Do to others what you would have them do to you, for this sums up the Law and the Prophets. (Gospel according to Matthew 7:12)
Stand out firmly with justice as witnesses for God, even if it be against yourselves or parents and relatives, be he rich or poor. (Koran 4:135)

রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৩

নবীদের তিনটি কাজ—গ্রন্থ, প্রজ্ঞা ও পরিশুদ্ধি

নবীদের প্রধান কাজ কি? অনুসারীদের প্রতি নবীদের কাজ প্রধানত তিনটি: কিতাব শিক্ষা দেয়া, প্রজ্ঞা সঞ্চার করা এবং পরিশুদ্ধ করা। নবীরা তাদের অনুসারীদেরকে কিতাব শিক্ষা দেন, তাদের মধ্যে প্রজ্ঞার উন্মেষ ঘটাতে চান এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করতে চান। কোরানের ২:১২৯ আয়াতে বর্ণীত হয়েছে আল্লাহর নিকট ইব্রাহিমের প্রার্থনা, যেখানে বলা হয়েছে, “হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের মধ্যে তাদের মধ্য থেকে উত্থিত করুন এক বাণীবাহককে যিনি তাদের নিকট আবৃত্তি করবেন আপনার আয়াতসমূহ, তাদেরকে শিক্ষা দেবেন গ্রন্থ ও প্রজ্ঞা, এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন। নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমতাবান ও প্রজ্ঞাবান।”

কোরানের ২:১৫১ আয়াতে আল্লাহ আরও বলেন, “অনুরূপভাবে আমরা প্রেরণ করেছি তোমাদের মাঝে তোমাদের মধ্য থেকে একজন বাণীবাহককে, যিনি তোমাদের নিকট আবৃত্তি করেন আমাদের আয়াতসমূহ, তোমাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন, তোমাদেরকে শিক্ষা দেন গ্রন্থ ও প্রজ্ঞা, এবং তোমাদেরকে শিক্ষা দেন যা তোমরা জানতে না।” অধিকন্তু, কোরানের ৩:১৬৪ আয়াতে আল্লাহ আরও বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বাসীদের উপর আনুকূল্য করেছেন তাদের মধ্যে তাদের মধ্য থেকে একজন বাণীবাহক উত্থিত করে যিনি তাঁর আয়াতসমূহ তাদের নিকট আবৃত্তি করেন, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন, এবং তাদেরকে শিক্ষা দেন গ্রন্থ ও প্রজ্ঞা, যদিও তারা নিপতিত ছিল প্রকাশিত বিভ্রান্তির মধ্যে।”

১। গ্রন্থ বা কিতাব

কিতাব বা গ্রন্থ বলতে বুঝায় জীবন সম্পর্কীয় নীতিমালার বা কোডসমূহের ভাষাগত রূপকে। যেমন কোরান, বাইবেল, গীতা, ত্রিপিটক ইত্যাদি। একজন ব্যক্তির জীবনে কিতাব তার জীবনকে গড়ে তোলার প্রাথমিক ভিত্তি। কিতাবের মাধ্যমেই একজন মুসলিম, হিন্দু, খৃস্টান বা বৌদ্ধের কিরূপ হওয়া তার দায়িত্ব বা কর্তব্য তা অন্যজনও বুঝতে পারে। এদের কেউ যদি অন্যের উপর অত্যাচার করে তবে আমি দুটো কাজ করতে পারি। এক. অত্যাচারীকে বলতে পারি তুমি তোমার ক্ষতি করছ, তোমার জীবনের কোড তুমি লঙ্ঘন করছ; দুই. অত্যাচারিতকে বলতে পারি তুমি নিজেকে রক্ষা কর।

কিন্তু যার জীবনে এরূপ কোন গ্রন্থ নেই তাকে আমি বুঝতে পারি না। সে যদি অত্যাচার করে তবে আমি তাকে কিছুই বলতে পারি না। কারণ সে অত্যাচারকে নিজের জন্য আদতে ক্ষতিকর মনে করে, না-কি লাভজনক মনে করে আমি তা জানতে পারি না। আর যদি তাদের কেউ ‘অত্যাচার ক্ষতিকর হবে কেন?’ এই প্রশ্ন করে বসে তবে তো একেবারেই লাজওয়াব হয়ে যাই। আমার পক্ষে তখন কেবল একটি কাজ করাই সম্ভবপর থাকে—আর তা হলো অত্যাচারিতকে আত্মরক্ষা করতে বলা। কিতাব জীবনদর্শন ও জীবনাদর্শের উৎস, আচরণ ও কর্মের মূল সূত্রাবলীর আকর। যার কিতাব যত উন্নত তার পক্ষে তত উন্নত জীবনের অধিকারী হওয়া সম্ভব।

২। প্রজ্ঞা বা দার্শনিকতা

কিন্তু একটি কিতাব কিছু নীতি বা ওসুলের কথা বলে, সে নীতিগুলো কেন বৈধ বা কেন অপরিহার্য তার যুক্তি বা ব্যাখ্যা প্রদান করে। কিন্তু আমাদের বাস্তব জীবন বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতি, অবস্থা, সম্পর্ক ও মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। সাধারণ নীতি কিভাবে বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষাপটে সুচারুরূপে প্রযুক্ত হতে পারে তা সেই নীতির ধারকের জ্ঞান, অন্তর্দৃষ্টি, চিন্তা, বিবেচনা, সচেতনতা, সতর্কতা, মূল্যায়নের উপর নির্ভর করে। এখানে প্রয়োজন হয়ে পরে প্রজ্ঞার। প্রজ্ঞার অধিকারী হতে না পারলে কিতাব রূপায়ন করা যায় না। এতে কিতাবের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়।

প্রজ্ঞা ও জ্ঞান সমার্থক নয়। কোরানের বেশ কয়েক স্থানে আল্লাহর গুণ হিসেবে আলাদা করে কিন্তু যুগলভাবে আলিম (জ্ঞানী) ও হাকিম (প্রাজ্ঞ) এর উল্লেখ আমরা দেখতে পাই। আমরা কিতাব থেকে জ্ঞান পেতে পারি, কিন্তু প্রজ্ঞা তখনই অর্জিত হতে পারে যদি বাস্তব অবস্থার অভ্যন্তরকে দেখার, নানা অংশের সম্পর্ককে উপলব্ধি করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারি এবং সেই সাথে যথার্থ মনোভাব ও বিচারিক ক্ষমতার অধিকারী হতে পারি। প্রজ্ঞাকে আমরা তাই বলতে পারি দার্শনিকতা। কিতাবের আক্ষরিক অর্থ অবলম্বন, পূর্ব-পুরুষদের অন্ধ অনুকরণ, স্বাধীন বুদ্ধির চর্চাকে রোধ করার মাধ্যমে আমরা প্রজ্ঞার উন্মেষ ও বিকাশকে রুদ্ধ করে ফেলতে পারি। এতে কিতাব অকার্যকর হয়ে ওঠে, এমনকি কিতাব পথভ্রষ্টতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

৩। পরিশুদ্ধি

অন্যদিকে, আমাদের নৈতিক জীবনের সাথে আত্মশুদ্ধি, চিত্তশুদ্ধি বা মনের পরিশুদ্ধি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটি একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া। আমাদের জীবন যদি পদার্থের বা উদ্ভিদের বা প্রাণীর জীবনের মতো পজিটিভ হতো তবে আমাদের জন্য নৈতিকতা বলে কিছু থাকতো না। মানুষের জীবনে মন্দের, অশুভের অস্তিত্ব আছে বলেই এটা না করে ওটা নির্বাচন করা দরকার হয়। যে মন্দটা ছেড়ে ভালটা নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয় তাকেই আমরা অনৈতিক বলি। সকল অনৈতিকতার উৎস মনের কলুষ। আর একারণে পরিশুদ্ধির সাধনা অপরিহার্য হয়। যদি কেউ বলে যে, সে মনের কলুষিত প্রবণতা থেকে মুক্ত তবে সে অতিমানব, সে নৈতিকতার ঊর্ধ্বে—সে যা করবে তা-ই নৈতিক বিচারে ভাল, সে অনৈতিক কাজের সম্ভাবনারহিত, অথবা নৈতিকতার ধারণা তার বেলায় প্রযোজ্য নয়।

প্রজ্ঞা হচ্ছে একজনের কিতাব, মানুষ, বস্তুরাজি, ঘটনা ও অবস্থার সুগভীর অনুধাবন ও উপলব্ধি যা জীবনকে কিতাব অনুসারে পরিচালনা করার সামর্থ্য দান করে। কাজেই প্রজ্ঞা পরিচালিত জীবনের জন্য প্রয়োজন হয় আবেগপ্রসূত প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের। এই প্রতিক্রিয়াগুলো অবিবেচনা জাত ও তাৎক্ষণিক যা উদগত হয় মনোগত ও দলগত কামনা, বাসনা, হিংসা, অহংকার, লোভ ইত্যাদি থেকে। উপযুক্ত পরিকল্পনা ও অনুশীলন ছাড়া, মনের প্রবণতার উপর সার্বক্ষণিক নিরীক্ষণ ছাড়া চিত্তকে পরিশুদ্ধ করা যায় না।

আমরা প্রথমে কোরানের যে তিনটি আয়াত উল্লেখ করেছি সেখানে লক্ষণীয় হলো যে, ২:১২৯ আয়াতে পরিশুদ্ধির উল্লেখ হয়েছে গ্রন্থ ও প্রজ্ঞার পরে; কিন্তু পরের দুই আয়াতে (২:১৫১ ও ৩:১৬৪) পরিশুদ্ধির উল্লেখ হয়েছে অন্য দুটি বিষয়ের আগে। পরিশুদ্ধিই গ্রন্থ ও প্রজ্ঞার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। গ্রন্থকে বুঝবার ও রূপায়িত করার সামর্থ্য হচ্ছে প্রজ্ঞা। অন্যদিকে, পরিশুদ্ধ মনই গ্রন্থকে বুঝতে পারে এবং পরিশুদ্ধ মনেই প্রজ্ঞার উন্মেষ হওয়া সম্ভব। আবেগ ও বাসনার অধীন অশুদ্ধ মন কিতাব বা গ্রন্থকে বিকৃত করে ফেলে। অন্যভাবে বলা যায়, গ্রন্থের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও পরিশুদ্ধি বৃত্তাকারে একে অপরের সহায়ক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন