Do to others what you would have them do to you, for this sums up the Law and the Prophets. (Gospel according to Matthew 7:12)
Stand out firmly with justice as witnesses for God, even if it be against yourselves or parents and relatives, be he rich or poor. (Koran 4:135)

বুধবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৩

বস্তুবাদ, ইহলোকবাদ ও সুখবাদ

আমাদের জগত মন-নিরপেক্ষ বস্তু দিয়ে নাকি মন-সাপেক্ষ ধারণার স্রোত দিয়ে তৈরি—এ নিয়ে দার্শনিক মহলে যথেষ্ট বিতর্ক আছে, যে বিতর্কের নিষ্পত্তি এখনও হয়নি। দার্শনিকেরা নানা প্রকল্প তৈরি করে চলেছেন বটে, কিন্তু যুক্তির চূড়ান্ত বিচারে সে সবই সম্ভাব্য প্রকল্প মাত্র। আমাদের জ্ঞান পরিস্থিতি বৃত্তাবদ্ধ, যে বৃত্তটির শুরুর বিন্দুটি নির্দিষ্ট করা যাচ্ছে না—এ বিষয়ে সকল দার্শনিকই সচেতন, এমনকি হালের পদার্থ বিজ্ঞানীরাও সমস্যাটি জানেন।

বস্তুবাদী মতটি বিজ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞান উভয়ের কাছেই সহজবোধ্য এবং এর প্রায়োগিক মূল্য বিশাল। ভাববাদীরা ব্যাপারটাকে অত সহজ মনে করেন না। এ দুদলের মধ্যখানে, জ্ঞানের ক্ষেত্রে, সংশয়বাদী দার্শনিকদের অবস্থান; যারা মনে করেন এ সমস্যার সমাধান মানুষের পক্ষে আদতে সম্ভবই না। এই শেষোক্তরা বস্তুবাদের বিরুদ্ধে ভাববাদীদের উত্থাপিত আপত্তিগুলোর সারবত্তাকে স্বীকার করেন কিন্তু ভাববাদী প্রকল্পগুলোকেও বস্তুবাদের ন্যায় নিছক অনুমানভিত্তিক ও তাই অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন।

কিন্তু জীবন তো এ মীমাংসার অপেক্ষায় বসে নেই। আর সে কারণে ভাববাদী ও সংশয়বাদী দার্শনিকদের বাস্তব জীবনও বস্তুবাদীদের মতই হয়ে থাকে। কাণ্ডজ্ঞানের অধিকারী আমরা সাধারণ মানুষেরা সহজাতভাবেই বস্তুর মন-নিরপেক্ষ অস্তিত্বটি মেনে নেই। অভিজ্ঞতার প্রাঞ্জলতা, স্মৃতি অনুযায়ী যৌক্তিক প্রত্যাশামত অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি এবং সকল ইন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতায় ও অন্যান্য মানুষের অভিজ্ঞতার বিবরণে সামঞ্জস্য থাকার কারণে এ-বিশ্বাসটি বাল্যকালেই আমাদের মধ্যে তৈরি হয়ে যায়।

প্রভাবশালী মতাবলীর প্রবক্তারা বস্তুবাদের উপরই তাদের রাজনৈতিক ও নীতিতাত্ত্বিক মত তৈরি করেছেন। অন্যদিকে যেহেতু ইহলোকটি ছাড়া অন্যকিছু দৃশ্যমান নয়, তাই রাজনীতি ও নৈতিকতা উভয়কেই তারা ইহলোকবাদের উপর স্থাপন করেছেন। এখানে মানুষকে দেখা হয় বস্তু থেকে আকস্মিকভাবে বা আপতিকভাবে উৎপন্ন একটি প্রাণী হিসেবে; যে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ব্যস্ত ও সুখ উপভোগের উদ্দেশ্যে সদাচঞ্চল।

বস্তু সার্বিকভাবে অথবা নিজের অন্তরগত কাঠামোর দিক থেকে চেতনাহীন। এর কোন জ্ঞান নেই, পরিকল্পনা করার শক্তি নেই, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার কোন সামর্থ্য নেই এবং জগত-জীবনের পরিণতি সম্বন্ধেও এর কোন সম্বিত নেই। এটি অন্ধভাবে নিজের অভ্যন্তরে বিদ্যমান নিয়মের দ্বারা অসচেতনভাবে চালিত হচ্ছে। এটি কোন তাৎপর্য বা উদ্দেশ্য নির্ধারণ করতে পারে না এবং ভাল-মন্দ বিচার করতেও অক্ষম।

মানুষের জৈবিক গঠন ও তার মানসিক প্রবণতাগুলো থেকে বস্তুবাদ-ইহলোকবাদের উপর ভিত্তি করে যৌক্তিকভাবে আমরা সুখবাদেই কেবল উপনীত হতে পারি এবং আদতে ঘটেছেও তাই।

মানুষ যে আকাঙ্ক্ষাগুলো দ্বারা সহজাতভাবে তাড়িত হয় সেগুলো স্বার্থপর আকাঙ্ক্ষা বা বাসনা। আহার, যৌনতা প্রভৃতি ইন্দ্রীয়সুখানুভূতি, বিত্তবৈভবে প্রাচুর্য, খ্যাতি, নান্দনিক আনন্দ ইত্যাদি বাসনার পরিপূরণেই জীবনের সার্থকতা ও সফলতা নিহিত এবং সার্থকতা ও সফলতার পরিমাণ এসব বাসনা পরিপূরণের পরিমাণের সাথে সমানুপাতিক—এই নীতি গ্রহণ করলে এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তি থেকে, এক পরিবার অন্য পরিবার থেকে, এক জাতি অন্য জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য। শুধু তাই নয়, এর ফলে ব্যক্তি পর্যায়ে, পরিবার পর্যায়ে ও জাতি পর্যায়ে একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বাধ্য; পৃথিবীটা স্বার্থের একটা যুদ্ধ ক্ষেত্র হয়ে ওঠে অনিবার্য ভাবে।

এখানে এসে মানুষ সন্ধি করতে বাধ্য হয় কারণ যা যুক্তির দিক থেকে অনিবার্য হয়ে ওঠে তার রাশ টেনে না ধরলে নিজের অস্তিত্বই যে আবার ধ্বংসের মুখে পড়ে, অর্থাৎ এখানে আমরা সংগতি দেখি না, দেখি নিজের সাথে নিজের একটি বিরোধকে—আমার জীবনের সার্থকতার নীতি আমার জীবনকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।

এই ধ্বংস থেকে আত্মরক্ষার জন্য মানুষ আবদ্ধ হয় সামাজিক চুক্তিতে। আর এটিই হলো বস্তুবাদী-ইহলোকবাদী নৈতিকতার জরায়ু। কিন্তু বস্তুবাদ-ইহলোকবাদ থেকে দেখলে এ চুক্তির প্রতি আনুগত্যের ব্যাপারটি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? এ মতবাদ মানুষকে চুক্তির ব্যাপারে ভণ্ডামির—কোরানে যাকে বলা হয়েছে ‘নিফাক’—দিকে ঠেলে দেয়, অর্থাৎ মানুষ যতক্ষণ না বিরুদ্ধ শক্তির নিকট পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখবে ততক্ষণ সে চুক্তির ‘থোরাই কেয়ার’ করবে এবং একই সাথে মুখে চুক্তির মহিমা ও সংশ্লিষ্ট নীতিকথাগুলো তোতার মত আওরাতে থাকবে। এখানেই শেষ নয়, এ মূল্যমানগুলোকেও সে নিজের সুখবাদী লক্ষ্যে আগ্রাসনের জন্য ঢাল হিসেবে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করে বসবে। নিজের চুক্তির সঙ্গে তার এরূপ আচরণ আবার তার মতাদর্শের সাথে যৌক্তিকভাবে মোটেই বিরোধাত্মক হচ্ছে না বা তার সাংস্কৃতিক লক্ষ্যগুলোর সাথেও সাংঘর্ষিক হচ্ছে না। অর্থাৎ প্রথমে দেখা গেল আমার নীতি আমাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তারপর আমাকে নিজের সাথে মিথ্যাচারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

অন্যদিকে, মানুষ এরূপ বস্তুর একটি জগতে বস্তু থেকে সৃষ্ট হলেও চৈতন্যের, যুক্তির, জ্ঞানের, বিচারের ও নীতিবোধের অধিকারী। যুক্তিবাদীতা ও নৈতিকতার বিশাল ভার মানুষ নিজের কাঁধ থেকে ফেলে দিতেও পারছে না। বস্তুবাদ-ইহলোকবাদ-সুখবাদ ভিত্তিক যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে অক্ষম হওয়া সত্ত্বেও মানুষ মহান মানবিক মূল্যবোধগুলোকে নিরন্তর বহন করে চলছে নিজের অন্তরে, বাস্তবে সে তা মানুক আর না-ই মানুক। সাহিত্যিক ও শিল্পীর উচ্ছ্বাস ও আকুলতার মধ্যে আমরা এর প্রকাশ দেখে চলেছি প্রতিনিয়ত।

বস্তু চেতনার অতীত ব্যাখ্যা করতে পারে কিন্তু তার ভবিষ্যৎ নির্দেশ করতে পারে না, তার অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করতে পারে কিন্তু তার কোন মূল্য ও তাৎপর্যের সম্ভাবনাকে নির্দেশ করতে পারে না।

বস্তুবাদ-ইহলোকবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত সুখবাদী নৈতিকতা একটি অগভীর কিন্তু চাতুর্যপূর্ণ স্ববিরোধী ‘কর্পোরেট লেভেল’ নৈতিকতা মাত্র যা নিজের সুখের জন্য মিথ্যাচারপূর্ণ একটি ব্যবসায়ীক কৌশল ছাড়া কিছু নয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন