টমাস আলভা এডিসন বিদ্যুতের প্রবাহ থেকে আলো আবিষ্কার করেছিলেন।
দর্শন শাস্ত্রের পর মানব সভ্যতার বিকাশের ইতিহাসই সম্ভবত সবচে বেশী কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়। পাথরের যুগ, আগুনের যুগ, লোহার যুগ ইত্যাদি কত নামেই না সভ্যতার বিকাশস্তরগুলিকে পরিচিত করা হয়েছে। হাঁটিহাঁটি পা-পা করে করে এখন আমরা দৌড়ঝাঁপ দিয়ে বেড়াচ্ছি। আমরা যে কালে বাস করছি তার জুতসই নাম কি হতে পারে? বিদ্যুতের যুগ? যে দুটি কৌশল আমরা যে আগারে বাস করছি তা নির্মাণ করেছে সে দুটি হল চক্র-গোলকের ঘূর্ণন-কৌশল ও ইলেকট্রনের প্রবাহ-কৌশল। ইতোমধ্যে ঘূর্ণনশক্তির উৎস যথেচ্ছভাবে ঢুকে পড়েছে বিদ্যুতের প্রবাহ জগতে। কাজেই বিদ্যুৎ-প্রবাহ-কৌশলটিই যে আমাদের যুগাবয়বের চন্দ্রটীকা তা একরকম বলাই যায়।
১৮৮০ সালে এডিসন বিদ্যুতের প্রবাহ থেকে প্রথম আলো উৎপাদন করেছিলেন। তাঁর নিকট আমাদের ঋণের কথা স্মরণ করছি এবং খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি সে ঋণ আমাদেরকে কি পরিমাণ দেউলিয়া করেছে তা।
এডিসনের আলোর বর্তিকা বা কুপির ঝালরে নগরগুলি এখন রাতের বেলা হাস্যময়ী, লাস্যময়ী হয়ে উঠেছে। এ হাসি আর লাসি অর্থাৎ হাস্য আর লাস্য-এর প্রাপ্তিযজ্ঞাগ্নিতে কি বলী দিতে হয়েছে তা ভাবনার একটি বিষয় হতে পারে বলে আমরা এখন আর ভাবতেও পারছি না—হারানোর ব্যাপ্তি এতই বিশাল। নগরের আকাশে তারার রাজ্য দেখা যায় না—এ তথ্যটি নগরবাসী অনেক ছেলেমেয়েই আজ জানে না। তারা তারাদের অস্তিত্ব ও অবস্থানজগত সম্বন্ধে জানতে পারে ভূগোল বই থেকে—যেন তারা’রা ম্যাক্র-ওয়ার্ল্ডে ইলেকট্রন-প্রোটনের মত কিছু—চোখে দেখার বস্তু না, যৌক্তিক কায়দায় তৈরি মডেলের উপাদান মাত্র। তারাদের রাজ্য কী, তা জানে গ্রামের ছেলেমেয়েরা, যারা ঈষদঠান্ডায় কাঁথামুড়ি দিয়ে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দের অনুপম তানে আত্মার কথা শুনতে পায়।
গ্রামের প্রকৃত রূপটি দূর থেকে দেখা যায় না। দূর থেকে তাকালে নারীর মুখের হাসিটি দৃষ্ট হলেও তার মনের কথাটি যেমন অশ্রুত থেকে যায়, গাড়ীর জানালা দিয়ে গ্রাম দেখার ব্যাপারটিও সেরকম। গ্রামকে বুঝতে হলে গ্রামের অন্তরে প্রবেশ করতে হয়। গ্রামের অন্তর থেকে মধ্যরাতে উঠানে শুয়ে আকাশের দিকে তাকালে তবে অনুভব করা যায় তারাদের রাজ্যের মহিমা। যে অনুভূমে অন্ধকারে গাঢ়ত্ব নেই, নিস্তব্ধতায় ঘনত্ব নেই, মাটির বিস্তার নেই, জলের শব্দ নেই, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক নেই, বৃক্ষের রহস্যময়ী মায়াবী অবয়ব নেই সেখানে তারারাজ্যের আসল প্রদর্শনী নেই। তাই সে অনুভূম থেকে আকাশের দিকে উল্লম্ব প্রেক্ষায় ফল হয় না।
আমরা জানি ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করেছেন মানুষের জন্য। বিগব্যাং থেকে পৃথিবীর উৎপত্তির মধ্যে কালগত সুবিশাল ব্যবধানের ও পৃথিবীর উৎপত্তিকালে জগতের অর্জিত সুবিশাল বিস্তারের কী প্রয়োজন ছিল বোঝা মুশকিল।[১] আজ আমরা যেরূপ মানুষ সেরূপ মানুষ তৈরির জন্য শুধু একটি পৃথিবীই কি যথেষ্ট ছিল না? এত বিশাল দেশগত বিস্তার ও এত প্রলম্বিত কালের মহাসমারোহের বা আয়োজনের মর্ম বা মূল্য বা উপযোগিতা কী? সেখানে তখন তো দেখার জন্য বা শোনার জন্য কেউ ছিল না; অর্থাৎ সে জগতে রূপ ছিল না, সুর ছিল না।[২] আপনি যদি গ্রামে যান এবং মাঝরাতে তারাভরা আকাশের দিকে তাকান তবেই ঈশ্বরের মনে কি ছিল তা কিঞ্চিৎ অনুভব করতে পারবেন, যে অনুভব থেকে নগরবাসীরা বঞ্চিত।
তারাহীন আকাশের নীচে বসবাস আমাদেরকে পরিণত করেছে প্রজাতির ইচ্ছার কাছে সমর্পিতপ্রাণ যম্বিতে। যম্বিদের মত চলাচলই যেন আমাদের জেহাদ আর প্রজাতির ইচ্ছার নিকট সদাপ্রণত থাকাই যেন আমাদের এবাদত। মানব জীবনের যে মূল্যমানগুলির অভিব্যক্তি জীবনের বিকাশের মাত্রাকে নির্দেশ করে তার সাথে যেন আমাদের চিরকালের বৈরিতা। ভাবছেন—কী! এত বড় কথা!! প্রমাণ দিতে না পারলে সাড়ে তিন হাত দেখে নেবেন—এই তো! তাহলে একটি নিরাপদ উদাহরণ দেয়া যাক। গ্রামের কৃষকেরা মার্ক্সীয় তত্ত্বানুসারে নগরের শ্রমিকগণের সমশ্রেণীভূক্ত। কিন্তু গ্রামের কৃষকেরা সর্বহারা হওয়া সত্ত্বেও আজও লালন করে চলেছেন আত্মার অনেক ঐশ্বর্য। নগরের শ্রমিকেরা কি করে একেবারে সর্বস্বসর্বহারা হয়ে উঠলেন তার রহস্য জানে আকাশের তারারা।
টমাস আলভা এডিসনের কুপির ঝালর আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে সীমিত করেছে মাটির বলয়ে, আর কেড়ে নিয়েছে তারাভরা আকাশের অসীম রাজ্য।
[১] ভাববাদীদের উত্থাপিত সমস্যাগুলো আমলে ইচ্ছে করেই নেইনি, সুবিধার জন্য, এবং ধরে নিয়েছি যে বিজ্ঞান জগতের সারপদার্থকে ‘দেখতে’ পায়।
[২] বিজ্ঞানের নিয়মে এগোলেও ‘রূপ-সুরের’ সমস্যাটি থেকেই যায়।
দর্শন শাস্ত্রের পর মানব সভ্যতার বিকাশের ইতিহাসই সম্ভবত সবচে বেশী কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়। পাথরের যুগ, আগুনের যুগ, লোহার যুগ ইত্যাদি কত নামেই না সভ্যতার বিকাশস্তরগুলিকে পরিচিত করা হয়েছে। হাঁটিহাঁটি পা-পা করে করে এখন আমরা দৌড়ঝাঁপ দিয়ে বেড়াচ্ছি। আমরা যে কালে বাস করছি তার জুতসই নাম কি হতে পারে? বিদ্যুতের যুগ? যে দুটি কৌশল আমরা যে আগারে বাস করছি তা নির্মাণ করেছে সে দুটি হল চক্র-গোলকের ঘূর্ণন-কৌশল ও ইলেকট্রনের প্রবাহ-কৌশল। ইতোমধ্যে ঘূর্ণনশক্তির উৎস যথেচ্ছভাবে ঢুকে পড়েছে বিদ্যুতের প্রবাহ জগতে। কাজেই বিদ্যুৎ-প্রবাহ-কৌশলটিই যে আমাদের যুগাবয়বের চন্দ্রটীকা তা একরকম বলাই যায়।
১৮৮০ সালে এডিসন বিদ্যুতের প্রবাহ থেকে প্রথম আলো উৎপাদন করেছিলেন। তাঁর নিকট আমাদের ঋণের কথা স্মরণ করছি এবং খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি সে ঋণ আমাদেরকে কি পরিমাণ দেউলিয়া করেছে তা।
এডিসনের আলোর বর্তিকা বা কুপির ঝালরে নগরগুলি এখন রাতের বেলা হাস্যময়ী, লাস্যময়ী হয়ে উঠেছে। এ হাসি আর লাসি অর্থাৎ হাস্য আর লাস্য-এর প্রাপ্তিযজ্ঞাগ্নিতে কি বলী দিতে হয়েছে তা ভাবনার একটি বিষয় হতে পারে বলে আমরা এখন আর ভাবতেও পারছি না—হারানোর ব্যাপ্তি এতই বিশাল। নগরের আকাশে তারার রাজ্য দেখা যায় না—এ তথ্যটি নগরবাসী অনেক ছেলেমেয়েই আজ জানে না। তারা তারাদের অস্তিত্ব ও অবস্থানজগত সম্বন্ধে জানতে পারে ভূগোল বই থেকে—যেন তারা’রা ম্যাক্র-ওয়ার্ল্ডে ইলেকট্রন-প্রোটনের মত কিছু—চোখে দেখার বস্তু না, যৌক্তিক কায়দায় তৈরি মডেলের উপাদান মাত্র। তারাদের রাজ্য কী, তা জানে গ্রামের ছেলেমেয়েরা, যারা ঈষদঠান্ডায় কাঁথামুড়ি দিয়ে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দের অনুপম তানে আত্মার কথা শুনতে পায়।
গ্রামের প্রকৃত রূপটি দূর থেকে দেখা যায় না। দূর থেকে তাকালে নারীর মুখের হাসিটি দৃষ্ট হলেও তার মনের কথাটি যেমন অশ্রুত থেকে যায়, গাড়ীর জানালা দিয়ে গ্রাম দেখার ব্যাপারটিও সেরকম। গ্রামকে বুঝতে হলে গ্রামের অন্তরে প্রবেশ করতে হয়। গ্রামের অন্তর থেকে মধ্যরাতে উঠানে শুয়ে আকাশের দিকে তাকালে তবে অনুভব করা যায় তারাদের রাজ্যের মহিমা। যে অনুভূমে অন্ধকারে গাঢ়ত্ব নেই, নিস্তব্ধতায় ঘনত্ব নেই, মাটির বিস্তার নেই, জলের শব্দ নেই, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক নেই, বৃক্ষের রহস্যময়ী মায়াবী অবয়ব নেই সেখানে তারারাজ্যের আসল প্রদর্শনী নেই। তাই সে অনুভূম থেকে আকাশের দিকে উল্লম্ব প্রেক্ষায় ফল হয় না।
আমরা জানি ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করেছেন মানুষের জন্য। বিগব্যাং থেকে পৃথিবীর উৎপত্তির মধ্যে কালগত সুবিশাল ব্যবধানের ও পৃথিবীর উৎপত্তিকালে জগতের অর্জিত সুবিশাল বিস্তারের কী প্রয়োজন ছিল বোঝা মুশকিল।[১] আজ আমরা যেরূপ মানুষ সেরূপ মানুষ তৈরির জন্য শুধু একটি পৃথিবীই কি যথেষ্ট ছিল না? এত বিশাল দেশগত বিস্তার ও এত প্রলম্বিত কালের মহাসমারোহের বা আয়োজনের মর্ম বা মূল্য বা উপযোগিতা কী? সেখানে তখন তো দেখার জন্য বা শোনার জন্য কেউ ছিল না; অর্থাৎ সে জগতে রূপ ছিল না, সুর ছিল না।[২] আপনি যদি গ্রামে যান এবং মাঝরাতে তারাভরা আকাশের দিকে তাকান তবেই ঈশ্বরের মনে কি ছিল তা কিঞ্চিৎ অনুভব করতে পারবেন, যে অনুভব থেকে নগরবাসীরা বঞ্চিত।
তারাহীন আকাশের নীচে বসবাস আমাদেরকে পরিণত করেছে প্রজাতির ইচ্ছার কাছে সমর্পিতপ্রাণ যম্বিতে। যম্বিদের মত চলাচলই যেন আমাদের জেহাদ আর প্রজাতির ইচ্ছার নিকট সদাপ্রণত থাকাই যেন আমাদের এবাদত। মানব জীবনের যে মূল্যমানগুলির অভিব্যক্তি জীবনের বিকাশের মাত্রাকে নির্দেশ করে তার সাথে যেন আমাদের চিরকালের বৈরিতা। ভাবছেন—কী! এত বড় কথা!! প্রমাণ দিতে না পারলে সাড়ে তিন হাত দেখে নেবেন—এই তো! তাহলে একটি নিরাপদ উদাহরণ দেয়া যাক। গ্রামের কৃষকেরা মার্ক্সীয় তত্ত্বানুসারে নগরের শ্রমিকগণের সমশ্রেণীভূক্ত। কিন্তু গ্রামের কৃষকেরা সর্বহারা হওয়া সত্ত্বেও আজও লালন করে চলেছেন আত্মার অনেক ঐশ্বর্য। নগরের শ্রমিকেরা কি করে একেবারে সর্বস্বসর্বহারা হয়ে উঠলেন তার রহস্য জানে আকাশের তারারা।
টমাস আলভা এডিসনের কুপির ঝালর আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে সীমিত করেছে মাটির বলয়ে, আর কেড়ে নিয়েছে তারাভরা আকাশের অসীম রাজ্য।
[১] ভাববাদীদের উত্থাপিত সমস্যাগুলো আমলে ইচ্ছে করেই নেইনি, সুবিধার জন্য, এবং ধরে নিয়েছি যে বিজ্ঞান জগতের সারপদার্থকে ‘দেখতে’ পায়।
[২] বিজ্ঞানের নিয়মে এগোলেও ‘রূপ-সুরের’ সমস্যাটি থেকেই যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন