আকসার নভেল-কবিতা পড়ুয়াদের মধ্য থেকে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ না-পড়া অভাগাদের বাদ দিলে যারা বাকী থাকে তাদের হয়তো মনে আছে, গল্পগুচ্ছের কোন এক গল্পের কোন এক চরিত্রের বাস ছিল ‘হইলে হইতে পারিত’র দেশে। আমরা কেউ কেউ বাস করি টোকামাত্রই ভেঙ্গে পড়ে এমন সহস্র ললিত-তনু স্বপ্ন নিয়ে। আবার কেউ কেউ আছি যারা আকাশের দিকে পাখা মেলার চেষ্টা করা দূরে থাক, প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি মুহূর্তের জন্যও পা’টিকে মাটির উপরে তুলে রাখতে অনিচ্ছুক। এই দুইয়ের জগতের মাঝের জগতটিই হলো আমাদের ‘হইলে হইতে পারিত’র জগত।
ইদানীং আমি এই ‘হইলে হইতে পারিত’ নামের ‘আলম-এ-বরজখ’ এর বাসিন্দা হয়ে উঠছি। এখানে যেন সবকিছুই শর্ত-সাপেক্ষ, যেভাবে কম্পিউটার প্রোগ্রামার’রা শর্তের পর শর্ত জুড়ে দিয়ে রুটিনগুলোকে নানামুখী করে তোলে। এমনটি হলে কেমনটি হতো—এই চিন্তা যেন আমাকে গিলে খেয়েছে, যেভাবে প্রেমে পড়া উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা নাওয়া-খাওয়া মাচায় তুলে এক চিন্তায় বিভোর থাকে। ‘এমনটি’ ও তার জন্য সম্ভাব্য ‘কেমনটি’ নিয়ে আমার এখন বিভোর দশা।
***
দেশটি ভাগ হয়ে গিয়েছে—মনের দিক থেকে, যদিও জমির দিক থেকে নয়। বিভাজন এতদূর গিয়ে ঠেকেছে যে আত্মপরিচয়ের সন্ধানে দিনের বেলাতেও নামতে হয় ডায়োজিনিসের মত লণ্ঠন হাতে। জাতীয়তার প্রশ্নে, পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে, সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নে আমরা আধাআধি বিভক্ত হয়ে পড়েছি। এতো বড় বিভাজন নিয়ে একটি জাতিসত্তা কিরূপে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিবর্তিত হতে পারে সে-পন্থা অন্বেষণে সফল হওয়া দুরূহ। উভয় পক্ষের দাবী অপর পক্ষের অস্তিত্ব অধ্যাস বা মরীচিকার উপর প্রতিষ্ঠিত। দুপক্ষই অপর পক্ষের বিনাশকে সময়ের ব্যাপার বলেই বিশ্বাস করেন এবং সময়ের গতিতে ত্বরণ আনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগগুলো অবলম্বন করেন। এই বিনাশকামী পাল্টাপাল্টি অবস্থান রীতিমত উগ্র বাক্য, পেশী, কৌশল ও অস্ত্রের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। প্রত্যেকের মুখেই ‘আমি কী করব, ওর জন্যই তো কিছু করা গেল না’ প্রাত্যক্ষণিক জপ হয়ে আছে।
কিন্তু এতো বড় খণ্ড কী করে ভিতবিবর্জিত ও মরীচিকাবৎ হয় তার বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা কোথায় পাওয়া যাবে? সমন্বয়ের কোন পথ আছে কিনা এবং সেটি খতিয়ে দেখা যেতে পারে কিনা—এসম্ভাবনাও পরিত্যাজ্য হবে কেন? সে যা-ই হোক, এরকম একটি ব্যর্থ ও শুষ্ক রম্য রচনায় ভারী কথা বিরসে বিঘ্ন ঘটায়। তাছাড়া দুপক্ষের মুখোমুখি অবস্থানের জেদ আশু অপসৃত হওয়ার কোন লক্ষণ দৃশ্যমান নয় বিধায় এবং বিরোধ বিলোপের আশা অনেকের কাছে আসল মরীচিকা বলে সাব্যস্ত হয়ে আছে বিধায়, বাস্তবতার আলোকে ‘এমন হলে কেমন হতো’ প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, দেশটিকে পূর্ব-পশ্চিমে সমান দুভাগে ভাগ করে দেই। রাজমিস্ত্রিরা যেভাবে সুতো টেনে ইট গাঁথে সেভাবে ইয়া লম্বা এক সুতো উত্তর-দক্ষিণে টেনে সীমানাটা এঁকে দেই। তারপর একটা এক্সোডাসের তোলপাড় বাঁধিয়ে দিয়ে বলি, নিজ নিজ খায়েশ মতো এবার তোরা এদিক ওদিক যা। দুপক্ষকে দুটি দেশ দিয়ে দেখতে ইচ্ছে হয় কারা ক’বছরে কতটুকু উন্নতি করে। তবে এখানেও বিপত্তি থাকবে না কেন? এ যদি বলে আমি এভাগ নেব, তো সে বলবে আমারও যে ওটাই চাই। কিন্তু মীমাংসার পথ যে একটি নেই তা কিন্তু নয়।
দেশ দুটির একটির নাম হোক পশ্চিম বাংলাদেশ ও অন্যটির পূর্ব বাংলাদেশ। আমাদের বিবেচ্য এক পক্ষ অপর পক্ষকে অভিহিত করে থাকে ভারতের দালাল বলে; আর অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাকিস্তানের দালাল হওয়ার। এখানেও ডায়োজিনিসের লণ্ঠন হাতে দিনে-দুপুরে বাংলাদেশের দালাল বৃথাই খুঁজে বেড়ান বলে অনেককেই আক্ষেপ করতে শুনেছি। বিবদমান দু’পক্ষের স্বপক্ষের দাবীতে যখন মীমাংসা অসম্ভব হয়ে ওঠে তখন বিপক্ষের দেয়া ইলজামের ভিত্তিতে মীমাংসা সম্ভব হয়। যেহেতু এক ভাগের নামে পশ্চিম বঙ্গের ‘পশ্চিম’ ও অন্যভাগের নামে পূর্ব পাকিস্তানের ‘পূর্ব’ থাকছে এবং যেহেতু ‘নামে নামে যমে টানে’ বলে একটি কথা আছে, সেহেতু কোন পক্ষ পশ্চিমে যাবে আর কোন পক্ষ যাবে পূবে তা আপনি এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঠাহর করে ফেলেছেন।
আমরা কোন কোন দেশের নামে ‘নিউ’ শব্দটি শুনি; কোন কোন শহরের নামেও শব্দটি দেখতে পাই। নিউজিল্যাণ্ড, নিউগিনি ইত্যাদি দেশের নাম আর নিউইয়র্ক, নিউজার্সি বা নিউহ্যাম্পশায়ারের মত শহরের নাম আপনারা প্রায়শই শুনে থাকেন। আমার এই পূর্ব-পশ্চিম নাম ভাল না লাগলে তারা নিজ নিজ দেশে গিয়ে দেশের নাম ‘নিউইন্ডিয়া’ ও ‘নিউপাকিস্তান’ এবং রাজধানীর নাম ‘নিউনিউদিল্লী’ ও ‘নিউইসলামাবাদ’ রেখে দিতে পারেন। তোর দেশ তুই বুঝ—এই স্বাধীনতা তাদেরকে দিয়ে চলুন আমরা একটি গল্প দিয়ে পড়ার ইতি টানি।
***
তিন হাজার বছর আগের কথা। গঙ্গার তীরে কোন এক মহীরুহের শীতল ছায়ায় কোন এক ঋষি মুদ্রিত নেত্রে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। হঠাৎ পূর্ণিমার চাঁদের আলোর স্নিগ্ধতায় চারপাশ আপ্লুত হয়ে উঠলে ঋষি চোখ মেলে চাইলেন। দেখলেন এক জ্যোতির্ময় দেবতা তার দিকে চেয়ে যেন প্রতীক্ষা করছেন। আগমনের উদ্দেশ্য অবগত হয়ে ঋষি দেবতা সমভিব্যাহারে যাত্রা করলেন আকাশ-পাতাল ও স্বর্গ-নরক পরিভ্রমণে। যা কিছু অপস্রিয়মাণ ও ক্ষণস্থায়ী তা কিছুর প্রতি ঋষির আকর্ষণ স্বল্প হওয়ায় তিনি দ্রুততার সাথে আকাশ-পাতাল ভ্রমণ সাঙ্গ করে স্বর্গ-নরকের অভিমুখী হলেন। মানুষের সুখের দৃশ্য যতটা আনন্দদায়ক তার চেয়ে অনেক বেশী বেদনাদায়ক মানুষের দুঃখের দৃশ্য। কাজেই ঋষি স্বর্গ পরিদর্শনের সময়ও সংক্ষিপ্ত করলেন।
নরকে গিয়ে দেখা গেল সেখানে প্রজ্বলিত চুলার উপরে বিশাল বিশাল সব কড়াই। প্রতিটির গায়ে লেখা আছে কোন না কোন জাতির নাম। এই যেমন আমেরিকান, ইংলিশ, আরব, পার্শি ইত্যাদি। প্রতিটি কড়াইয়ের চারপাশে মুগুর-হস্ত দেবতারা প্রহরায় নিয়োজিত, যেন কোন দুরাচারী কড়াইয়ের ঢাকনা সরিয়ে বেরিয়ে আসতে না পারে। এমন যেকোনো প্রচেষ্টার সূচনাতেই প্রহরী দেবতাগণ তা নিষ্ফল করে দিচ্ছিলেন।
যথানিয়মে একটি কড়াইয়ের গায়ে লেবেল আঁটা ছিল ‘বাঙালী বা বাংলাদেশী, যার যার বিশ্বাসমত’। কিন্তু কড়াইয়ে না ছিল ঢাকনা, না ছিল তাকে ঘিরে প্রহরীর অবস্থিতি। এতে সবিস্ময়ে কিন্তু তুষ্টচিত্তে ঋষি গাইড-দেবতাকে বললেন, “আহ, কিঞ্চিত শান্তি পেলাম এই দেখে যে তাদের কাউকে এখানে আসতে হয়নি।” একথায় দেবতা দুঃখিত বদনে ঋষিকে কড়াইয়ের কাছে গিয়ে ভেতরের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার অনুরোধ করলেন। তিনি দেখলেন। সেখানে লোকের সংখ্যা কম নয়। তবে একজন যদি কড়াইয়ের বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কিছুটা সফলকাম হয়ে উঠে তখন তার নীচের অন্যরা তার পা ধরে টেনে হিরহিরিয়ে তাকে নিজেদের মধ্যে নামিয়ে আনে।
বিষণ্ণ মনে দেবতা বললেন, “হুজুর, এই হচ্ছে অবস্থা। অন্য জাতিগুলোর বৈশিষ্ট্য এরকম যে, কেউ বেরিয়ে আসতে চাইলে নীচেরগুলো তাকে ঠেলে উপরে উঠতে সাহায্য করে। তাই ঢাকনা ও সদাসতর্ক প্রহরী। কিন্তু ইনাদের বেলায় সেরকম কোন আয়োজন নিষ্প্রয়োজন বিবেচিত হয়েছে। ইনারা নিজেরা নিজেরাই জাহান্নামের আগুনে জ্বলে-পুড়ে মরছেন।”
ভারাক্রান্ত হৃদয়ে গঙ্গার তটে ফিরে সেই মহীরুহের নীচে বসে ঋষি পুনরায় নেত্র মুদ্রিত করলেন।
ইদানীং আমি এই ‘হইলে হইতে পারিত’ নামের ‘আলম-এ-বরজখ’ এর বাসিন্দা হয়ে উঠছি। এখানে যেন সবকিছুই শর্ত-সাপেক্ষ, যেভাবে কম্পিউটার প্রোগ্রামার’রা শর্তের পর শর্ত জুড়ে দিয়ে রুটিনগুলোকে নানামুখী করে তোলে। এমনটি হলে কেমনটি হতো—এই চিন্তা যেন আমাকে গিলে খেয়েছে, যেভাবে প্রেমে পড়া উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা নাওয়া-খাওয়া মাচায় তুলে এক চিন্তায় বিভোর থাকে। ‘এমনটি’ ও তার জন্য সম্ভাব্য ‘কেমনটি’ নিয়ে আমার এখন বিভোর দশা।
***
দেশটি ভাগ হয়ে গিয়েছে—মনের দিক থেকে, যদিও জমির দিক থেকে নয়। বিভাজন এতদূর গিয়ে ঠেকেছে যে আত্মপরিচয়ের সন্ধানে দিনের বেলাতেও নামতে হয় ডায়োজিনিসের মত লণ্ঠন হাতে। জাতীয়তার প্রশ্নে, পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে, সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নে আমরা আধাআধি বিভক্ত হয়ে পড়েছি। এতো বড় বিভাজন নিয়ে একটি জাতিসত্তা কিরূপে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিবর্তিত হতে পারে সে-পন্থা অন্বেষণে সফল হওয়া দুরূহ। উভয় পক্ষের দাবী অপর পক্ষের অস্তিত্ব অধ্যাস বা মরীচিকার উপর প্রতিষ্ঠিত। দুপক্ষই অপর পক্ষের বিনাশকে সময়ের ব্যাপার বলেই বিশ্বাস করেন এবং সময়ের গতিতে ত্বরণ আনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগগুলো অবলম্বন করেন। এই বিনাশকামী পাল্টাপাল্টি অবস্থান রীতিমত উগ্র বাক্য, পেশী, কৌশল ও অস্ত্রের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। প্রত্যেকের মুখেই ‘আমি কী করব, ওর জন্যই তো কিছু করা গেল না’ প্রাত্যক্ষণিক জপ হয়ে আছে।
কিন্তু এতো বড় খণ্ড কী করে ভিতবিবর্জিত ও মরীচিকাবৎ হয় তার বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা কোথায় পাওয়া যাবে? সমন্বয়ের কোন পথ আছে কিনা এবং সেটি খতিয়ে দেখা যেতে পারে কিনা—এসম্ভাবনাও পরিত্যাজ্য হবে কেন? সে যা-ই হোক, এরকম একটি ব্যর্থ ও শুষ্ক রম্য রচনায় ভারী কথা বিরসে বিঘ্ন ঘটায়। তাছাড়া দুপক্ষের মুখোমুখি অবস্থানের জেদ আশু অপসৃত হওয়ার কোন লক্ষণ দৃশ্যমান নয় বিধায় এবং বিরোধ বিলোপের আশা অনেকের কাছে আসল মরীচিকা বলে সাব্যস্ত হয়ে আছে বিধায়, বাস্তবতার আলোকে ‘এমন হলে কেমন হতো’ প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, দেশটিকে পূর্ব-পশ্চিমে সমান দুভাগে ভাগ করে দেই। রাজমিস্ত্রিরা যেভাবে সুতো টেনে ইট গাঁথে সেভাবে ইয়া লম্বা এক সুতো উত্তর-দক্ষিণে টেনে সীমানাটা এঁকে দেই। তারপর একটা এক্সোডাসের তোলপাড় বাঁধিয়ে দিয়ে বলি, নিজ নিজ খায়েশ মতো এবার তোরা এদিক ওদিক যা। দুপক্ষকে দুটি দেশ দিয়ে দেখতে ইচ্ছে হয় কারা ক’বছরে কতটুকু উন্নতি করে। তবে এখানেও বিপত্তি থাকবে না কেন? এ যদি বলে আমি এভাগ নেব, তো সে বলবে আমারও যে ওটাই চাই। কিন্তু মীমাংসার পথ যে একটি নেই তা কিন্তু নয়।
দেশ দুটির একটির নাম হোক পশ্চিম বাংলাদেশ ও অন্যটির পূর্ব বাংলাদেশ। আমাদের বিবেচ্য এক পক্ষ অপর পক্ষকে অভিহিত করে থাকে ভারতের দালাল বলে; আর অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাকিস্তানের দালাল হওয়ার। এখানেও ডায়োজিনিসের লণ্ঠন হাতে দিনে-দুপুরে বাংলাদেশের দালাল বৃথাই খুঁজে বেড়ান বলে অনেককেই আক্ষেপ করতে শুনেছি। বিবদমান দু’পক্ষের স্বপক্ষের দাবীতে যখন মীমাংসা অসম্ভব হয়ে ওঠে তখন বিপক্ষের দেয়া ইলজামের ভিত্তিতে মীমাংসা সম্ভব হয়। যেহেতু এক ভাগের নামে পশ্চিম বঙ্গের ‘পশ্চিম’ ও অন্যভাগের নামে পূর্ব পাকিস্তানের ‘পূর্ব’ থাকছে এবং যেহেতু ‘নামে নামে যমে টানে’ বলে একটি কথা আছে, সেহেতু কোন পক্ষ পশ্চিমে যাবে আর কোন পক্ষ যাবে পূবে তা আপনি এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঠাহর করে ফেলেছেন।
আমরা কোন কোন দেশের নামে ‘নিউ’ শব্দটি শুনি; কোন কোন শহরের নামেও শব্দটি দেখতে পাই। নিউজিল্যাণ্ড, নিউগিনি ইত্যাদি দেশের নাম আর নিউইয়র্ক, নিউজার্সি বা নিউহ্যাম্পশায়ারের মত শহরের নাম আপনারা প্রায়শই শুনে থাকেন। আমার এই পূর্ব-পশ্চিম নাম ভাল না লাগলে তারা নিজ নিজ দেশে গিয়ে দেশের নাম ‘নিউইন্ডিয়া’ ও ‘নিউপাকিস্তান’ এবং রাজধানীর নাম ‘নিউনিউদিল্লী’ ও ‘নিউইসলামাবাদ’ রেখে দিতে পারেন। তোর দেশ তুই বুঝ—এই স্বাধীনতা তাদেরকে দিয়ে চলুন আমরা একটি গল্প দিয়ে পড়ার ইতি টানি।
***
তিন হাজার বছর আগের কথা। গঙ্গার তীরে কোন এক মহীরুহের শীতল ছায়ায় কোন এক ঋষি মুদ্রিত নেত্রে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। হঠাৎ পূর্ণিমার চাঁদের আলোর স্নিগ্ধতায় চারপাশ আপ্লুত হয়ে উঠলে ঋষি চোখ মেলে চাইলেন। দেখলেন এক জ্যোতির্ময় দেবতা তার দিকে চেয়ে যেন প্রতীক্ষা করছেন। আগমনের উদ্দেশ্য অবগত হয়ে ঋষি দেবতা সমভিব্যাহারে যাত্রা করলেন আকাশ-পাতাল ও স্বর্গ-নরক পরিভ্রমণে। যা কিছু অপস্রিয়মাণ ও ক্ষণস্থায়ী তা কিছুর প্রতি ঋষির আকর্ষণ স্বল্প হওয়ায় তিনি দ্রুততার সাথে আকাশ-পাতাল ভ্রমণ সাঙ্গ করে স্বর্গ-নরকের অভিমুখী হলেন। মানুষের সুখের দৃশ্য যতটা আনন্দদায়ক তার চেয়ে অনেক বেশী বেদনাদায়ক মানুষের দুঃখের দৃশ্য। কাজেই ঋষি স্বর্গ পরিদর্শনের সময়ও সংক্ষিপ্ত করলেন।
নরকে গিয়ে দেখা গেল সেখানে প্রজ্বলিত চুলার উপরে বিশাল বিশাল সব কড়াই। প্রতিটির গায়ে লেখা আছে কোন না কোন জাতির নাম। এই যেমন আমেরিকান, ইংলিশ, আরব, পার্শি ইত্যাদি। প্রতিটি কড়াইয়ের চারপাশে মুগুর-হস্ত দেবতারা প্রহরায় নিয়োজিত, যেন কোন দুরাচারী কড়াইয়ের ঢাকনা সরিয়ে বেরিয়ে আসতে না পারে। এমন যেকোনো প্রচেষ্টার সূচনাতেই প্রহরী দেবতাগণ তা নিষ্ফল করে দিচ্ছিলেন।
যথানিয়মে একটি কড়াইয়ের গায়ে লেবেল আঁটা ছিল ‘বাঙালী বা বাংলাদেশী, যার যার বিশ্বাসমত’। কিন্তু কড়াইয়ে না ছিল ঢাকনা, না ছিল তাকে ঘিরে প্রহরীর অবস্থিতি। এতে সবিস্ময়ে কিন্তু তুষ্টচিত্তে ঋষি গাইড-দেবতাকে বললেন, “আহ, কিঞ্চিত শান্তি পেলাম এই দেখে যে তাদের কাউকে এখানে আসতে হয়নি।” একথায় দেবতা দুঃখিত বদনে ঋষিকে কড়াইয়ের কাছে গিয়ে ভেতরের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার অনুরোধ করলেন। তিনি দেখলেন। সেখানে লোকের সংখ্যা কম নয়। তবে একজন যদি কড়াইয়ের বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কিছুটা সফলকাম হয়ে উঠে তখন তার নীচের অন্যরা তার পা ধরে টেনে হিরহিরিয়ে তাকে নিজেদের মধ্যে নামিয়ে আনে।
বিষণ্ণ মনে দেবতা বললেন, “হুজুর, এই হচ্ছে অবস্থা। অন্য জাতিগুলোর বৈশিষ্ট্য এরকম যে, কেউ বেরিয়ে আসতে চাইলে নীচেরগুলো তাকে ঠেলে উপরে উঠতে সাহায্য করে। তাই ঢাকনা ও সদাসতর্ক প্রহরী। কিন্তু ইনাদের বেলায় সেরকম কোন আয়োজন নিষ্প্রয়োজন বিবেচিত হয়েছে। ইনারা নিজেরা নিজেরাই জাহান্নামের আগুনে জ্বলে-পুড়ে মরছেন।”
ভারাক্রান্ত হৃদয়ে গঙ্গার তটে ফিরে সেই মহীরুহের নীচে বসে ঋষি পুনরায় নেত্র মুদ্রিত করলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন