Do to others what you would have them do to you, for this sums up the Law and the Prophets. (Gospel according to Matthew 7:12)
Stand out firmly with justice as witnesses for God, even if it be against yourselves or parents and relatives, be he rich or poor. (Koran 4:135)

শুক্রবার, ২ মে, ২০১৪

নারীর কোরান – ১০ (ফাদ্দালা)

১০.১। নিঈমা, ফাদল এবং দারাজাত

১০.১.১। আমরা বাংলা ভাষায় নেয়ামত, ফজিলত ও দারাজাত শব্দ তিনটি ব্যবহার করে থাকি। এগুলি আরবি থেকেই এসেছে। ‘নিঈমা’ বলতে বুঝায় এমন সব অবলম্বন ও বিষয় যা অস্তিত্বের জন্য সহায়ক, স্বাচ্ছন্দপূর্ণ, সুখকর এবং জীবনকে বিকশিত ও সফল করতে সহায়ক। যেমন, আলো, বাতাস, খাবার, সম্পদ, জ্ঞান, পথনির্দেশনা—এই সবই নিঈমা। আবার, মানব জীবনের মর্যাদা, মহিমা, মূল্য ইত্যাদিও আল্লাহর নিঈমা। ‘ফাদল’ বলতে বুঝায় সকল সামর্থ্য, ক্ষমতা, শক্তি ও তাদের উৎস, যা অবলম্বন করে জীবনকে সংরক্ষণ করা যায়, জীবন ও সমাজকে এগিয়ে নেয়া যায়। একই বিষয়কে নিঈমা হিসেবে গণ্য করা যায়, আবার তাকে ফাদল হিসেবেও দেখা যেতে পারে। যেমন, জ্ঞান একটি নিঈমা এবং একটি ফাদল—বিষয়টি জ্ঞানকে দেখার ও ব্যবহার করার কোণ থেকে বিচার্য। সত্তার বিকাশের উচ্চতা-নির্দেশক হিসেবে জ্ঞান নিঈমা, আবার কাজের সামর্থ্য হিসেবে তা ফাদল। নিঈমা প্রধানত ব্যক্তির নিজের অবস্থা ও স্বাচ্ছন্দের সাথে সম্পর্কিত এবং ফাদল প্রধানত ব্যক্তির দায়িত্ব, কর্তব্য ও কর্মের সাথে সম্পর্কিত, যা নিজের ও অন্যের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে।

১০.১.২। ফাদল শব্দের যে অর্থ উপরের অনুচ্ছেদে দেয়া হয়েছে তা পার্থিব জীবনের সামগ্রী ও সামর্থ্যের সাথে সম্পর্কিত। তবে জীবনের সফলতা ও সার্থকতা অর্জনের সাথে যে মহিমা, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কিত, তাও ফাদল শব্দের অর্থের মধ্যে নিহিত। যে জীবনবীক্ষায় এই মর্যাদা পার্থিব জীবনের সামগ্রী ও সামর্থ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, সে জীবনদর্শনে ফাদল এইসব সামগ্রী ও সামর্থ্য ভিত্তিক মর্যাদা বা শ্রেষ্ঠত্বের সমার্থক। আর যে জীবনবীক্ষায় জীবনের সাফল্য কর্তব্যপরায়ণতা ও নৈতিক সংগ্রামে চূড়ান্ত বিচারে সাফল্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, সে দর্শনে পার্থিব ফাদল কর্তব্যভারের উৎস এবং জীবনের সফলতা হিসেবে আল্লাহর বিচারে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব ফল হিসেবে অর্জিতব্য। কাজেই ফাদল শব্দের তাৎপর্যে ব্যাপকতা রয়েছে, কোরানের কোন বাক্যে এই শব্দের উদ্দিষ্ট তাৎপর্য বাক্যের কন্টেক্সট থেকে নির্ধারিতব্য—যা সামর্থ্যগত বা অর্জনগত আধিক্য থেকে মর্যাদা পর্যন্ত হতে পারে।

১০.১.৩। দারাজাত শব্দটি নিয়ে আগে আমরা আলোচনা করেছিলাম এবং দেখেছিলাম যে, এর সাথে ক্রম ও মাত্রা ভিত্তিক অগ্রসরমানতার অভিধা যুক্ত আছে। একটি ক্রমবিকাশমান সত্তা নানা স্তর পেরিয়ে বিকশিত হতে থাকলে আমরা বলতে পারি যে, সেটির দারাজাত বৃদ্ধি পাচ্ছে বা দারাজাতের পর দারাজাত অতিক্রম করে সেটি অগ্রসর হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়: নিউটনের মেধা বা অর্জন তাঁকে প্রদত্ত ফাদল। আবার আইনস্টাইনকেও অনুরূপ ফাদল দেয়া হলেও তিনি নিউটনকে ছাড়িয়ে অগ্রসর হয়েছেন বিধায় নিউটনের তুলনায় আইনস্টাইন দারাজাতেও অগ্রসর।

“Those messengers - some of them We caused to exceed [ফাদ্দালনা] others. Among them were those to whom Allah spoke, and He raised some of them in degree [দারাজাত]. And We gave Jesus, the Son of Mary, clear proofs, and We supported him with the Holy Spirit.” (কোরান ২:২৫৩)

১০.১.৩। উপরের আয়াতে নবীদের বেলায় ‘ফাদ্দালনা’ ও ‘দারাজাত’ শব্দ দুটি ব্যবহৃত হয়েছে। এই আয়াতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান যে, নবীদের মধ্যে সামর্থ্য, বৈশিষ্ট্য, অর্জন, অবদানে পার্থক্য রয়েছে এবং মানুষের চিন্তা ও ধর্মকে সম্প্রসারিত করার ক্ষেত্রে তারা একে অপরের চেয়ে বেশী অগ্রসর হয়েছেন। কিন্তু এই পার্থক্য সত্ত্বেও আমরা মুসলিমরা নবীদের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না—আমরা তাদের মর্যাদায় পার্থক্য করি না, তাদেরকে একটি ভ্রাতৃমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে দেখি এবং তাদের দ্বারা উপস্থাপিত ধর্মকে একটি ক্রমবিকাশমান সমগ্র হিসেবে দেখি। কোরানের ২:২৮৫ আয়াতে থেকে বিষয়টি অনুধাবন করা যায়।

“The Messenger has believed in what was revealed to him from his Lord, and so have the believers. All of them have believed in Allah and His angels and His books and His messengers, saying, “We make no distinction between any of His messengers.” (কোরান ২:২৮৫)

১০.২। কোরানে ফাদল ও ফাদ্দালা এর ব্যবহার

১০.২.১। ফাদল ও ফাদ্দালা কোরানে এসেছে অনেক স্থানে। এর অর্থ সাধারণত করা হয় যথাক্রমে ‘grace’, ‘bounty’, ‘favour’ এবং ‘to bestow’, ‘to prefer’, ‘to exceed’, ‘to favour’ শব্দ দিয়ে। আমরা ইতোপূর্বে যা বলেছি তা থেকে অনুমেয় যে, ফাদল আল্লাহর নিকট থেকে প্রাপ্ত দান, অনুগ্রহ, সামর্থ্য বা অর্জনগত অগ্রসরতা। আল্লাহর নির্বাচন বা নিয়মজাত ফল হিসেবে এগুলো ‘grace’, ‘favour’, ‘preference’ ইত্যাদি। নীচে কোরানের কিছু আয়াতের রেফারেন্স দেয়া হলো যেখানে ‘ফাদল’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।

to bestow, to prefer, to faviour অর্থে — ২:৪৭, ২:১২২, ২:২৫৩, ৪:৩২, ৪:৩৪, ৪:৯৫, ৬:৮৬, ৭:১৪০, ১৩:৪, ১৬:৭১, ১৭:২১, ১৭:৫৫, ১৭:৭০, ২৭:১৫, ৪৫:১৬।

to assert superiority অর্থে — ২৩:২৪

grace, bounty, faviour অর্থে — ২:৬৪, ২:৯০, ২:১০৫, ২:১৯৮, ২:২৩৭, ২:২৪৩, ২:২৫১, ২:২৬৮, ৩:৭৩, ৩:৭৪, ৩:১৫২, ৩:১৭০, ৩:১৭১, ৩:১৭৪, ৩:১৮০, ৪:৩২, ৪:৩৭, ৪:৫৪, ৪:৭০, ৪:৭৩, ৪:৮৩, ৪:১১৩, ৪:৪৭৩, ৪:১৭৫, ৫:২, ৫:৫৪, ৭:৩৯, ৮:২৯, ৯:২৮, ৯:৫৯, ৯:৭৪, ৯:৭৫, ৯:৭৬, ১০:৫৮, ১০:৬০, ১০:১০৭, ১১:৩, ১১:২৭, ১২:৩৮, ১৬:১৪, ১৭:১২, ১৭:৬৬, ১৭:৮৭, ২৪:১০, ২৪:১৪, ২৪:২০, ২৪:২১, ২৪:২২, ২৪:৩২, ২৪:৩৩, ২৪:৩৮, ২৭:১৬, ২৭:৪০, ২৭:৭৩, ২৮:৭৩, ৩০:২৩, ৩০:৪৫, ৩০:৪৬, ৩৩:৪৭, ৩৪:১০, ৩৫:১২, ৩৫:৩০, ৩৫:৩২, ৩৫:৩৫, ৪০:৬১, ৪২:২২, ৪২:২৬, ৪৪:৫৭, ৪৫:১২, ৪৮:২৯, ৪৯:৮, ৫৭:২১, ৫৭:২৯, ৫৯:৮, ৬২:৪, ৬২:১০, ৭৩:২০।

exellence, preference অর্থে — ১৭:২১, ১৭:৭০।

১০.৩। ফাদাল-এ মাত্রাভেদ প্রাকৃতিক

১০.৩.১। প্রকৃতিতে সামর্থ্য ও অগ্রগতি বণ্টনে পার্থক্য রয়েছে। মানুষের সমাজে এই পার্থক্য আবার বেড়ে যায় যদি সমাজটি বর্ণ, পেশা, সম্পদ, শ্রেণী, লিঙ্গ ইত্যাদির ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে একে অপরকে শোষণ করতে শুরু করে। এই ফারাক কতটুকু প্রাকৃতিক ও কতটুকু মানুষের নৈতিক পতনের ফল তা আলাদা করে নির্ণয় করা খুবই কঠিন। তবে বাস্তবতা হলো এই যে, এই ফারাক এখনও বিদ্যমান। আমাদের নৈতিক জীবনকে—অশুভের দিকে মানুষের পতন ও শুভের দিকে উত্থানের জন্য মানুষের সংগ্রাম উভয়কেই—প্রাকৃতিক হিসেবে গণ্য করা যায় এবং সম্পূর্ণ প্রপঞ্চটিই আল্লাহর সৃষ্টি। এই স্তর থেকে আমরা বলতে পারি যে, ফাদল ও দারাজাতে ফারাক আল্লাহর নির্বাচন ও আল্লাহর নিয়ম থেকে জাত। প্রকৃতিতে সর্বত্রই এই পার্থক্য আমরা দেখতে পাই। আর মানুষের বেলায় ফাদল নৈতিক কর্মের অবলম্বন, যে কর্মশীলতা তাকে চূড়ান্ত বিচারে সফল বা ব্যর্থ করতে পারে।

“And within the land are neighboring plots and gardens of grapevines and crops and palm trees, growing several from a root or otherwise, watered with one water; but We make some of them exceed [নুফাদ্দিলু] others in quality of fruit. Indeed in that are signs for a people who reason.” (কোরান ১৩:৪)

“Look how We have favored in provision [ফাদ্দালনা] some of them over others. But the Hereafter is greater in degrees of difference [দারাজাত] and greater in distinction [তাফদিলান].” (কোরান ১৭:২১)

১০.৩.২। কোরানের বেশ কিছু আয়াতে ফাদল-এ পার্থক্যের উল্লেখ রয়েছে। “কতককে কতকের উপর ‘ফাদল’ দেয়া”— একটি ঐশী তথা প্রাকৃতিক নীতি হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে। ভোগবাদী আত্মকেন্দ্রিক চিন্তার মানুষেরা এই ফারাককে ও নিজেদের সুবিধাজনক অবস্থাকে তাদের অহংকার, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্বে ও কর্তৃত্বের ভিত্তি হিসেবে দেখেছে এবং ‘ফাদল’কে এগুলোর সমার্থক করেছে। অন্যদিকে একই অবস্থাকে আল্লাহ কোরানে মানুষের নৈতিকতার ভিত ও নৈতিক সংগ্রামের ক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কোন দায়িত্ব কারও উপর আরোপ করার সময়, সেই দায়িত্ব পালনে সহায়ক ফাদলের অধিকারী হওয়াকে আল্লাহ দায়িত্ব আরোপের যুক্তি বা অবলম্বন হিসেবে উল্লেখ করেন।

১০.৪। ফাদল-এ মাত্রাভেদ মর্যাদা বা শ্রেষ্ঠত্ব বা কর্তৃত্বের সূচক হিসেবে দেখে ভ্রষ্টরা

১০.৪.১। নিঈমা, ফাদল ও দারাজাতের ভিত্তিতে মানুষ অহংকার ও আভিজাত্যের ভিত তৈরি করতে পারে। এই ক্ষেত্রে অহংকারী অভিজাতেরা আয়তনে ক্ষুদ্র হয়েও শক্তিতে বেশী হবার কারণে সমাজ ব্যবস্থাকে নিজেদের অনুকূলে গড়ে তুলতে থাকে। প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা আবার তাদের শক্তি বাড়াতেও থাকে। এরূপ সমাজে শক্তিমানের সামর্থ্যই মর্যাদার মাপকাঠি হয়ে উঠে এবং দুর্বল করে রাখা বঞ্চিতদেরকে এইরূপ মূল্যমান ও ব্যবস্থা বান্ধব শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষিত করে তোলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়: জমির মালিকানা, ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও সম্পদের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে জমিদার নিজেকে উচ্চ মর্যাদার আসনে স্থাপন করে। কিন্তু শস্য উৎপাদনে কৃষকদের ক্ষমতা, সামর্থ্য ও প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকলেও এবং তাদের উৎপন্ন শস্য খেয়ে জমিদার বেঁচে থাকলেও, কৃষকের সব সামর্থ্যকে মর্যাদাপূর্ণ কিছু নয় বলে উভয় পক্ষ কর্তৃকই পরিগণিত হয়।

১০.৪.২। কোরান অনুযায়ী নেয়ামত অহংকার, আভিজাত্য, সম্মান, শ্রেষ্ঠত্ব বা কর্তৃত্বের কোন গ্রহণযোগ্য বা বৈধ ভিত নয়। কোরানের ৮৯:১১-১২ আয়াতে আল্লাহ সীমালঙ্ঘণকারী, দুর্নীতিপরায়ণ, অত্যাচারী, বৈষম্যবাদী ও শোষণবাদী সমাজের অধিপতিদের নিন্দা করেছেন এবং তারপর সেই সুরার ১৫-২০ আয়াতে তাদের মূল্যবোধ ও কর্মকাণ্ডের চিত্র এঁকেছেন।

All of whom oppressed within the lands and multiplied iniquity therein. (কোরান ৮৯:১১-১২)

And as for man, when his Lord tries him and is generous to him and favors him, he says, “My Lord has honored me.” But when He tries him and restricts his provision, he says, “My Lord has humiliated me.” No! But you do not honor the orphan And you do not encourage one another to feed the poor. And you consume inheritance, devouring it altogether, And you love wealth with immense love. (কোরান ৮৯:১৫-২০)

১০.৪.৩। উপরের আয়াতে আমরা দেখছি যে, অহংকারী মানুষেরা শোষণ, দুর্নীতি, দমন ইত্যাদির মাধ্যমে বৈষম্যকে ক্রমাগত বাড়াতে থাকে এবং নিজেদের সামাজিক মর্যাদা ও অবস্থানের ভিত্তি হিসেবে ক্ষমতা ও বিত্তের আধিক্যকে গ্রহণ করে। এরা নেয়ামত, ফজল ও দারাজাত পেলে নিজেদেরকে সম্মানিত মনে করে এবং তারা সমাজের অপরাপর মানুষের কাছ থেকেও সম্মান পায়। এই সম্মানকে সে “আল্লাহ আমাকে সম্মানিত করেছেন” বলে প্রকাশ করে। সে এই সব বিষয়কে কর্তব্য পালনের সুযোগ, সামর্থ্য বা বাধ্যতা হিসেবে দেখে না। তারা বঞ্চিতদেরকে সম্মান করে না, দুর্বল করে রাখা অংশকে সমপর্যায়ে তুলে আনতে চায় না, তারা সাধারণ মানুষকে অসহায় করে রাখে ও তাদের প্রাপ্য অংশ আত্মসাৎ করতে থাকে, তাদেরকে প্রতারিত করে ও শোষণ করে।

১০.৪.৪। কোরানের ২৩:২৪ আয়াতে নবীদের বিরোধীদের মনোভাব ও মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়েছে।

But the eminent among those who disbelieved from his people said, “This is not but a man like yourselves who wishes to take precedence [ইয়াতাফাদ্দালা] over you; and if Allah had willed, He would have sent down angels. We have not heard of this among our forefathers.” (কোরান ২৩:২৪)

১০.৪.৫। এই আয়াতে ‘ইয়াতাফাদ্দালা’ শব্দটি ব্যবহার করছে নবীর বিরোধীরা। তারা বলতে চাচ্ছে যে, নবীর সংগ্রামের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের উপর ‘ফাদল’ অর্জন করা। একথা দিয়ে তারা কী বুঝতে চাচ্ছে? আমরা জানি নবীরা সকল ব্যক্তিমানুষকে অন্যের অধীনতা ও শোষণমূলক শ্রমদাসত্ব থেকে মুক্ত করতে চান, সকল মানুষের সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে চান। আর একারণেই কর্তৃত্ববাদী অভিজাতেরা নবীকে রুদ্ধ করতে নেমেছিল। তারা তাদের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যমান দ্বারা, তাদের কাজের লক্ষ্য দ্বারা নবীর কাজের বিচার করেছিল। ফলে তাদের কাছে ‘ফাদল’ আধিপত্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্বের সমার্থক হিসেবে পরিগণিত ছিল।

১০.৫। ফাদল-এ মাত্রাভেদ পরীক্ষা

১০.৫.১। আল্লাহর দৃষ্টিতে বা বিচারে জগতে ফাদলের অধিকারী হওয়ার সাথে সম্পর্ক হচ্ছে কর্তব্যের, দায়িত্বের ও কর্মের—মর্যাদাগত শ্রেষ্ঠত্বের বা কর্তৃত্বের নয়। নিঈমা, ফাদল ও দারাজাতে আধিক্য একজনকে অধিক কর্তব্যের মধ্যে নিপতিত করে, কর্তব্য পালনে অগ্রণী ভূমিকা বাধ্যতামূলক করে। এরূপ ফারাক আছে বলেই আমাদের জীবনে নৈতিক মূল্যমান ও নৈতিকতার অস্তিত্ব রয়েছে, নয়তো নৈতিক জীবন অর্থহীন হয়ে উঠতো। মানুষের জন্য আল্লাহর দৃষ্টিতে সম্মানই হচ্ছে প্রকৃত সম্মান ও চূড়ান্ত সম্মান। এই সম্মান অর্জিত হতে পারে এই নিঈমা, ফাদল ও দারাজাত সম্পর্কিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সফল হওয়ার মাধ্যমে। তাই নবীদের বিচারে ‘ফাদল’ কর্তব্যভারের সমার্থক—শ্রেষ্ঠত্ব বা কর্তৃত্বের নয়।

And We did certainly give the Children of Israel the Scripture and judgement and prophethood, and We provided them with good things and preferred them over the worlds. (কোরান ৪৫:১৬)

O Children of Israel, remember My favor that I have bestowed upon you and that I preferred you over the worlds. (কোরান ২:৪৭) (কোরান ২:১২২)

১০.৫.২। নবী ও নবীদের মাধ্যমে পাওয়া পথনির্দেশনা, প্রজ্ঞা, জ্ঞান ইত্যাদি আল্লাহর নেয়ামত যা অবলম্বন করে একটি সম্প্রদায় নিজেদেরকে বিকশিত করতে পারে। এসবই আল্লাহর ফজল যা দিয়ে তারা মানবজাতিকে, বিশ্বকে লালন করতে পারে এবং পারে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে। কিন্তু ইসরাইলিরা যখন কর্তব্যকে পিছনে ফেলে এই নেয়ামত ও ফজলকে জেন্টাইলদের সামনে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের ভিত হিসেবে দেখল এবং এই দাবী করে বসলো যে তারাই আল্লাহর নির্বাচিত জাতি, তখন তারা আল্লাহর কথার উপর ভ্রান্ত অর্থ আরোপ করলো। আল্লাহ তাদেরকে তাঁর ‘ফাদল’-এর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, অর্থাৎ তাদের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করতে চাচ্ছেন।

১০.৬। ফাদল-এ মাত্রাভেদ কর্তব্যভারের সূচক

১০.৬.১। আগের ১০.৪.২ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত ৮৯:১৫ আয়াতে বলা হয়েছে যে, ‘ফাদল’ আল্লাহর পরীক্ষা। জগতে নেয়ামত, ফজল ও দারাজাতে পার্থক্য পরীক্ষার বিষয় বা ক্ষেত্র—অর্থাৎ কর্তব্যভার ও দায়িত্বভার এসবের সমানুপাতে হয়। আখেরাতের নেয়ামত, ফজল ও দারাজাত এই পরীক্ষায় সাফল্যের মাত্রা অনুসারে হবে, মানুষের কর্মের ফল হিসেবে। যে পৃথিবীতে প্রাপ্ত নেয়ামত ইত্যাদিকে অহংকার, ভোগ-বিলাস, মর্যাদার ভিত ও মাপকাঠি হিসেবে দেখবে, পরার্থপরতার বদলে সঞ্চয়কামী হবে, বৈষম্যবাদী হবে, সে পরীক্ষায় ব্যর্থ হবে। ১৭:২১ আয়াতে (১০.৩.১ অনুচ্ছেদ) একথাই বলা হয়েছে।

১০.৭। নারী-পুরুষে ফাদল-এ পার্থক্য

১০.৭.১। এবার দেখা যাক কোরানের ৪:৩৪ আয়াতে নারী-পুরুষের মধ্যে ফাদলে পার্থক্যের মর্ম কী? আয়তটিতে বলা হয়েছে, “ফাদ্দালাল্লাহু বায়্‌দাহুম আলা বায়্‌দিন”—যার অর্থ “আল্লাহ এককে অপরের তুলনায় ‘ফাদল’ দিয়েছেন”।

Sahih International — Allah has given one over the other...

Pickthall — Allah hath made the one of them to excel the other...

Yusuf Ali — Allah has given the one more (strength) than the other...

Shakir — Allah has made some of them to excel others...

Muhammad Sarwar — the greater preference that God has given to some of them...

Mohsin Khan — Allah has made one of them to excel the other...

Arberry — God has preferred in bounty one of them over another...

Sher Ali — God has made some of them excel others...

Daryabandi — Allah hath made one of them excel over anot her...

Muhammad Asad — the bounties which God has bestowed more abundantly on the former than on the latter...

Shehnaz — Allah has bestowed some of them over others...

১০.৭.২। আমরা দেখছি যে, ইংরেজিতে ‘ফাদ্দালা’ ক্রিয়া পদটির অনুবাদে যে শব্দগুলো সাধারণত ব্যবহৃত হয় সেগুলো হচ্ছে: ‘to give’, ‘to make excel’, ‘to give greater preference’, ‘to prefer in bounty’, ‘to bestow bounties more sbundantly’ ইত্যাদি। এখানে নারীর প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তাবিধান, ভরণপোষণ, অবস্থার উন্নতিবিধান ইত্যাদি সকল কাজে পুরুষের যে সামর্থ্যগত আধিক্য রয়েছে তার কথাই বলা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে নারীর চেয়ে পুরুষের সুবিধা, সামর্থ্য, শক্তি, সক্ষমতায় আধিক্য রয়েছে বলেই পুরুষ নারীর উপর প্রাধান্য বজায় রেখেছে ও নারীর উপর অবিচার করে চলেছে।

১০.৭.৩। কিন্তু এই আধিক্য পুরুষের কর্তব্য ঠিক করে দেয়, তাকে নারীর উপর কোন কর্তৃত্বাধিকার বা শ্রেষ্ঠত্ব বা মর্যাদা দেয় না। নারীরও রয়েছে গর্ভধারণের সক্ষমতা, যা পুরুষের নেই। নারীর এই সামর্থ্যগত আধিক্যও, একইভাবে, নারীর কর্তব্য ঠিক করে দেয়, শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তি দেয় না। যদি বৈষম্যকামী প্রচলিত মূল্যমানের উপর ভিত্তি করে ‘ফাদল’ বা সক্ষমতাকে শ্রেষ্ঠত্ব, মর্যাদা বা কর্তৃত্বের অধিকার বিবেচনা করা হয় তবে পুরুষের চেয়ে নারীর মর্যাদা বেশী বলে দাবী করাও সম্ভব। কারণ পুরুষের সক্ষমতা নিছক শ্রমিকের সক্ষমতার ন্যায়, কিন্তু গর্ভের অধিকারী নারীর সক্ষমতা সৃজনধর্মী।

১০.৭.৪। কিন্তু শক্তি ও ক্ষমতাকে ভিত্তি করে পুরুষ যে পুরুষতান্ত্রিক মূল্যমান প্রতিষ্ঠিত করেছে তার প্রভাবে এই আয়াতের ভ্রান্ত অর্থ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে, যা ‘ফাদল’ সংক্রান্ত কোরানের দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত, নবীর জীবনাদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। এই বিপরীত তাৎপর্য ভ্রষ্টদের নীতির অনুরূপ। কোন কোন ইংরেজি অনুবাদের সাথে সাথে বাংলা অনুবাদগুলোতে এরূপ প্রবণতা স্পষ্টই বিদ্যমান।

ইবন কাসিরের অনুবাদ — আল্লাহ তাদের মধ্যে একের উপর অপরকে গৌরবান্বিত করেছেন...

মউদুদির অনুবাদ — আল্লাহ তাদের একজনকে অন্যজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন...

কুতুবের অনুবাদ — কারণ আল্লাহ তায়ালা এদের একজনকে আরেকজনের উপর (কিছু বিশেষ) মর্যাদা প্রদান করেছেন...

ইসলামিক ফাউন্ডেশন — আল্লাহ তাদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়াছেন...

মুহম্মদ শফির অনুবাদ — আল্লাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন...

উপরের অনুবাদগুলোর মধ্যে শফি’র অনুবাদে ‘বৈশিষ্ট্য’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যা সামর্থ্যগত আধিক্য। কিন্তু অন্যেরা ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ এবং একজন রীতিমতো ‘গৌরবান্বিত’ শব্দটি পর্যন্ত ব্যবহার করে বসেছেন। কোরান ও এর তফসিরের বাংলা অনুবাদসমূহে ‘ফাদল’ ও ‘দারাজাত’ শব্দদুটির উভয়ের ক্ষেত্রেই এই ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ শব্দটির ঢালাও ব্যবহারের প্রবণতা অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে লক্ষণীয়।

১০.৭.৫। বর্তমান আয়াতে নারীর প্রতি পুরুষের কর্তব্য নিয়ে আলোচনা হয়েছে, পুরুষের কর্তৃত্বের বা শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দেয়া হচ্ছে না। কাজেই এখানে ফাদল দ্বারা পুরুষের কর্তব্য সংক্রান্ত সামর্থ্যগত আধিক্যকে বুঝানো হচ্ছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন