Do to others what you would have them do to you, for this sums up the Law and the Prophets. (Gospel according to Matthew 7:12)
Stand out firmly with justice as witnesses for God, even if it be against yourselves or parents and relatives, be he rich or poor. (Koran 4:135)

শুক্রবার, ২ মে, ২০১৪

নারীর কোরান – ১১ (সালিহাত)

১১.১। সুরা নিসার ৩৪ নং আয়াতের দ্বিতীয় বাকটিকে ‘সালিহাত’ বাক্য নামে অভিহিত করা যেতে পারে। প্রথম বাক্য—যাকে ‘রিজাল’ বাক্য বলা হয়েছিল—নারী সম্বন্ধে পুরুষের নিকট থেকে প্রত্যাশিত ও সঙ্গত অবস্থানকে তুলে ধরা হয়েছে। এর বিপরীতে, সালিহাত বাক্যে নারীদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ও যুক্তিযুক্ত অবস্থানকে তুলে ধরা হয়েছে। রিজাল বাক্যে শর্তহীনভাবে সকল পুরুষের কর্তব্য ও ভূমিকা স্থির করা হয়েছে। আর সালিহাত বাক্যে পুরুষের যথাযথ অবস্থানের বিপরীতে ‘সালিহাত’য়ের অবস্থান ও কর্তব্যকে উপস্থাপন করা হয়েছে।

فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللَّهُ ۚ

ফা আলসালিহাতু কানিতাতুন হাফিযাতুন লিলগায়িবি বিমা হাফিযাল্লাহু

১১.২। ফা

‘ফা’ শব্দের অনেক অর্থ হতে পারে, যেমন—and, then, for, therefore, so that, in that case, in consequence, afterwords ইত্যাদি। দুটি ঘটনা সম্বন্ধে পরপর বর্ণীত দুটি বাক্যকে যুক্ত করার জন্য ‘ফা’ ব্যবহার করা যায়; যেখানে ঘটনা দুটির মধ্যে কালগত বা অবস্থাগত ক্রম বা sequence ও তাদের মধ্যে কার্য-কারণরূপী নিকট সম্বন্ধ এর ধারণা থাকে। দুটি ঘটনার প্রথমটি যদি দ্বিতীয়টির সাথে কারণগত বা যৌক্তিক বা ক্রমগত সম্বন্ধে আবদ্ধ থাকে তবে দ্বিতীয়টির আগে ‘ফা’ বসিয়ে সেই ঘটনা প্রকাশক বাক্য দুটিকে যুক্ত করা যায়। বর্তমান আয়াতে প্রথমে রিজাল বাক্য দ্বারা পুরুষদের অবস্থান ও কর্তব্য স্থির করা হয়েছে। ও পরে এই সালিহাত বাক্যকে ‘ফা’ দ্বারা তার সাথে যুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ পুরুষের অগ্রণী ভূমিকা বা শর্তহীনভাবে তার যথাযথ অবস্থান গ্রহণের পর বা বিপরীতে বা তাতে সাড়া দিয়ে ‘সালিহাত’ নারীদের কী করণীয় হয় তা সম্বন্ধে কথা বলা হয়েছে।

১১.৩। সালিহাতু

১১.৩.১। ‘আমলে সালেহ’ শব্দটির সাথে আমরা খুবই পরিচিত। কোরানের বহু আয়াতে ‘আল্লাযিনা আমানু ওয়া আমেলুস সালিহাতি’ কথাটি রয়েছে। এটিকে ইসলাম ধর্মের মূলসূত্র বলা যায়। বাক্যটির অর্থ: ‘যারা আস্থাশীল ও সৎকর্মশীল’। ‘আমলে সালেহ’ শব্দের অনুবাদ ইংরেজিতে সাধারণত ‘righteous deed’, ‘good deed’ ইত্যাদি এবং বাংলায় ‘সৎকর্ম’ ইত্যাদি শব্দ দ্বারা করা হয়। কিন্তু এতে ‘সালেহ’ শব্দের প্রতি পূর্ণ সুবিচার হয় না। ‘সালাহা’ মূল শব্দের মধ্যে সংস্কার সাধন, সম্পর্কের বা অবস্থার এমন উন্নতিবিধান যা ন্যায়ের দিকে মানুষকে নিয়ে যায়, এবং মীমাংসা, প্রগতি, উন্নয়ন ইত্যাদির অভিধা রয়েছে।

১১.৩.২। দুটি দিক থেকে মানুষের সমাজে কর্মের মূল্য নির্ধারিত হতে পারে।

(ক) আমাদের মধ্যে ঐক্য যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে বিরোধ। শ্রম, পেশা, লিঙ্গ, জাতি, শ্রেণী, বর্ণ ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে আমাদের মধ্যে বিভাজন আছে। আবার আমরা সবাই মিলে একটি সমাজ, একটি বিশ্বও গঠন করি। পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্য ও লেনদেনে আকর্ষণ-বিকর্ষণের মতো দুটি বলের ক্রিয়া আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। যে কাজ, যে প্রয়াস অসম, অন্যায্য, অসুন্দর সম্পর্ক ও লেনদেনকে ক্রমাগতভাবে ন্যায়, সুন্দর ও শুভের দিকে নিয়ে যায়, সে সব কাজই ‘আমলে সালেহ’।

(খ) আমরা কেবল যে একটি দ্বান্দ্বিক অবস্থায় নিপতিত তা-ই নয়, আমরা ক্রমাগতভাবে বিকশিত হয়েও চলেছি। কোনো সমাজে সব সস্পর্ক ও লেনদেন মোটামোটি সন্তোষজনক হলেও বিকাশের প্রয়োজনটি থেকেই যায়। কাজেই সামাজিক সম্পর্কগুলোকে ক্রমাগতভাবে ন্যায় ও ভালর দিকে উন্নীত করার সাথে সাথে সামাজিক পরিবেশকে সুন্দরভাবে ও কল্যাণকরভাবে ক্রমবিকাশমান রাখতে যে কর্মশীলতা দরকার তা-ও ‘আমলে সালেহ’ এর অন্তর্ভুক্ত।

১১.৩.২। কাজেই ‘সালিহিন’ বলতে সংস্কার, প্রগতি, উন্নতি বা বিকাশের লক্ষ্যে সৎকর্মশীল ও ন্যায়ানুগ মানুষদেরকে বুঝায়। ‘সালিহিন’ এর স্ত্রীবাচক শব্দ হচ্ছে ‘সালিহাতুন’। ‘সালিহাতুন’ হচ্ছে সেইসব নারী যারা সংস্কার, উন্নতি ও প্রগতি সাধনে সক্রিয়—ইংরেজিতে তাদেরকে বলা যায় মুসলিম ‘রিফরমিস্ট’, ‘প্রোগ্রেসিভ’, ‘একটিভিস্ট’ নারী। সংস্কার, উন্নতি, প্রগতি সাধনে সক্রিয় হওয়া কেবল নারীদের বেলায় প্রযোজ্য কিছু নয়, পুরুষদের বেলায়ও একইরূপ কর্মশীলতা নির্ধারণ করা হয়েছে। নারীদের কর্তব্য যেমন ‘সালিহাতুন’য়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়া, তেমনই পুরুষদেরও একই কর্তব্য—অর্থাৎ ‘সালিহিন’য়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়া।

১১.৪। কানিতাতুন

১১.৪.১। ‘কানিতাতিন’ শব্দটি ‘কানিতিন’ শব্দের স্ত্রীবাচক রূপ। সাধারণত ইংরেজিতে ‘কানিতিন’ এর অর্থ করা হয়ে থাকে ‘devoutly obedient’ বা ‘একান্ত অনুগত’ হিসেবে। এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছার বা তাঁর নির্ধারিত নিয়মের আন্তরিক অনুসরণকারী বা committed হিসেবে। অর্থাৎ আল্লাহর প্রত্যাশার প্রতি (এখানে অল্লাহর প্রত্যাশাটি হচ্ছে গোপনেও গর্ভসংরক্ষণ, যা আবার বৈবাহিক চুক্তিরও অংশ) ও বিবাহচুক্তির প্রতি আন্তরিক ও কমিটেড। এই বাক্যাংশে 'স্বামী' শব্দটি নেই, 'স্বামীর অনুগত' অর্থ একটি অনুমান মাত্র।

১১.৪.২। আনুগত্য শর্তসাপেক্ষ বা বিচারসাপেক্ষ হয় না, আনুগত্য নিরঙ্কুশ। যদি কেউ বলেন যে, তিনি কারও কথা মানবেন যদি সেকথা আল্লাহর কথার সাথে সাংঘর্ষিক না হয়, তবে তিনি মূলত আল্লাহরই আনুগত্য করছেন; অন্যের নয়। অথবা কেউ যদি নিজের বিচারসাপেক্ষে কারও আনুগত্য করেন তবে তিনি নিজেরই আনুগত্য করছেন। উভয় ক্ষেত্রেই একজন প্রকৃত প্রস্তাবে অন্যের কথাকে বা সিদ্ধান্তকে অনুসরণ করছেন মাত্র। এই সিদ্ধান্তটি অন্যের মুখ থেকে আসার আগেই যদি কেউ নিজে থেকে সেই ধারণায় উপনীত হতে পারতেন তবে তিনি তা-ই করতেন। এই অনুসরণ শব্দের আরবি হচ্ছে ‘এতায়াত’। মুসলিমরা আল্লাহ ছাড়া কারও আনুগত্য করে না। এই আনুগত্যের আরবি শব্দ হচ্ছে ‘দ্বীন’। আমরা আল্লাহর বাণী অনুসরণ করতে পারি, পারি নবীকে অনুসরণ করতে, আবার পারি অন্যের সাথে নিজের কৃত চুক্তি অনুসরণ করতে অথবা সরকার ও উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকেও আমরা অনুসরণ করতে পারি সংবিধান বা নিজ কর্তৃক মেনে নেয়া বিধিমালা অনুযায়ী। ইসলাম শব্দের অর্থ নিজেকে সমর্পণ করা, যার ফলিত অর্থ আনুগত্য করা। কানিতিন বলতে প্রকৃত প্রস্তাবে ‘আন্তরিকভাবে ও অবিচলভাবে কর্তব্যপরায়ণ’-কে বুঝায়, যেখানে মুসলিমের নিকট কর্তব্যের উৎস আল্লাহর প্রত্যাশা ও মানুষের সাথে কৃত চুক্তি। এরূপ অনুসরণ আল্লাহর নির্দেশের অন্তর্ভূক্ত বিধায় অনুসরণ কাজে আল্লাহরই আনুগত্য করা হয়, যাকে অনুসরণ করা হয় তার নয়। মুসলিমের পক্ষে আল্লাহকে অমান্য করে আরও অনুসরণ যথাযথ কাজ নয়।

১১.৪.৩। কানিতাতিন’য়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়া কেবল নারীদেরই কর্তব্য নয়, কানিতিন’য়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়া পুরুষেরও কর্তব্য। কোরানের ৩৩:৩৫ আয়াতে আছে, “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণকারী পুরুষ (মুসলিমিনা) ও আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণকারী নারী (মুসলিমাতি), আল্লাহর উপর আস্থাশীল পুরুষ (মুমিনিনা) ও আল্লাহর উপর আস্থাশীল নারী (মুমিনাতি), কর্তব্যনিষ্ঠ পুরুষ (কানিতিনা) ও কর্তব্যনিষ্ঠ নারী (কানিতাতি), ... ... ...।” ৩:১৭ আয়াতেও নারী-পুরুষ সকলের জন্য ‘কানিতিনা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কাজেই এখানে নারীকে এমন কোন কাজের দিকে আহ্বান করা হচ্ছে না যা কেবল নারীর জন্যই প্রযোজ্য।

১১.৪.৪। যীশুর মাতা মেরি সম্বন্ধে কোরানের ৩:৪৩ আয়াতে বলা হয়েছে, “O Mary, be devoutly obedient (উকনুতি) to your Lord and prostrate and bow with those who bow.” অথচ আমরা জানি মেরির স্বামী ছিল না। আবার ইব্রাহিমের বেলায়ও, যিনি ছিলেন পুরুষ, ১৬:১২০ আয়াতে বলা হয়েছে, “Indeed, Abraham was a leader, devoutly obedient (কানিতান) to Allah, inclining toward truth, and he was not of those who associate others with Allah.”

১১.৫। হাফিযাতুন লিলগায়িবি বিমা হাফিযাল্লাহু

১১.৫.১। আমরা এই বাক্যাংশের অর্থটিকে সম্পূর্ণ সলিহাত বাক্যের সাথে নীচে তুলে ধরলাম।



বাক্যটি ইংরেজিতে এরূপ হতে পারে: “In response, the reformist women are dutyful and careful—in secret—regarding what Allah cares for.”

১১.৫.২। নারী বিবাহিত হোক বা অবিবাহিত, উভয় অবস্থাতেই গর্ভ সংরক্ষণ তার কর্তব্য বলে বিবেচিত হতে পারে। একথা সত্য যে, নারীর গর্ভ নারীর, এবং তাই বিবাহে তাকে বাধ্য করার অধিকার অন্যের নেই। বিবাহে যেমন জোর চলে না, তেমনই নারীর অনিচ্ছায় তাকে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখাও যায় না। কিন্তু একথাকেও ন্যায্য বলে বিবেচনা করা যায় যে, সন্তানের উপর পিতা বা মাতার কোন মালিকানা নেই—সন্তানও পিতা বা মাতার মতো স্বতন্ত্র স্বাধীন ব্যক্তিমানুষ। তাই কোন ব্যক্তির এরূপ প্রত্যাশা স্বৈরধর্মী যে, সে তার সন্তানের উপর যা চাপিয়ে দেবে সন্তানকে তা মেনে নিতে হবে, যেহেতু সে তার সন্তান। ব্যভিচার সন্তানকে তার পিতৃপরিচয় ও পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করার পথকে উন্মুক্ত বা সহজ করে দেয়।

১১.৫.৩। ইসলাম ধর্মে বিবাহ একটি সামাজিক চুক্তি—যা সমমর্যাদা সম্পন্ন দুই স্বাধীন পুরুষ ও নারীর মধ্যে সম্পাদিত হয়। এই চুক্তির প্রধান দুই শর্ত হচ্ছে: (ক) নারীর ভরণপোষণ ও সুরক্ষার সমুদয় দায়িত্ব স্বামীর উপর ন্যস্ত থাকবে—যা রিজাল বাক্য থেকে আসে এবং (খ) স্ত্রী গর্ভ সংরক্ষণ করবে।

১১.৫.৪। আল্লাহ নারীর কাছ থেকে এই সংরক্ষণ প্রত্যাশা করেন; বিবাহের চুক্তিমূলে ও যুক্তিবিচারে এই প্রত্যাশা অমূলক নয়। এই একটি বিষয় থেকে কোন স্ত্রী সরে গেলে তার পক্ষে বা সমর্থনে জোরালোভাবে দাঁড়ানোর ভিত অন্যদের জন্য ভেঙ্গে পরে। আমরা ইতোপূর্বে ‘পরিবার’ শীর্ষক ২ অনুচ্ছেদে এবিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যা এই পর্যায়ে আরও একবার পাঠ যেতে পারে।

১১.৬। কতিপয় অনুবাদ

Sahih International — So righteous women are devoutly obedient, guarding in [the husband's] absence what Allah would have them guard.

Pickthall — So good women are the obedient, guarding in secret that which Allah hath guarded.

Yusuf Ali — Therefore the righteous women are devoutly obedient, and guard in (the husband's) absence what Allah would have them guard.

Shakir — the good women are therefore obedient, guarding the unseen as Allah has guarded;

Muhammad Sarwar — Among virtuous women are those who are steadfast in prayer and dependable in keeping the secrets that God has protected.

Mohsin Khan — Therefore the righteous women are devoutly obedient (to Allah and to their husbands), and guard in the husband's absence what Allah orders them to guard (e.g. their chastity, their husband's property, etc.).

Arberry — Righteous women are therefore obedient, guarding the secret for God's guarding.

Daryabandi — Wherefore righteous women are obedient, and are watchers in husbands absence by the aid and protection of Allah.

Muhammad Ali — So the good women are obedient, guarding the unseen as Allah has guarded.

Sher Ali — So virtuous women are obedient, and guard the secrets of their husbands with God's protection.

Shehnaz — So the righteous women are obedient, guarding in the husbands absence what Allah orders them to guard.

Muhammad Asad — And the righteous women are the truly devout ones, who guard the intimacy which God has [ordained to be] guarded.

ইবন কাসিরের অনুবাদ — সুতরাং যে সমস্ত নারী পুণ্যবতী তারা আনুগত্য করে, আল্লাহর সংরক্ষিত প্রচ্ছন্ন বিষয় সংরক্ষণ করে;

কুতুবের অনুবাদ — অতএব সতী-সাধ্বী নারী হবে (একান্ত) অনুগত, (পুরুষদের) অনুপস্থিতিতে তারা (স্বয়ং) আল্লাহর তত্ত্বাবধানে (থেকে) নিজেদের (ইযযত-আবরু ও অন্যান্য) সব অদেখা কিছুর রক্ষণাবেক্ষণ করবে;

মউদুদির অনুবাদ — কাজেই সতী-সাধ্বী স্ত্রীরা আনুগত্যপরায়ণ হয় এবং পুরুষদের অনুপস্থিতিতে আল্লাহর হেফাজত ও তত্ত্বাবধানে তাদের অধিকার সংরক্ষণ করে থাকে।

শফির অনুবাদ — সেমতে নেককার স্ত্রীলোকেরা হয় অনুগতা এবং আল্লাহ যা হিফাযতযোগ্য করে দিয়েছেন লোকচক্ষুর অন্তরালেও তার হিফাযত করে।

১১.৬.২। কিন্তু ৪:৩৪ আয়াতে নারীর বেলায় ‘আনুগত্য’কে আমরা স্বামীর সাথে জুড়ে দিয়েছি এবং এমন একটি মানসিক অবস্থার সমার্থক করেছি যা থেকে নারী স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিনাবাক্যে স্বামীর ইচ্ছামতো চলবে। এই বাক্যে ‘স্বামী’ বা ‘পুরুষ’ শব্দ নেই। তবুও বেশিরভাগ অনুবাদক এই আনুগত্যকে স্বামীর আনুগত্যে পর্যবসিত করেছেন অনুমানের ভিত্তিতে। এটির উৎপত্তি হয়েছে তাদের প্রাথমিক এই ধারণাকে ‘শুদ্ধ’ সাব্যস্ত করা থেকে যে, পুরুষ মর্যাদায় নারী থেকে শ্রেষ্ঠ এবং পুরুষ নারীর কর্তা বা ব্যবস্থাপক।

১১.৬.৩। কিন্তু আমাদের কাছে থাকা অনুবাদগুলো পড়লে এই ধারণাই তৈরি হয় যে, আল্লাহ পুরুষকে নারীদের উপর কর্তৃত্বের আসনে নিয়োগ দিয়েছেন ও নারীদেরকে তার বিপরীতে স্বামীদের অনুগত থাকার আদেশ দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, ‘গায়িব’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে ‘স্বামীর অনুপস্থিতি’ বলে। এবং এর ভিত্তিতে স্বামীর অনুপস্থিতিতে কেবল যৌন পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা নয়, স্বামীর ধন-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পর্যন্ত নারীর কর্তব্যে পরিণত করা হয়েছে। এই আয়াত সংশ্লিষ্টে এটি খুবই অদ্ভুত কথা। ‘রিজাল’ বাক্য অনুসারে স্ত্রীর ভরণপোষণ এবং তার নিরাপত্তাবিধান স্বামীর কর্তব্যের অংশ। এমনকি স্ত্রীর জন্য রান্না করা খাবার, ঘরের পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদির ব্যবস্থা করাও ভরণপোষণের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত—যে কারণে স্ত্রী রান্না করা বা ঘর গোছানোর মতো গৃহস্থালি কাজগুলো করতেও বাধ্য নয়। এই বিধি মা, বোন বা কন্যার জন্যও প্রযোজ্য। আমাদের সমাজে যে নারীরা এসব কাজ করে থাকেন তারা দানমূলক কাজ করে থাকেন। তারা ইচ্ছা করলে পিতা, ভাই বা স্বামীর কাছ থেকে এজন্য অর্থ দাবী করতে পারেন। ইসলামের আইনবেত্তারা এতদূর বলেছেন যে, এমনকি সন্তানকে স্তন্যপান করানোর জন্যও স্ত্রী অর্থ দাবী করতে পারেন, যেহেতু সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্বও স্বামীর। কারো অনুপস্থিতিতে তার সম্পদ নষ্ট করা ইসলাম ধর্মের পরিপন্থী কাজ—তা সেটি নারীই করুক বা পুরুষই করুক; কিন্তু এই আয়াতের সাথে তার সম্পর্ক নেই—এই আয়াতের বিষয়বস্তু জীবনের আরও গুরুতর অধ্যায় নিয়ে।

১১.৭। প্রস্তাবিত অনুবাদ

“পুরুষরা নারীর সমর্থনে মজবুত ভাবে দাঁড়ায়, তাদেরকে আল্লাহ অন্যপক্ষের তুলনায় সুবিধা-সামর্থ্যে যে আধিক্য দিয়েছেন তা সহকারে এবং তাদের ব্যয়যোগ্য সম্পদ সহকারে। এর বিপরীতে, উন্নতি সাধনে সক্রিয় নারীরা কর্তব্যপরায়ণ হয় এবং আল্লাহ যা সংরক্ষণ করতে চান তারা তা গোপনেও সংরক্ষণ করে চলে।”

১১.৮। পুরুষের অগ্রভূমিকার নীতি

আগে লাহুন্না বাক্য নিয়ে আলোচনাকালে আমরা পুরুষের অগ্রভূমিকার কথা বলেছিলাম। এই আয়াতের বাক্য দুটির বিন্যাস ও বক্তব্যে সেই নীতির প্রয়োগ লক্ষণীয়। পুরুষের অবস্থান ও কর্তব্যকে প্রথমে শর্তহীনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ‘রিজাল’ অর্থাৎ ‘পুরুষেরা’ পদ ব্যবহার করা হয়েছে। এই শর্তপূরণের বিপরীতে ‘নিসা’ শব্দের বদলে ‘সালিহাত’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ নারীরা এই করবে—না বলে বলা হলো সংস্কারসাধক নারীদের এই করণীয়। অর্থাৎ, পুরুষরা তাদের কর্তব্য শর্তহীনভাবে পালন করবে এবং প্রথমে পালন করবে; এবং যদি সে তা না করে তবে নারীর কাছ থেকে প্রতিকর্তব্য প্রত্যাশা করার ভিত্তি সে হারায়। এই বাক্যে আল্লাহ নারীদের কর্তব্য নির্ধারণে তাদের প্রতি সহানুভূতির ভাষা ব্যবহার করেছেন ও তাদের অনুকূলে অবস্থান নিয়েছেন।

১১.৯। ‘বিমা’ শব্দের পুনরালোচনা

আমরা আগে দেখিয়েছি, কিভাবে রিজাল বাক্যে ব্যবহৃত ‘বিমা’ শব্দটিকে ‘যেহেতু’ দ্বারা অনুবাদ করা হয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় হলো এই একই আয়াতেও ‘বিমা’ শব্দটি সালিহাত বাক্যেও ব্যবহৃত হয়েছে। এখন দেখা যাক কোন অনুবাদক কোথায় কি অনুবাদ করেছে। রিজাল বাক্যে শব্দটি দুবার এসেছে, কিন্তু সালিহাত বাক্যে একবার। তবে যেহেতু অনুবাদকরা রিজালের বেলায় দুই স্থানেই একরকম শব্দ ব্যবহার করেছেন, তাই তাদের মধ্যে প্রথম ক্ষেত্রটি অনুসরণ করা হয়েছে।

রিজাল বাক্য

الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ ۚ

সালিহাত বাক্য

فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللَّهُ ۚ



আমরা উপরের ছক থেকে সাধারণ প্রবণতাটি লক্ষ করতে পারি। অধিকাংশই প্রথম ক্ষেত্রে ‘because’ ব্যবহার করেছেন। সহিহ ইন্টারন্যাশনাল উভয় ক্ষেত্রেই সমরূপ শব্দ ‘by what’/‘what’ ব্যবহার করলেও রিজাল বাক্যে বন্ধনীর ভেতর ‘right of’ শব্দ নিজ থেকে জুড়ে দিয়ে অর্থ ‘because’ এর চেয়েও ভয়াবহ করে তুলেছেন। মুহম্মদ আসাদ দুই ক্ষেত্রেই একরূপ শব্দ ব্যবহার করেছেন। এখানে লক্ষণীয় যে, সালিহাত বাক্যের পূর্বাপর শব্দ ‘বিমা’ শব্দটির জন্য ‘যেহেতু’ শব্দ ব্যবহারের কোন উপায়ই নেই।

১১.১০। বাক্য দুটির রেসিপ্রোসিটি

১১.১০.১। কোরানে নারী সম্বন্ধে যে কথা বলা হয়েছে, তার রেসিপ্রোকাল কথাও বৈধ হয়, প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতার বিষয়টি যুক্তিসঙ্গতভাবে বিবেচনায় রেখে। তাহলে এই আয়াতের রিজাল ও সালিহাত বাক্যের রেসিপ্রোকাল প্রকাশ কিরকম হতে পারে? আমরা এর চেষ্টা করে দেখতে পারি ও তা নীচে লিখলাম।

নারীরা পুরুষদের সমর্থনে মজবুতভাবে দাঁড়াবে, আল্লাহ তাদেরকে অন্য অংশের তুলনায় যে সামর্থ্যগত আধিক্য দিয়েছেন তা সহকারে এবং আল্লাহ যার সংরক্ষণ চান তার সংরক্ষণ সহকারে। এমতাবস্থায়, সংস্কারসাধক পুরুষরা কর্তব্যপরায়ণ হয়, এবং নারীদের ভরণপোষণ ও নিরাপত্তাবিধানে যত্নবান হয়।

১১.১০.২। এখানে নারীর সামর্থ্যগত আধিক্য হচ্ছে তার গর্ভধারণে সক্ষমতা, যে ক্ষেত্রে পুরুষ অক্ষম হয়ে আছে এবং সংরক্ষণের বিষয়টি হচ্ছে গর্ভ। কিন্তু শোষণবাদী বা আধিপত্যবাদী নীতি নির্ধারকরা বা আইন প্রণেতারা সাধারণত এই এপ্রোচটি – অর্থাৎ বঞ্চিত বা অত্যাচারিতদের কর্তব্য ও প্রতিপক্ষের অধিকার প্রথমে সাব্যস্ত করে দেয়ার নীতি – নিয়ে থাকে। যে সম্পর্কের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে অবিচার রয়ে গেছে বা যেখানে বাস্তবে এরূপ অবিচার বিদ্যমান, সেখানে এরূপভাবে নীতি প্রকাশ করা হলে তা শক্তিমানের পক্ষে যায় এবং তাদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। অত্যাচার করার জন্য শক্তির প্রয়োজন হয়। আর শক্তিমানের উপর তাই অগ্রভূমিকা বাধ্যতামূলক। শক্তিমানেরা আমাদের কাছে দুর্বল বলে বিবেচিত—ওমরের এরূপ নীতির পেছনে কাজ করেছে কোরানের এই নীতি; অর্থাৎ কোন বিরোধে শক্তিমান পক্ষকেই আগে কৈফিয়ত দিতে হবে, নিজেকে সংশোধন করতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন