাজ্য’ ও সামাজিক চুক্তির মধ্যে কোন বিরোধ নেই—বরং সামাজিক চুক্তিই এই ‘স্বর্গরাজ্য’র ভিত্তি। আর এটিকেই বলা হয়েছে পৃথিবীতে আল্লাহর দ্বীন বা আনুগত্য বা বিচার বা নীতি প্রতিষ্ঠিত হওয়া—অর্থাৎ নিজ জ্ঞানমতো স্বাধীনভাবে ঈশ্বরের আনুগত্য করার ক্ষেত্রে একে অপরকে বাধা দেবে না, এবং ঈশ্বরের কর্তৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষেত্রেও একে অপরকে বাধা দেবে না।

নীচের চিত্রটির মাধ্যমে একটি মডেল উপস্থাপন করা গেল। মডেলটিতে যেভাবে মুসলিমদেরকে উপস্থাপন করা হয়েছে, অন্যদের বেলায়ও তার অনুরূপ হবে, ধর্ম বা ভাবাদর্শ অনুসারে। সিম্প্লিসিটির উদ্দেশ্যে ছবিটি এরূপ সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে।



চুক্তিটি একই সাথে ধর্মনিরপেক্ষ ও সর্বধর্মসম্মত হবে—অর্থাৎ এটি সার্বজনীন মানবিক মূল্যমান ভিত্তিক হবে, যার লক্ষ্য হবে ইহলোকে মানুষের জীবন উন্নত করা ও সমাজকে অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়া, যুক্তি ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে।

ঈশ্বরে বিশ্বাসীরা নিজ নিজ কিতাব ও চুক্তি অনুসারে নিজেদের জীবন পরিচালনা করবে ও ঈশ্বরের কাছে দায়ী থাকবে। ঈশ্বর নিরপেক্ষরা নিজ নিজ কিতাব/ভাবাদর্শ ও চুক্তি অনুসরণ করবে। রাষ্ট্র হিংসা ও অত্যাচার অবসানে সক্রিয় হবে আইনানুগভাবে। সকলেই রাষ্ট্রের কাছে দায়ী থাকবে চুক্তি অনুসারে। আর মানুষের মধ্যে মমত্ববোধের উদ্বোধনই হবে এর শিক্ষাব্যবস্থার মূলনীতি।

নাগরিক হিসেবে সকলে সমান ও পার্থক্যবিহীন হবে, একই আইন অনুসারে রাষ্ট্রের ব্যয়ভার বহন করবে, প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে সকলে সমভাবে অংশ নেবে, মুসলিমরা সেই সাথে অতিরিক্ত হিসেবে যাকাত দেবে।

নারীর কোরান – ১১ (সালিহাত)

১১.১। সুরা নিসার ৩৪ নং আয়াতের দ্বিতীয় বাকটিকে ‘সালিহাত’ বাক্য নামে অভিহিত করা যেতে পারে। প্রথম বাক্য—যাকে ‘রিজাল’ বাক্য বলা হয়েছিল—নারী সম্বন্ধে পুরুষের নিকট থেকে প্রত্যাশিত ও সঙ্গত অবস্থানকে তুলে ধরা হয়েছে। এর বিপরীতে, সালিহাত বাক্যে নারীদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ও যুক্তিযুক্ত অবস্থানকে তুলে ধরা হয়েছে। রিজাল বাক্যে শর্তহীনভাবে সকল পুরুষের কর্তব্য ও ভূমিকা স্থির করা হয়েছে। আর সালিহাত বাক্যে পুরুষের যথাযথ অবস্থানের বিপরীতে ‘সালিহাত’য়ের অবস্থান ও কর্তব্যকে উপস্থাপন করা হয়েছে।

فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللَّهُ ۚ

ফা আলসালিহাতু কানিতাতুন হাফিযাতুন লিলগায়িবি বিমা হাফিযাল্লাহু

১১.২। ফা

‘ফা’ শব্দের অনেক অর্থ হতে পারে, যেমন—and, then, for, therefore, so that, in that case, in consequence, afterwords ইত্যাদি। দুটি ঘটনা সম্বন্ধে পরপর বর্ণীত দুটি বাক্যকে যুক্ত করার জন্য ‘ফা’ ব্যবহার করা যায়; যেখানে ঘটনা দুটির মধ্যে কালগত বা অবস্থাগত ক্রম বা sequence ও তাদের মধ্যে কার্য-কারণরূপী নিকট সম্বন্ধ এর ধারণা থাকে। দুটি ঘটনার প্রথমটি যদি দ্বিতীয়টির সাথে কারণগত বা যৌক্তিক বা ক্রমগত সম্বন্ধে আবদ্ধ থাকে তবে দ্বিতীয়টির আগে ‘ফা’ বসিয়ে সেই ঘটনা প্রকাশক বাক্য দুটিকে যুক্ত করা যায়। বর্তমান আয়াতে প্রথমে রিজাল বাক্য দ্বারা পুরুষদের অবস্থান ও কর্তব্য স্থির করা হয়েছে। ও পরে এই সালিহাত বাক্যকে ‘ফা’ দ্বারা তার সাথে যুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ পুরুষের অগ্রণী ভূমিকা বা শর্তহীনভাবে তার যথাযথ অবস্থান গ্রহণের পর বা বিপরীতে বা তাতে সাড়া দিয়ে ‘সালিহাত’ নারীদের কী করণীয় হয় তা সম্বন্ধে কথা বলা হয়েছে।

১১.৩। সালিহাতু

১১.৩.১। ‘আমলে সালেহ’ শব্দটির সাথে আমরা খুবই পরিচিত। কোরানের বহু আয়াতে ‘আল্লাযিনা আমানু ওয়া আমেলুস সালিহাতি’ কথাটি রয়েছে। এটিকে ইসলাম ধর্মের মূলসূত্র বলা যায়। বাক্যটির অর্থ: ‘যারা আস্থাশীল ও সৎকর্মশীল’। ‘আমলে সালেহ’ শব্দের অনুবাদ ইংরেজিতে সাধারণত ‘righteous deed’, ‘good deed’ ইত্যাদি এবং বাংলায় ‘সৎকর্ম’ ইত্যাদি শব্দ দ্বারা করা হয়। কিন্তু এতে ‘সালেহ’ শব্দের প্রতি পূর্ণ সুবিচার হয় না। ‘সালাহা’ মূল শব্দের মধ্যে সংস্কার সাধন, সম্পর্কের বা অবস্থার এমন উন্নতিবিধান যা ন্যায়ের দিকে মানুষকে নিয়ে যায়, এবং মীমাংসা, প্রগতি, উন্নয়ন ইত্যাদির অভিধা রয়েছে।

১১.৩.২। দুটি দিক থেকে মানুষের সমাজে কর্মের মূল্য নির্ধারিত হতে পারে।

(ক) আমাদের মধ্যে ঐক্য যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে বিরোধ। শ্রম, পেশা, লিঙ্গ, জাতি, শ্রেণী, বর্ণ ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে আমাদের মধ্যে বিভাজন আছে। আবার আমরা সবাই মিলে একটি সমাজ, একটি বিশ্বও গঠন করি। পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্য ও লেনদেনে আকর্ষণ-বিকর্ষণের মতো দুটি বলের ক্রিয়া আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। যে কাজ, যে প্রয়াস অসম, অন্যায্য, অসুন্দর সম্পর্ক ও লেনদেনকে ক্রমাগতভাবে ন্যায়, সুন্দর ও শুভের দিকে নিয়ে যায়, সে সব কাজই ‘আমলে সালেহ’।

(খ) আমরা কেবল যে একটি দ্বান্দ্বিক অবস্থায় নিপতিত তা-ই নয়, আমরা ক্রমাগতভাবে বিকশিত হয়েও চলেছি। কোনো সমাজে সব সস্পর্ক ও লেনদেন মোটামোটি সন্তোষজনক হলেও বিকাশের প্রয়োজনটি থেকেই যায়। কাজেই সামাজিক সম্পর্কগুলোকে ক্রমাগতভাবে ন্যায় ও ভালর দিকে উন্নীত করার সাথে সাথে সামাজিক পরিবেশকে সুন্দরভাবে ও কল্যাণকরভাবে ক্রমবিকাশমান রাখতে যে কর্মশীলতা দরকার তা-ও ‘আমলে সালেহ’ এর অন্তর্ভুক্ত।

১১.৩.২। কাজেই ‘সালিহিন’ বলতে সংস্কার, প্রগতি, উন্নতি বা বিকাশের লক্ষ্যে সৎকর্মশীল ও ন্যায়ানুগ মানুষদেরকে বুঝায়। ‘সালিহিন’ এর স্ত্রীবাচক শব্দ হচ্ছে ‘সালিহাতুন’। ‘সালিহাতুন’ হচ্ছে সেইসব নারী যারা সংস্কার, উন্নতি ও প্রগতি সাধনে সক্রিয়—ইংরেজিতে তাদেরকে বলা যায় মুসলিম ‘রিফরমিস্ট’, ‘প্রোগ্রেসিভ’, ‘একটিভিস্ট’ নারী। সংস্কার, উন্নতি, প্রগতি সাধনে সক্রিয় হওয়া কেবল নারীদের বেলায় প্রযোজ্য কিছু নয়, পুরুষদের বেলায়ও একইরূপ কর্মশীলতা নির্ধারণ করা হয়েছে। নারীদের কর্তব্য যেমন ‘সালিহাতুন’য়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়া, তেমনই পুরুষদেরও একই কর্তব্য—অর্থাৎ ‘সালিহিন’য়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়া।

১১.৪। কানিতাতুন

১১.৪.১। ‘কানিতাতিন’ শব্দটি ‘কানিতিন’ শব্দের স্ত্রীবাচক রূপ। সাধারণত ইংরেজিতে ‘কানিতিন’ এর অর্থ করা হয়ে থাকে ‘devoutly obedient’ বা ‘একান্ত অনুগত’ হিসেবে। এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছার বা তাঁর নির্ধারিত নিয়মের আন্তরিক অনুসরণকারী বা committed হিসেবে। অর্থাৎ আল্লাহর প্রত্যাশার প্রতি (এখানে অল্লাহর প্রত্যাশাটি হচ্ছে গোপনেও গর্ভসংরক্ষণ, যা আবার বৈবাহিক চুক্তিরও অংশ) ও বিবাহচুক্তির প্রতি আন্তরিক ও কমিটেড। এই বাক্যাংশে 'স্বামী' শব্দটি নেই, 'স্বামীর অনুগত' অর্থ একটি অনুমান মাত্র।

১১.৪.২। আনুগত্য শর্তসাপেক্ষ বা বিচারসাপেক্ষ হয় না, আনুগত্য নিরঙ্কুশ। যদি কেউ বলেন যে, তিনি কারও কথা মানবেন যদি সেকথা আল্লাহর কথার সাথে সাংঘর্ষিক না হয়, তবে তিনি মূলত আল্লাহরই আনুগত্য করছেন; অন্যের নয়। অথবা কেউ যদি নিজের বিচারসাপেক্ষে কারও আনুগত্য করেন তবে তিনি নিজেরই আনুগত্য করছেন। উভয় ক্ষেত্রেই একজন প্রকৃত প্রস্তাবে অন্যের কথাকে বা সিদ্ধান্তকে অনুসরণ করছেন মাত্র। এই সিদ্ধান্তটি অন্যের মুখ থেকে আসার আগেই যদি কেউ নিজে থেকে সেই ধারণায় উপনীত হতে পারতেন তবে তিনি তা-ই করতেন। এই অনুসরণ শব্দের আরবি হচ্ছে ‘এতায়াত’। মুসলিমরা আল্লাহ ছাড়া কারও আনুগত্য করে না। এই আনুগত্যের আরবি শব্দ হচ্ছে ‘দ্বীন’। আমরা আল্লাহর বাণী অনুসরণ করতে পারি, পারি নবীকে অনুসরণ করতে, আবার পারি অন্যের সাথে নিজের কৃত চুক্তি অনুসরণ করতে অথবা সরকার ও উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকেও আমরা অনুসরণ করতে পারি সংবিধান বা নিজ কর্তৃক মেনে নেয়া বিধিমালা অনুযায়ী। ইসলাম শব্দের অর্থ নিজেকে সমর্পণ করা, যার ফলিত অর্থ আনুগত্য করা। কানিতিন বলতে প্রকৃত প্রস্তাবে ‘আন্তরিকভাবে ও অবিচলভাবে কর্তব্যপরায়ণ’-কে বুঝায়, যেখানে মুসলিমের নিকট কর্তব্যের উৎস আল্লাহর প্রত্যাশা ও মানুষের সাথে কৃত চুক্তি। এরূপ অনুসরণ আল্লাহর নির্দেশের অন্তর্ভূক্ত বিধায় অনুসরণ কাজে আল্লাহরই আনুগত্য করা হয়, যাকে অনুসরণ করা হয় তার নয়। মুসলিমের পক্ষে আল্লাহকে অমান্য করে আরও অনুসরণ যথাযথ কাজ নয়।

১১.৪.৩। কানিতাতিন’য়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়া কেবল নারীদেরই কর্তব্য নয়, কানিতিন’য়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়া পুরুষেরও কর্তব্য। কোরানের ৩৩:৩৫ আয়াতে আছে, “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণকারী পুরুষ (মুসলিমিনা) ও আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণকারী নারী (মুসলিমাতি), আল্লাহর উপর আস্থাশীল পুরুষ (মুমিনিনা) ও আল্লাহর উপর আস্থাশীল নারী (মুমিনাতি), কর্তব্যনিষ্ঠ পুরুষ (কানিতিনা) ও কর্তব্যনিষ্ঠ নারী (কানিতাতি), ... ... ...।” ৩:১৭ আয়াতেও নারী-পুরুষ সকলের জন্য ‘কানিতিনা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কাজেই এখানে নারীকে এমন কোন কাজের দিকে আহ্বান করা হচ্ছে না যা কেবল নারীর জন্যই প্রযোজ্য।

১১.৪.৪। যীশুর মাতা মেরি সম্বন্ধে কোরানের ৩:৪৩ আয়াতে বলা হয়েছে, “O Mary, be devoutly obedient (উকনুতি) to your Lord and prostrate and bow with those who bow.” অথচ আমরা জানি মেরির স্বামী ছিল না। আবার ইব্রাহিমের বেলায়ও, যিনি ছিলেন পুরুষ, ১৬:১২০ আয়াতে বলা হয়েছে, “Indeed, Abraham was a leader, devoutly obedient (কানিতান) to Allah, inclining toward truth, and he was not of those who associate others with Allah.”

১১.৫। হাফিযাতুন লিলগায়িবি বিমা হাফিযাল্লাহু

১১.৫.১। আমরা এই বাক্যাংশের অর্থটিকে সম্পূর্ণ সলিহাত বাক্যের সাথে নীচে তুলে ধরলাম।



বাক্যটি ইংরেজিতে এরূপ হতে পারে: “In response, the reformist women are dutyful and careful—in secret—regarding what Allah cares for.”

১১.৫.২। নারী বিবাহিত হোক বা অবিবাহিত, উভয় অবস্থাতেই গর্ভ সংরক্ষণ তার কর্তব্য বলে বিবেচিত হতে পারে। একথা সত্য যে, নারীর গর্ভ নারীর, এবং তাই বিবাহে তাকে বাধ্য করার অধিকার অন্যের নেই। বিবাহে যেমন জোর চলে না, তেমনই নারীর অনিচ্ছায় তাকে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখাও যায় না। কিন্তু একথাকেও ন্যায্য বলে বিবেচনা করা যায় যে, সন্তানের উপর পিতা বা মাতার কোন মালিকানা নেই—সন্তানও পিতা বা মাতার মতো স্বতন্ত্র স্বাধীন ব্যক্তিমানুষ। তাই কোন ব্যক্তির এরূপ প্রত্যাশা স্বৈরধর্মী যে, সে তার সন্তানের উপর যা চাপিয়ে দেবে সন্তানকে তা মেনে নিতে হবে, যেহেতু সে তার সন্তান। ব্যভিচার সন্তানকে তার পিতৃপরিচয় ও পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করার পথকে উন্মুক্ত বা সহজ করে দেয়।

১১.৫.৩। ইসলাম ধর্মে বিবাহ একটি সামাজিক চুক্তি—যা সমমর্যাদা সম্পন্ন দুই স্বাধীন পুরুষ ও নারীর মধ্যে সম্পাদিত হয়। এই চুক্তির প্রধান দুই শর্ত হচ্ছে: (ক) নারীর ভরণপোষণ ও সুরক্ষার সমুদয় দায়িত্ব স্বামীর উপর ন্যস্ত থাকবে—যা রিজাল বাক্য থেকে আসে এবং (খ) স্ত্রী গর্ভ সংরক্ষণ করবে।

১১.৫.৪। আল্লাহ নারীর কাছ থেকে এই সংরক্ষণ প্রত্যাশা করেন; বিবাহের চুক্তিমূলে ও যুক্তিবিচারে এই প্রত্যাশা অমূলক নয়। এই একটি বিষয় থেকে কোন স্ত্রী সরে গেলে তার পক্ষে বা সমর্থনে জোরালোভাবে দাঁড়ানোর ভিত অন্যদের জন্য ভেঙ্গে পরে। আমরা ইতোপূর্বে ‘পরিবার’ শীর্ষক ২ অনুচ্ছেদে এবিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যা এই পর্যায়ে আরও একবার পাঠ যেতে পারে।

১১.৬। কতিপয় অনুবাদ

Sahih International — So righteous women are devoutly obedient, guarding in [the husband's] absence what Allah would have them guard.

Pickthall — So good women are the obedient, guarding in secret that which Allah hath guarded.

Yusuf Ali — Therefore the righteous women are devoutly obedient, and guard in (the husband's) absence what Allah would have them guard.

Shakir — the good women are therefore obedient, guarding the unseen as Allah has guarded;

Muhammad Sarwar — Among virtuous women are those who are steadfast in prayer and dependable in keeping the secrets that God has protected.

Mohsin Khan — Therefore the righteous women are devoutly obedient (to Allah and to their husbands), and guard in the husband's absence what Allah orders them to guard (e.g. their chastity, their husband's property, etc.).

Arberry — Righteous women are therefore obedient, guarding the secret for God's guarding.

Daryabandi — Wherefore righteous women are obedient, and are watchers in husbands absence by the aid and protection of Allah.

Muhammad Ali — So the good women are obedient, guarding the unseen as Allah has guarded.

Sher Ali — So virtuous women are obedient, and guard the secrets of their husbands with God's protection.

Shehnaz — So the righteous women are obedient, guarding in the husbands absence what Allah orders them to guard.

Muhammad Asad — And the righteous women are the truly devout ones, who guard the intimacy which God has [ordained to be] guarded.

ইবন কাসিরের অনুবাদ — সুতরাং যে সমস্ত নারী পুণ্যবতী তারা আনুগত্য করে, আল্লাহর সংরক্ষিত প্রচ্ছন্ন বিষয় সংরক্ষণ করে;

কুতুবের অনুবাদ — অতএব সতী-সাধ্বী নারী হবে (একান্ত) অনুগত, (পুরুষদের) অনুপস্থিতিতে তারা (স্বয়ং) আল্লাহর তত্ত্বাবধানে (থেকে) নিজেদের (ইযযত-আবরু ও অন্যান্য) সব অদেখা কিছুর রক্ষণাবেক্ষণ করবে;

মউদুদির অনুবাদ — কাজেই সতী-সাধ্বী স্ত্রীরা আনুগত্যপরায়ণ হয় এবং পুরুষদের অনুপস্থিতিতে আল্লাহর হেফাজত ও তত্ত্বাবধানে তাদের অধিকার সংরক্ষণ করে থাকে।

শফির অনুবাদ — সেমতে নেককার স্ত্রীলোকেরা হয় অনুগতা এবং আল্লাহ যা হিফাযতযোগ্য করে দিয়েছেন লোকচক্ষুর অন্তরালেও তার হিফাযত করে।

১১.৬.২। কিন্তু ৪:৩৪ আয়াতে নারীর বেলায় ‘আনুগত্য’কে আমরা স্বামীর সাথে জুড়ে দিয়েছি এবং এমন একটি মানসিক অবস্থার সমার্থক করেছি যা থেকে নারী স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিনাবাক্যে স্বামীর ইচ্ছামতো চলবে। এই বাক্যে ‘স্বামী’ বা ‘পুরুষ’ শব্দ নেই। তবুও বেশিরভাগ অনুবাদক এই আনুগত্যকে স্বামীর আনুগত্যে পর্যবসিত করেছেন অনুমানের ভিত্তিতে। এটির উৎপত্তি হয়েছে তাদের প্রাথমিক এই ধারণাকে ‘শুদ্ধ’ সাব্যস্ত করা থেকে যে, পুরুষ মর্যাদায় নারী থেকে শ্রেষ্ঠ এবং পুরুষ নারীর কর্তা বা ব্যবস্থাপক।

১১.৬.৩। কিন্তু আমাদের কাছে থাকা অনুবাদগুলো পড়লে এই ধারণাই তৈরি হয় যে, আল্লাহ পুরুষকে নারীদের উপর কর্তৃত্বের আসনে নিয়োগ দিয়েছেন ও নারীদেরকে তার বিপরীতে স্বামীদের অনুগত থাকার আদেশ দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, ‘গায়িব’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে ‘স্বামীর অনুপস্থিতি’ বলে। এবং এর ভিত্তিতে স্বামীর অনুপস্থিতিতে কেবল যৌন পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা নয়, স্বামীর ধন-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পর্যন্ত নারীর কর্তব্যে পরিণত করা হয়েছে। এই আয়াত সংশ্লিষ্টে এটি খুবই অদ্ভুত কথা। ‘রিজাল’ বাক্য অনুসারে স্ত্রীর ভরণপোষণ এবং তার নিরাপত্তাবিধান স্বামীর কর্তব্যের অংশ। এমনকি স্ত্রীর জন্য রান্না করা খাবার, ঘরের পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদির ব্যবস্থা করাও ভরণপোষণের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত—যে কারণে স্ত্রী রান্না করা বা ঘর গোছানোর মতো গৃহস্থালি কাজগুলো করতেও বাধ্য নয়। এই বিধি মা, বোন বা কন্যার জন্যও প্রযোজ্য। আমাদের সমাজে যে নারীরা এসব কাজ করে থাকেন তারা দানমূলক কাজ করে থাকেন। তারা ইচ্ছা করলে পিতা, ভাই বা স্বামীর কাছ থেকে এজন্য অর্থ দাবী করতে পারেন। ইসলামের আইনবেত্তারা এতদূর বলেছেন যে, এমনকি সন্তানকে স্তন্যপান করানোর জন্যও স্ত্রী অর্থ দাবী করতে পারেন, যেহেতু সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্বও স্বামীর। কারো অনুপস্থিতিতে তার সম্পদ নষ্ট করা ইসলাম ধর্মের পরিপন্থী কাজ—তা সেটি নারীই করুক বা পুরুষই করুক; কিন্তু এই আয়াতের সাথে তার সম্পর্ক নেই—এই আয়াতের বিষয়বস্তু জীবনের আরও গুরুতর অধ্যায় নিয়ে।

১১.৭। প্রস্তাবিত অনুবাদ

“পুরুষরা নারীর সমর্থনে মজবুত ভাবে দাঁড়ায়, তাদেরকে আল্লাহ অন্যপক্ষের তুলনায় সুবিধা-সামর্থ্যে যে আধিক্য দিয়েছেন তা সহকারে এবং তাদের ব্যয়যোগ্য সম্পদ সহকারে। এর বিপরীতে, উন্নতি সাধনে সক্রিয় নারীরা কর্তব্যপরায়ণ হয় এবং আল্লাহ যা সংরক্ষণ করতে চান তারা তা গোপনেও সংরক্ষণ করে চলে।”

১১.৮। পুরুষের অগ্রভূমিকার নীতি

আগে লাহুন্না বাক্য নিয়ে আলোচনাকালে আমরা পুরুষের অগ্রভূমিকার কথা বলেছিলাম। এই আয়াতের বাক্য দুটির বিন্যাস ও বক্তব্যে সেই নীতির প্রয়োগ লক্ষণীয়। পুরুষের অবস্থান ও কর্তব্যকে প্রথমে শর্তহীনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ‘রিজাল’ অর্থাৎ ‘পুরুষেরা’ পদ ব্যবহার করা হয়েছে। এই শর্তপূরণের বিপরীতে ‘নিসা’ শব্দের বদলে ‘সালিহাত’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ নারীরা এই করবে—না বলে বলা হলো সংস্কারসাধক নারীদের এই করণীয়। অর্থাৎ, পুরুষরা তাদের কর্তব্য শর্তহীনভাবে পালন করবে এবং প্রথমে পালন করবে; এবং যদি সে তা না করে তবে নারীর কাছ থেকে প্রতিকর্তব্য প্রত্যাশা করার ভিত্তি সে হারায়। এই বাক্যে আল্লাহ নারীদের কর্তব্য নির্ধারণে তাদের প্রতি সহানুভূতির ভাষা ব্যবহার করেছেন ও তাদের অনুকূলে অবস্থান নিয়েছেন।

১১.৯। ‘বিমা’ শব্দের পুনরালোচনা

আমরা আগে দেখিয়েছি, কিভাবে রিজাল বাক্যে ব্যবহৃত ‘বিমা’ শব্দটিকে ‘যেহেতু’ দ্বারা অনুবাদ করা হয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় হলো এই একই আয়াতেও ‘বিমা’ শব্দটি সালিহাত বাক্যেও ব্যবহৃত হয়েছে। এখন দেখা যাক কোন অনুবাদক কোথায় কি অনুবাদ করেছে। রিজাল বাক্যে শব্দটি দুবার এসেছে, কিন্তু সালিহাত বাক্যে একবার। তবে যেহেতু অনুবাদকরা রিজালের বেলায় দুই স্থানেই একরকম শব্দ ব্যবহার করেছেন, তাই তাদের মধ্যে প্রথম ক্ষেত্রটি অনুসরণ করা হয়েছে।

রিজাল বাক্য

الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ ۚ

সালিহাত বাক্য

فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللَّهُ ۚ



আমরা উপরের ছক থেকে সাধারণ প্রবণতাটি লক্ষ করতে পারি। অধিকাংশই প্রথম ক্ষেত্রে ‘because’ ব্যবহার করেছেন। সহিহ ইন্টারন্যাশনাল উভয় ক্ষেত্রেই সমরূপ শব্দ ‘by what’/‘what’ ব্যবহার করলেও রিজাল বাক্যে বন্ধনীর ভেতর ‘right of’ শব্দ নিজ থেকে জুড়ে দিয়ে অর্থ ‘because’ এর চেয়েও ভয়াবহ করে তুলেছেন। মুহম্মদ আসাদ দুই ক্ষেত্রেই একরূপ শব্দ ব্যবহার করেছেন। এখানে লক্ষণীয় যে, সালিহাত বাক্যের পূর্বাপর শব্দ ‘বিমা’ শব্দটির জন্য ‘যেহেতু’ শব্দ ব্যবহারের কোন উপায়ই নেই।

১১.১০। বাক্য দুটির রেসিপ্রোসিটি

১১.১০.১। কোরানে নারী সম্বন্ধে যে কথা বলা হয়েছে, তার রেসিপ্রোকাল কথাও বৈধ হয়, প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতার বিষয়টি যুক্তিসঙ্গতভাবে বিবেচনায় রেখে। তাহলে এই আয়াতের রিজাল ও সালিহাত বাক্যের রেসিপ্রোকাল প্রকাশ কিরকম হতে পারে? আমরা এর চেষ্টা করে দেখতে পারি ও তা নীচে লিখলাম।

নারীরা পুরুষদের সমর্থনে মজবুতভাবে দাঁড়াবে, আল্লাহ তাদেরকে অন্য অংশের তুলনায় যে সামর্থ্যগত আধিক্য দিয়েছেন তা সহকারে এবং আল্লাহ যার সংরক্ষণ চান তার সংরক্ষণ সহকারে। এমতাবস্থায়, সংস্কারসাধক পুরুষরা কর্তব্যপরায়ণ হয়, এবং নারীদের ভরণপোষণ ও নিরাপত্তাবিধানে যত্নবান হয়।

১১.১০.২। এখানে নারীর সামর্থ্যগত আধিক্য হচ্ছে তার গর্ভধারণে সক্ষমতা, যে ক্ষেত্রে পুরুষ অক্ষম হয়ে আছে এবং সংরক্ষণের বিষয়টি হচ্ছে গর্ভ। কিন্তু শোষণবাদী বা আধিপত্যবাদী নীতি নির্ধারকরা বা আইন প্রণেতারা সাধারণত এই এপ্রোচটি – অর্থাৎ বঞ্চিত বা অত্যাচারিতদের কর্তব্য ও প্রতিপক্ষের অধিকার প্রথমে সাব্যস্ত করে দেয়ার নীতি – নিয়ে থাকে। যে সম্পর্কের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে অবিচার রয়ে গেছে বা যেখানে বাস্তবে এরূপ অবিচার বিদ্যমান, সেখানে এরূপভাবে নীতি প্রকাশ করা হলে তা শক্তিমানের পক্ষে যায় এবং তাদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। অত্যাচার করার জন্য শক্তির প্রয়োজন হয়। আর শক্তিমানের উপর তাই অগ্রভূমিকা বাধ্যতামূলক। শক্তিমানেরা আমাদের কাছে দুর্বল বলে বিবেচিত—ওমরের এরূপ নীতির পেছনে কাজ করেছে কোরানের এই নীতি; অর্থাৎ কোন বিরোধে শক্তিমান পক্ষকেই আগে কৈফিয়ত দিতে হবে, নিজেকে সংশোধন করতে হবে।

নারীর কোরান – ১০ (ফাদ্দালা)

১০.১। নিঈমা, ফাদল এবং দারাজাত

১০.১.১। আমরা বাংলা ভাষায় নেয়ামত, ফজিলত ও দারাজাত শব্দ তিনটি ব্যবহার করে থাকি। এগুলি আরবি থেকেই এসেছে। ‘নিঈমা’ বলতে বুঝায় এমন সব অবলম্বন ও বিষয় যা অস্তিত্বের জন্য সহায়ক, স্বাচ্ছন্দপূর্ণ, সুখকর এবং জীবনকে বিকশিত ও সফল করতে সহায়ক। যেমন, আলো, বাতাস, খাবার, সম্পদ, জ্ঞান, পথনির্দেশনা—এই সবই নিঈমা। আবার, মানব জীবনের মর্যাদা, মহিমা, মূল্য ইত্যাদিও আল্লাহর নিঈমা। ‘ফাদল’ বলতে বুঝায় সকল সামর্থ্য, ক্ষমতা, শক্তি ও তাদের উৎস, যা অবলম্বন করে জীবনকে সংরক্ষণ করা যায়, জীবন ও সমাজকে এগিয়ে নেয়া যায়। একই বিষয়কে নিঈমা হিসেবে গণ্য করা যায়, আবার তাকে ফাদল হিসেবেও দেখা যেতে পারে। যেমন, জ্ঞান একটি নিঈমা এবং একটি ফাদল—বিষয়টি জ্ঞানকে দেখার ও ব্যবহার করার কোণ থেকে বিচার্য। সত্তার বিকাশের উচ্চতা-নির্দেশক হিসেবে জ্ঞান নিঈমা, আবার কাজের সামর্থ্য হিসেবে তা ফাদল। নিঈমা প্রধানত ব্যক্তির নিজের অবস্থা ও স্বাচ্ছন্দের সাথে সম্পর্কিত এবং ফাদল প্রধানত ব্যক্তির দায়িত্ব, কর্তব্য ও কর্মের সাথে সম্পর্কিত, যা নিজের ও অন্যের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে।

১০.১.২। ফাদল শব্দের যে অর্থ উপরের অনুচ্ছেদে দেয়া হয়েছে তা পার্থিব জীবনের সামগ্রী ও সামর্থ্যের সাথে সম্পর্কিত। তবে জীবনের সফলতা ও সার্থকতা অর্জনের সাথে যে মহিমা, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কিত, তাও ফাদল শব্দের অর্থের মধ্যে নিহিত। যে জীবনবীক্ষায় এই মর্যাদা পার্থিব জীবনের সামগ্রী ও সামর্থ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, সে জীবনদর্শনে ফাদল এইসব সামগ্রী ও সামর্থ্য ভিত্তিক মর্যাদা বা শ্রেষ্ঠত্বের সমার্থক। আর যে জীবনবীক্ষায় জীবনের সাফল্য কর্তব্যপরায়ণতা ও নৈতিক সংগ্রামে চূড়ান্ত বিচারে সাফল্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, সে দর্শনে পার্থিব ফাদল কর্তব্যভারের উৎস এবং জীবনের সফলতা হিসেবে আল্লাহর বিচারে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব ফল হিসেবে অর্জিতব্য। কাজেই ফাদল শব্দের তাৎপর্যে ব্যাপকতা রয়েছে, কোরানের কোন বাক্যে এই শব্দের উদ্দিষ্ট তাৎপর্য বাক্যের কন্টেক্সট থেকে নির্ধারিতব্য—যা সামর্থ্যগত বা অর্জনগত আধিক্য থেকে মর্যাদা পর্যন্ত হতে পারে।

১০.১.৩। দারাজাত শব্দটি নিয়ে আগে আমরা আলোচনা করেছিলাম এবং দেখেছিলাম যে, এর সাথে ক্রম ও মাত্রা ভিত্তিক অগ্রসরমানতার অভিধা যুক্ত আছে। একটি ক্রমবিকাশমান সত্তা নানা স্তর পেরিয়ে বিকশিত হতে থাকলে আমরা বলতে পারি যে, সেটির দারাজাত বৃদ্ধি পাচ্ছে বা দারাজাতের পর দারাজাত অতিক্রম করে সেটি অগ্রসর হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়: নিউটনের মেধা বা অর্জন তাঁকে প্রদত্ত ফাদল। আবার আইনস্টাইনকেও অনুরূপ ফাদল দেয়া হলেও তিনি নিউটনকে ছাড়িয়ে অগ্রসর হয়েছেন বিধায় নিউটনের তুলনায় আইনস্টাইন দারাজাতেও অগ্রসর।

“Those messengers - some of them We caused to exceed [ফাদ্দালনা] others. Among them were those to whom Allah spoke, and He raised some of them in degree [দারাজাত]. And We gave Jesus, the Son of Mary, clear proofs, and We supported him with the Holy Spirit.” (কোরান ২:২৫৩)

১০.১.৩। উপরের আয়াতে নবীদের বেলায় ‘ফাদ্দালনা’ ও ‘দারাজাত’ শব্দ দুটি ব্যবহৃত হয়েছে। এই আয়াতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান যে, নবীদের মধ্যে সামর্থ্য, বৈশিষ্ট্য, অর্জন, অবদানে পার্থক্য রয়েছে এবং মানুষের চিন্তা ও ধর্মকে সম্প্রসারিত করার ক্ষেত্রে তারা একে অপরের চেয়ে বেশী অগ্রসর হয়েছেন। কিন্তু এই পার্থক্য সত্ত্বেও আমরা মুসলিমরা নবীদের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না—আমরা তাদের মর্যাদায় পার্থক্য করি না, তাদেরকে একটি ভ্রাতৃমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে দেখি এবং তাদের দ্বারা উপস্থাপিত ধর্মকে একটি ক্রমবিকাশমান সমগ্র হিসেবে দেখি। কোরানের ২:২৮৫ আয়াতে থেকে বিষয়টি অনুধাবন করা যায়।

“The Messenger has believed in what was revealed to him from his Lord, and so have the believers. All of them have believed in Allah and His angels and His books and His messengers, saying, “We make no distinction between any of His messengers.” (কোরান ২:২৮৫)

১০.২। কোরানে ফাদল ও ফাদ্দালা এর ব্যবহার

১০.২.১। ফাদল ও ফাদ্দালা কোরানে এসেছে অনেক স্থানে। এর অর্থ সাধারণত করা হয় যথাক্রমে ‘grace’, ‘bounty’, ‘favour’ এবং ‘to bestow’, ‘to prefer’, ‘to exceed’, ‘to favour’ শব্দ দিয়ে। আমরা ইতোপূর্বে যা বলেছি তা থেকে অনুমেয় যে, ফাদল আল্লাহর নিকট থেকে প্রাপ্ত দান, অনুগ্রহ, সামর্থ্য বা অর্জনগত অগ্রসরতা। আল্লাহর নির্বাচন বা নিয়মজাত ফল হিসেবে এগুলো ‘grace’, ‘favour’, ‘preference’ ইত্যাদি। নীচে কোরানের কিছু আয়াতের রেফারেন্স দেয়া হলো যেখানে ‘ফাদল’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।

to bestow, to prefer, to faviour অর্থে — ২:৪৭, ২:১২২, ২:২৫৩, ৪:৩২, ৪:৩৪, ৪:৯৫, ৬:৮৬, ৭:১৪০, ১৩:৪, ১৬:৭১, ১৭:২১, ১৭:৫৫, ১৭:৭০, ২৭:১৫, ৪৫:১৬।

to assert superiority অর্থে — ২৩:২৪

grace, bounty, faviour অর্থে — ২:৬৪, ২:৯০, ২:১০৫, ২:১৯৮, ২:২৩৭, ২:২৪৩, ২:২৫১, ২:২৬৮, ৩:৭৩, ৩:৭৪, ৩:১৫২, ৩:১৭০, ৩:১৭১, ৩:১৭৪, ৩:১৮০, ৪:৩২, ৪:৩৭, ৪:৫৪, ৪:৭০, ৪:৭৩, ৪:৮৩, ৪:১১৩, ৪:৪৭৩, ৪:১৭৫, ৫:২, ৫:৫৪, ৭:৩৯, ৮:২৯, ৯:২৮, ৯:৫৯, ৯:৭৪, ৯:৭৫, ৯:৭৬, ১০:৫৮, ১০:৬০, ১০:১০৭, ১১:৩, ১১:২৭, ১২:৩৮, ১৬:১৪, ১৭:১২, ১৭:৬৬, ১৭:৮৭, ২৪:১০, ২৪:১৪, ২৪:২০, ২৪:২১, ২৪:২২, ২৪:৩২, ২৪:৩৩, ২৪:৩৮, ২৭:১৬, ২৭:৪০, ২৭:৭৩, ২৮:৭৩, ৩০:২৩, ৩০:৪৫, ৩০:৪৬, ৩৩:৪৭, ৩৪:১০, ৩৫:১২, ৩৫:৩০, ৩৫:৩২, ৩৫:৩৫, ৪০:৬১, ৪২:২২, ৪২:২৬, ৪৪:৫৭, ৪৫:১২, ৪৮:২৯, ৪৯:৮, ৫৭:২১, ৫৭:২৯, ৫৯:৮, ৬২:৪, ৬২:১০, ৭৩:২০।

exellence, preference অর্থে — ১৭:২১, ১৭:৭০।

১০.৩। ফাদাল-এ মাত্রাভেদ প্রাকৃতিক

১০.৩.১। প্রকৃতিতে সামর্থ্য ও অগ্রগতি বণ্টনে পার্থক্য রয়েছে। মানুষের সমাজে এই পার্থক্য আবার বেড়ে যায় যদি সমাজটি বর্ণ, পেশা, সম্পদ, শ্রেণী, লিঙ্গ ইত্যাদির ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে একে অপরকে শোষণ করতে শুরু করে। এই ফারাক কতটুকু প্রাকৃতিক ও কতটুকু মানুষের নৈতিক পতনের ফল তা আলাদা করে নির্ণয় করা খুবই কঠিন। তবে বাস্তবতা হলো এই যে, এই ফারাক এখনও বিদ্যমান। আমাদের নৈতিক জীবনকে—অশুভের দিকে মানুষের পতন ও শুভের দিকে উত্থানের জন্য মানুষের সংগ্রাম উভয়কেই—প্রাকৃতিক হিসেবে গণ্য করা যায় এবং সম্পূর্ণ প্রপঞ্চটিই আল্লাহর সৃষ্টি। এই স্তর থেকে আমরা বলতে পারি যে, ফাদল ও দারাজাতে ফারাক আল্লাহর নির্বাচন ও আল্লাহর নিয়ম থেকে জাত। প্রকৃতিতে সর্বত্রই এই পার্থক্য আমরা দেখতে পাই। আর মানুষের বেলায় ফাদল নৈতিক কর্মের অবলম্বন, যে কর্মশীলতা তাকে চূড়ান্ত বিচারে সফল বা ব্যর্থ করতে পারে।

“And within the land are neighboring plots and gardens of grapevines and crops and palm trees, growing several from a root or otherwise, watered with one water; but We make some of them exceed [নুফাদ্দিলু] others in quality of fruit. Indeed in that are signs for a people who reason.” (কোরান ১৩:৪)

“Look how We have favored in provision [ফাদ্দালনা] some of them over others. But the Hereafter is greater in degrees of difference [দারাজাত] and greater in distinction [তাফদিলান].” (কোরান ১৭:২১)

১০.৩.২। কোরানের বেশ কিছু আয়াতে ফাদল-এ পার্থক্যের উল্লেখ রয়েছে। “কতককে কতকের উপর ‘ফাদল’ দেয়া”— একটি ঐশী তথা প্রাকৃতিক নীতি হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে। ভোগবাদী আত্মকেন্দ্রিক চিন্তার মানুষেরা এই ফারাককে ও নিজেদের সুবিধাজনক অবস্থাকে তাদের অহংকার, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্বে ও কর্তৃত্বের ভিত্তি হিসেবে দেখেছে এবং ‘ফাদল’কে এগুলোর সমার্থক করেছে। অন্যদিকে একই অবস্থাকে আল্লাহ কোরানে মানুষের নৈতিকতার ভিত ও নৈতিক সংগ্রামের ক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কোন দায়িত্ব কারও উপর আরোপ করার সময়, সেই দায়িত্ব পালনে সহায়ক ফাদলের অধিকারী হওয়াকে আল্লাহ দায়িত্ব আরোপের যুক্তি বা অবলম্বন হিসেবে উল্লেখ করেন।

১০.৪। ফাদল-এ মাত্রাভেদ মর্যাদা বা শ্রেষ্ঠত্ব বা কর্তৃত্বের সূচক হিসেবে দেখে ভ্রষ্টরা

১০.৪.১। নিঈমা, ফাদল ও দারাজাতের ভিত্তিতে মানুষ অহংকার ও আভিজাত্যের ভিত তৈরি করতে পারে। এই ক্ষেত্রে অহংকারী অভিজাতেরা আয়তনে ক্ষুদ্র হয়েও শক্তিতে বেশী হবার কারণে সমাজ ব্যবস্থাকে নিজেদের অনুকূলে গড়ে তুলতে থাকে। প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা আবার তাদের শক্তি বাড়াতেও থাকে। এরূপ সমাজে শক্তিমানের সামর্থ্যই মর্যাদার মাপকাঠি হয়ে উঠে এবং দুর্বল করে রাখা বঞ্চিতদেরকে এইরূপ মূল্যমান ও ব্যবস্থা বান্ধব শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষিত করে তোলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়: জমির মালিকানা, ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও সম্পদের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে জমিদার নিজেকে উচ্চ মর্যাদার আসনে স্থাপন করে। কিন্তু শস্য উৎপাদনে কৃষকদের ক্ষমতা, সামর্থ্য ও প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকলেও এবং তাদের উৎপন্ন শস্য খেয়ে জমিদার বেঁচে থাকলেও, কৃষকের সব সামর্থ্যকে মর্যাদাপূর্ণ কিছু নয় বলে উভয় পক্ষ কর্তৃকই পরিগণিত হয়।

১০.৪.২। কোরান অনুযায়ী নেয়ামত অহংকার, আভিজাত্য, সম্মান, শ্রেষ্ঠত্ব বা কর্তৃত্বের কোন গ্রহণযোগ্য বা বৈধ ভিত নয়। কোরানের ৮৯:১১-১২ আয়াতে আল্লাহ সীমালঙ্ঘণকারী, দুর্নীতিপরায়ণ, অত্যাচারী, বৈষম্যবাদী ও শোষণবাদী সমাজের অধিপতিদের নিন্দা করেছেন এবং তারপর সেই সুরার ১৫-২০ আয়াতে তাদের মূল্যবোধ ও কর্মকাণ্ডের চিত্র এঁকেছেন।

All of whom oppressed within the lands and multiplied iniquity therein. (কোরান ৮৯:১১-১২)

And as for man, when his Lord tries him and is generous to him and favors him, he says, “My Lord has honored me.” But when He tries him and restricts his provision, he says, “My Lord has humiliated me.” No! But you do not honor the orphan And you do not encourage one another to feed the poor. And you consume inheritance, devouring it altogether, And you love wealth with immense love. (কোরান ৮৯:১৫-২০)

১০.৪.৩। উপরের আয়াতে আমরা দেখছি যে, অহংকারী মানুষেরা শোষণ, দুর্নীতি, দমন ইত্যাদির মাধ্যমে বৈষম্যকে ক্রমাগত বাড়াতে থাকে এবং নিজেদের সামাজিক মর্যাদা ও অবস্থানের ভিত্তি হিসেবে ক্ষমতা ও বিত্তের আধিক্যকে গ্রহণ করে। এরা নেয়ামত, ফজল ও দারাজাত পেলে নিজেদেরকে সম্মানিত মনে করে এবং তারা সমাজের অপরাপর মানুষের কাছ থেকেও সম্মান পায়। এই সম্মানকে সে “আল্লাহ আমাকে সম্মানিত করেছেন” বলে প্রকাশ করে। সে এই সব বিষয়কে কর্তব্য পালনের সুযোগ, সামর্থ্য বা বাধ্যতা হিসেবে দেখে না। তারা বঞ্চিতদেরকে সম্মান করে না, দুর্বল করে রাখা অংশকে সমপর্যায়ে তুলে আনতে চায় না, তারা সাধারণ মানুষকে অসহায় করে রাখে ও তাদের প্রাপ্য অংশ আত্মসাৎ করতে থাকে, তাদেরকে প্রতারিত করে ও শোষণ করে।

১০.৪.৪। কোরানের ২৩:২৪ আয়াতে নবীদের বিরোধীদের মনোভাব ও মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়েছে।

But the eminent among those who disbelieved from his people said, “This is not but a man like yourselves who wishes to take precedence [ইয়াতাফাদ্দালা] over you; and if Allah had willed, He would have sent down angels. We have not heard of this among our forefathers.” (কোরান ২৩:২৪)

১০.৪.৫। এই আয়াতে ‘ইয়াতাফাদ্দালা’ শব্দটি ব্যবহার করছে নবীর বিরোধীরা। তারা বলতে চাচ্ছে যে, নবীর সংগ্রামের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের উপর ‘ফাদল’ অর্জন করা। একথা দিয়ে তারা কী বুঝতে চাচ্ছে? আমরা জানি নবীরা সকল ব্যক্তিমানুষকে অন্যের অধীনতা ও শোষণমূলক শ্রমদাসত্ব থেকে মুক্ত করতে চান, সকল মানুষের সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে চান। আর একারণেই কর্তৃত্ববাদী অভিজাতেরা নবীকে রুদ্ধ করতে নেমেছিল। তারা তাদের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যমান দ্বারা, তাদের কাজের লক্ষ্য দ্বারা নবীর কাজের বিচার করেছিল। ফলে তাদের কাছে ‘ফাদল’ আধিপত্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্বের সমার্থক হিসেবে পরিগণিত ছিল।

১০.৫। ফাদল-এ মাত্রাভেদ পরীক্ষা

১০.৫.১। আল্লাহর দৃষ্টিতে বা বিচারে জগতে ফাদলের অধিকারী হওয়ার সাথে সম্পর্ক হচ্ছে কর্তব্যের, দায়িত্বের ও কর্মের—মর্যাদাগত শ্রেষ্ঠত্বের বা কর্তৃত্বের নয়। নিঈমা, ফাদল ও দারাজাতে আধিক্য একজনকে অধিক কর্তব্যের মধ্যে নিপতিত করে, কর্তব্য পালনে অগ্রণী ভূমিকা বাধ্যতামূলক করে। এরূপ ফারাক আছে বলেই আমাদের জীবনে নৈতিক মূল্যমান ও নৈতিকতার অস্তিত্ব রয়েছে, নয়তো নৈতিক জীবন অর্থহীন হয়ে উঠতো। মানুষের জন্য আল্লাহর দৃষ্টিতে সম্মানই হচ্ছে প্রকৃত সম্মান ও চূড়ান্ত সম্মান। এই সম্মান অর্জিত হতে পারে এই নিঈমা, ফাদল ও দারাজাত সম্পর্কিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সফল হওয়ার মাধ্যমে। তাই নবীদের বিচারে ‘ফাদল’ কর্তব্যভারের সমার্থক—শ্রেষ্ঠত্ব বা কর্তৃত্বের নয়।

And We did certainly give the Children of Israel the Scripture and judgement and prophethood, and We provided them with good things and preferred them over the worlds. (কোরান ৪৫:১৬)

O Children of Israel, remember My favor that I have bestowed upon you and that I preferred you over the worlds. (কোরান ২:৪৭) (কোরান ২:১২২)

১০.৫.২। নবী ও নবীদের মাধ্যমে পাওয়া পথনির্দেশনা, প্রজ্ঞা, জ্ঞান ইত্যাদি আল্লাহর নেয়ামত যা অবলম্বন করে একটি সম্প্রদায় নিজেদেরকে বিকশিত করতে পারে। এসবই আল্লাহর ফজল যা দিয়ে তারা মানবজাতিকে, বিশ্বকে লালন করতে পারে এবং পারে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে। কিন্তু ইসরাইলিরা যখন কর্তব্যকে পিছনে ফেলে এই নেয়ামত ও ফজলকে জেন্টাইলদের সামনে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের ভিত হিসেবে দেখল এবং এই দাবী করে বসলো যে তারাই আল্লাহর নির্বাচিত জাতি, তখন তারা আল্লাহর কথার উপর ভ্রান্ত অর্থ আরোপ করলো। আল্লাহ তাদেরকে তাঁর ‘ফাদল’-এর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, অর্থাৎ তাদের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করতে চাচ্ছেন।

১০.৬। ফাদল-এ মাত্রাভেদ কর্তব্যভারের সূচক

১০.৬.১। আগের ১০.৪.২ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত ৮৯:১৫ আয়াতে বলা হয়েছে যে, ‘ফাদল’ আল্লাহর পরীক্ষা। জগতে নেয়ামত, ফজল ও দারাজাতে পার্থক্য পরীক্ষার বিষয় বা ক্ষেত্র—অর্থাৎ কর্তব্যভার ও দায়িত্বভার এসবের সমানুপাতে হয়। আখেরাতের নেয়ামত, ফজল ও দারাজাত এই পরীক্ষায় সাফল্যের মাত্রা অনুসারে হবে, মানুষের কর্মের ফল হিসেবে। যে পৃথিবীতে প্রাপ্ত নেয়ামত ইত্যাদিকে অহংকার, ভোগ-বিলাস, মর্যাদার ভিত ও মাপকাঠি হিসেবে দেখবে, পরার্থপরতার বদলে সঞ্চয়কামী হবে, বৈষম্যবাদী হবে, সে পরীক্ষায় ব্যর্থ হবে। ১৭:২১ আয়াতে (১০.৩.১ অনুচ্ছেদ) একথাই বলা হয়েছে।

১০.৭। নারী-পুরুষে ফাদল-এ পার্থক্য

১০.৭.১। এবার দেখা যাক কোরানের ৪:৩৪ আয়াতে নারী-পুরুষের মধ্যে ফাদলে পার্থক্যের মর্ম কী? আয়তটিতে বলা হয়েছে, “ফাদ্দালাল্লাহু বায়্‌দাহুম আলা বায়্‌দিন”—যার অর্থ “আল্লাহ এককে অপরের তুলনায় ‘ফাদল’ দিয়েছেন”।

Sahih International — Allah has given one over the other...

Pickthall — Allah hath made the one of them to excel the other...

Yusuf Ali — Allah has given the one more (strength) than the other...

Shakir — Allah has made some of them to excel others...

Muhammad Sarwar — the greater preference that God has given to some of them...

Mohsin Khan — Allah has made one of them to excel the other...

Arberry — God has preferred in bounty one of them over another...

Sher Ali — God has made some of them excel others...

Daryabandi — Allah hath made one of them excel over anot her...

Muhammad Asad — the bounties which God has bestowed more abundantly on the former than on the latter...

Shehnaz — Allah has bestowed some of them over others...

১০.৭.২। আমরা দেখছি যে, ইংরেজিতে ‘ফাদ্দালা’ ক্রিয়া পদটির অনুবাদে যে শব্দগুলো সাধারণত ব্যবহৃত হয় সেগুলো হচ্ছে: ‘to give’, ‘to make excel’, ‘to give greater preference’, ‘to prefer in bounty’, ‘to bestow bounties more sbundantly’ ইত্যাদি। এখানে নারীর প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তাবিধান, ভরণপোষণ, অবস্থার উন্নতিবিধান ইত্যাদি সকল কাজে পুরুষের যে সামর্থ্যগত আধিক্য রয়েছে তার কথাই বলা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে নারীর চেয়ে পুরুষের সুবিধা, সামর্থ্য, শক্তি, সক্ষমতায় আধিক্য রয়েছে বলেই পুরুষ নারীর উপর প্রাধান্য বজায় রেখেছে ও নারীর উপর অবিচার করে চলেছে।

১০.৭.৩। কিন্তু এই আধিক্য পুরুষের কর্তব্য ঠিক করে দেয়, তাকে নারীর উপর কোন কর্তৃত্বাধিকার বা শ্রেষ্ঠত্ব বা মর্যাদা দেয় না। নারীরও রয়েছে গর্ভধারণের সক্ষমতা, যা পুরুষের নেই। নারীর এই সামর্থ্যগত আধিক্যও, একইভাবে, নারীর কর্তব্য ঠিক করে দেয়, শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তি দেয় না। যদি বৈষম্যকামী প্রচলিত মূল্যমানের উপর ভিত্তি করে ‘ফাদল’ বা সক্ষমতাকে শ্রেষ্ঠত্ব, মর্যাদা বা কর্তৃত্বের অধিকার বিবেচনা করা হয় তবে পুরুষের চেয়ে নারীর মর্যাদা বেশী বলে দাবী করাও সম্ভব। কারণ পুরুষের সক্ষমতা নিছক শ্রমিকের সক্ষমতার ন্যায়, কিন্তু গর্ভের অধিকারী নারীর সক্ষমতা সৃজনধর্মী।

১০.৭.৪। কিন্তু শক্তি ও ক্ষমতাকে ভিত্তি করে পুরুষ যে পুরুষতান্ত্রিক মূল্যমান প্রতিষ্ঠিত করেছে তার প্রভাবে এই আয়াতের ভ্রান্ত অর্থ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে, যা ‘ফাদল’ সংক্রান্ত কোরানের দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত, নবীর জীবনাদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। এই বিপরীত তাৎপর্য ভ্রষ্টদের নীতির অনুরূপ। কোন কোন ইংরেজি অনুবাদের সাথে সাথে বাংলা অনুবাদগুলোতে এরূপ প্রবণতা স্পষ্টই বিদ্যমান।

ইবন কাসিরের অনুবাদ — আল্লাহ তাদের মধ্যে একের উপর অপরকে গৌরবান্বিত করেছেন...

মউদুদির অনুবাদ — আল্লাহ তাদের একজনকে অন্যজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন...

কুতুবের অনুবাদ — কারণ আল্লাহ তায়ালা এদের একজনকে আরেকজনের উপর (কিছু বিশেষ) মর্যাদা প্রদান করেছেন...

ইসলামিক ফাউন্ডেশন — আল্লাহ তাদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়াছেন...

মুহম্মদ শফির অনুবাদ — আল্লাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন...

উপরের অনুবাদগুলোর মধ্যে শফি’র অনুবাদে ‘বৈশিষ্ট্য’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যা সামর্থ্যগত আধিক্য। কিন্তু অন্যেরা ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ এবং একজন রীতিমতো ‘গৌরবান্বিত’ শব্দটি পর্যন্ত ব্যবহার করে বসেছেন। কোরান ও এর তফসিরের বাংলা অনুবাদসমূহে ‘ফাদল’ ও ‘দারাজাত’ শব্দদুটির উভয়ের ক্ষেত্রেই এই ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ শব্দটির ঢালাও ব্যবহারের প্রবণতা অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে লক্ষণীয়।

১০.৭.৫। বর্তমান আয়াতে নারীর প্রতি পুরুষের কর্তব্য নিয়ে আলোচনা হয়েছে, পুরুষের কর্তৃত্বের বা শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দেয়া হচ্ছে না। কাজেই এখানে ফাদল দ্বারা পুরুষের কর্তব্য সংক্রান্ত সামর্থ্যগত আধিক্যকে বুঝানো হচ্ছে।